প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে একেকটি পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়ে শত শত কোটি টাকা লুটে নিলেও সরকার যেমন নীরব থাকেন; বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সংসদে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, ‘সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা খুবই শক্তিশালী। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে বিপদে পড়তে হবে।’ পরিবহন সেক্টরেও সরকারের একই দশা। কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের মতোই সরকারের চেয়ে পরিবহন সেক্টরে বাস মালিকদের হাত অনেক লম্বা। কারণ আগামী নির্বাচনে ব্যবসায়ীদের মতোই পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের সরকারি দল নিজেদের পক্ষে ব্যবহার করতে চায়। যার কারণে সাধারণ মানুষের সুবিধার চেয়ে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী ও পরিবহন মালিকদের স্বার্থকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে।
রাজধানীসহ সরাদেশে গণপরিবহনে চলছে নৈরাজ্য চলছে বছরের পর বছর ধরে। ভাড়া নৈরাজ্যের পাশাপাশি ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচলে নৈরাজ্য। রাজধানীতে যেসব কারণে বায়ু দুষণ শব্দ দুষণ হয় তার অন্যতম হচ্ছে ফিটনেসবিহীন যানবাহন। প্রায়ই ঢাকা বিশ্বের বায়ূ দুষণের শহরগুলোর শীর্ষে অবস্থান করছে। বায়ু দুষণ শব্দ দুষণ রোধ এবং সড়কে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সরকার মেয়াদউত্তীর্ণ লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন সড়কে চলাচল বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছিল। ২০ থেকে ২৫ বছরের পুরনো যানবাহন উঠিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে গত ১৭ মে প্রজ্ঞাপন জারী করা হয়। কিন্তু পরিবহন মালিকদের চাপে ৩০ জুলাই সে প্রজ্ঞাপন স্থগিত করা হয়। এতে বলা হয় ফিটনেসবিহীন এবং ধীরগতির যানের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরো করলে আগামী নির্বাচনে প্রভাব পড়বে। অর্থাৎ পরিবহন মালিকদের অবৈধ সুবিধা দিয়ে আগামী নির্বাচনে তাদের পক্ষে রাখার কৌশল নিয়েছে সরকার। আগামী রাজনৈতিক ইস্যুত তথা সিন্ডিকেটের অসৎ ব্যবসায়ীদের অবৈধ সুবিধা দিয়ে পক্ষে রাখার কৌশল গ্রহণ করেছে; তেমনি পরিবহন সেক্টরের মালিক শ্রমিকদের সরকারের পক্ষ্যে রাখতে সড়ক-মহাসড়কে মেয়াদউত্তীর্ণ যানবাহন উঠিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সরকার।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, মালিকদের আপত্তির কারণে মেয়াদউত্তীর্ণ যানবাহন উঠিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়েছে। তারা সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ও সচিবের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন। গণপরিবহন মালিকরা বলেছেন, এই প্রজ্ঞাপন কার্যকর হলে এতসংখ্যক মোটরযান সরিয়ে দিলে পরিবহন সঙ্কট দেখা দিতে পারে। তাই তারা সময় চেয়েছে। এ ব্যাপারে যে কমিটি আছে তারা সেটি দেখবে। অবশ্য রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, সড়ক নিরাপত্তার জন্য লক্কড়ঝক্কড় বাস একটি নির্ধারিত সময়ের পর রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া দরকার। কিন্তু সরকার কেন এই প্রজ্ঞাপন স্থগিত করল, তা বোধগম্য নয়। এটা হতে পারে পরিবহন মালিকদের চাপের কারণে সরকার তার অবস্থান থেকে সরে এসেছে। এর আগেও অনেকবার এ রকম বড় সিদ্ধান্ত নিতে এ রকম ঘটনা ঘটেছে।
দেশের গণপরিবহন সেক্টরে নৈরাজ্যের যেন শেষ নেই। সড়ক-মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। রাজনীতি, নির্বাচন ভোট ইত্যাদির কারণে ক্ষমতাসীনরা যে পরিবহণ মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে গেছে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়ার পর সেখান থেকে অসহায়ের মতো সরে আসতে বাধ্য হয়েছে। ফলে সড়ক-মহাসড়কে অবাধে চলছে ফিটনেসবিহীন অবৈধ যানবহান। কমছে না সড়ক দুর্ঘটনা। লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ সরাদেশের সড়ক-মহাসড়কে। ফিটনেসবিহীন এবং রঙ করে বিভিন্ন রুটে চলছে শত শত বাস। পুরোনো লক্কড়-ঝক্কড় বাসগুলোকে রং করে আবার রাস্তায় নামানোর চর্চা মালিকদের দীর্ঘদিনের। এসব বাস রাস্তায় চলাচলে সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি তৈরি করে। এছাড়া পুরোনো ট্রাকের কালো ধোঁয়া মাঝেমধ্যেই চোখে পড়ে মহাসড়কে।
ঢাকার রাস্তায় কতটি বাসের রুট পারমিট রয়েছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান কারো কাছে নেই। একেকটি রুটে কোন পরিবহনের কতটি বাস চলার কথা আর কতটি চলছে তারও হিসাব নেই। পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠন এবং ট্রাফিক পুলিশের যোগসাজশে চলছে লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ি। বিভিন্ন কোম্পানির বাস রুটের ট্রাফিকের সঙ্গে করা মাসিক চুক্তিতে নির্বিঘেœ চলাচল করছে।
সড়কের দুর্ঘটনা ও যানজটের প্রধান কারণ হিসেবে মেয়াদোত্তীর্ণ লক্কড়-ঝক্কড় গাড়িগুলো দায়ী বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া অস্বাস্থ্যকর বাতাস এবং অসহনীয় তাপপ্রবাহের কারণ হিসেবে গাছ কাটার পাশাপাশি কালো ধোঁয়া নির্গত মেয়াদোত্তীর্ণ লক্কড়-ঝক্কড় গাড়িগুলোকেও অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন পরিবেশবিদরা। পরিবেশ দূষণের অন্যতম তৃতীয় কারণ লক্কড়-ঝক্কড় মেয়াদোত্তীর্ণ এসব যানবাহন, যা বায়ুদূষণের জন্য ১৫ ভাগ দায়ী। তাই বাস-ট্রাক আয়ুষ্কালের লাগাম টানতে চেয়েছিল সরকার।
মোটরযানের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল নির্ধারণ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন প্রকাশের আড়াই মাস পরই স্থগিত করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। গত ৩ আগস্ট এ সংক্রান্ত একটি আদেশ প্রকাশ করেছে বিভাগটি। পরিবহন মালিকদের চাপের কারণে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রজ্ঞাপন স্থগিতের বিষয়ে জানানো হয়, মোটরযানের স্ক্র্যাপ নীতিমালার আওতায় মিনিবাসের ক্ষেত্রে ২০ বছর এবং ট্রাক, কাভার্ডভ্যান প্রভৃতি মালবাহী মোটরযানের ক্ষেত্রে ২৫ বছর ইকোনমিক লাইফ নির্ধারণ করা হয়। গত ১৭ মে এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। নতুন আদেশ দ্বারা এটি স্থগিত করা হয়েছে। জনস্বার্থে জারিকৃত এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে। প্রজ্ঞাপন স্থগিতের ফলে তাদের পুরাতন লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন কিংবা ২০ বছরের অধিক রিকন্ডিশন গাড়ির অনুমতি পাওয়ার পথ সুগম হয়েছে।
জানা যায়, আয়ুষ্কাল ফুরানো লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি সড়কে চললে দুর্ঘটনা বাড়ে, পরিবেশনও দূষণ হয়। তাই পুরোনো গাড়ি যাতে ব্যবহার করা না যায়, সেজন্য টুকরো টুকরো করে ফেলার বিধান ছিল আইনে। কিন্তু অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল নির্ধারিত না থাকায় লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি ধ্বংস করা যাচ্ছিল না। গত ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনের ৩৬ ধারায় মোটরযানের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল নির্ধারণের কথা বলা ছিল। কিন্তু আয়ুষ্কাল নির্ধারণের পর এর মেয়াদ পাঁচ বছর বাড়ানোর দাবি করেন বাস ও ট্রাক মালিকরা। তারা বাস ও মিনিবাসের আয়ুষ্কাল ২৫ বছর ও ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান প্রভৃতি মালবাহী মোটরযানের আয়ুষ্কাল ৩০ বছর করার দাবি জানান। এর পরপরই এ আদেশ এলো।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রফেসর ড. শামসুল হক বলেন, গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের সময়ই বলা থাকে গাড়ির মেয়াদ কত সাল পর্যন্ত। এই গাড়িটি কতদিন চলতে পারবে। এক সঙ্গে তো আর সব গাড়ির রেজিস্ট্রেশন হয়নি। বিভিন্ন সময়য়ে এসব গাড়ির রেজিস্ট্রেশন হয়েছে। এগুলোর মেয়াদ পর্যায়ক্রমে শেষ হবে। আর বিআটিএ এসব কাজ পর্যায়ক্রমে করে না একসাথে সব কাজ পেন্ডিং করে রাখে। ঘোষণা দিয়ে কাজ করতে গেলে হিতে বিপরিত হয়। সেজন্য বড় প্রেশার তৈরি হয়। এটা তাদের বড় দুর্বলতা। তবে এক সঙ্গে সব গাড়ি রাস্তা থেকে উঠিয়ে দিয়ে সঙ্কট দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসেবে বর্তমানে সড়কে চলাচল করা ৪০ দশমিক ৬৬ শতাংশ বাস ধ্বংসযোগ্য অবস্থায় রয়েছে। সারা দেশে স্ক্র্যাপযোগ্য বাস ও মিনিবাসের সংখ্যা ৩৩ হাজার ১৭৪। মোট ১ লাখ ৯৪ হাজার ৬০৩টি পণ্যবাহী গাড়ির মধ্যে স্ক্র্যাপযোগ্য ৩০ হাজার ৬২৩টি, যা ১৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
সারা দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৫৮ লাখের কাছাকাছি। এর মধ্যে বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ৮১ হাজার ৮৪৭। হিসাব করে দেখা যায়, বাস-মিনিবাসের প্রায় ৪১ শতাংশই ২০ বছরের পুরোনো। অন্যদিকে দেশে নিবন্ধিত ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও ট্যাংকলরির সংখ্যা দুই লাখ দুই হাজার ৭৭২টি। এর মধ্যে ২৫ বছরের পুরোনো ট্রাক ১৫ শতাংশের মতো। মে মাসের প্রজ্ঞাপন কার্যকর করলে দেশে প্রায় ৩৪ হাজার বাস এবং ৩১ হাজার ট্রাক ডাম্পিং করতে হতো। সে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। তবে শুরু থেকে প্রজ্ঞাপনটি বাতিল করে বাস-ট্রাকের আয়ুষ্কাল যথাক্রমে ৩০ বছর নির্ধারণের দাবি করে আসছেন মালিকরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলো সরকার।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, গণপরিবহনের নামে ৪০-৪৫ বছর আগে যে লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন কিংবা ২০ বছরের পুরনো রিকন্ডিশন্ড গাড়ি রুট পারমিটের অনুমতি পাচ্ছিলো না বা নবায়ন হচ্ছিলো না সেগুলো নবায়নের পথ সুগম হয়েছে। অথচ বাস ভাড়া নির্ধারণে অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ১০ বছর। প্রজ্ঞাপন বাতিলের মধ্যে দিয়ে ভয়ঙ্কর ঝুঁকিতে পড়লো নিরাপদ সড়ক তৈরির বিষয়টি। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে এটা প্রতিবন্ধকতারও সৃষ্টি করবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ গণমাধ্যমকে বলেছেন, সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় পুরোনো যানবাহনের বয়সসীমা নির্ধারণের আগে তাদের সঙ্গে কথা বলেনি। একসঙ্গে বিপুলসংখ্যক যানবাহন তুলে দিলে শূন্যতা তৈরি হবে। এর প্রভাব যাত্রী পরিবহন ও বাণিজ্যে পড়বে। এ জন্য তারা সরকারকে চিঠি দিয়ে সিদ্ধান্ত স্থগিত করার আবেদন করেছিলেন।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, বাস-ট্রাকের আয়ুষ্কাল পুননির্ধারণের জন্য কমিটি করা হয়েছে। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী ,সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইমেইল: [email protected], web:www.etihad.news
এম এম রহমান, প্রধান সম্পাদক, ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত