পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাস বরাবরই অস্থিতিশীল। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এলেও অনেকেই সেখানে টিকে থাকতে পারেননি। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে তাদের। পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী, সরকার গঠন করতে পুনরায় নির্বাচনের আগে দায়িত্ব হাতে নিতে হয় একজন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে। পাকিস্তানের নতুন এ পদ্ধতির ‘গোড়ায় গলদ’ শাসনামলটুকু বাদ দিলে দেশটির ইতিহাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন এ পর্যন্ত মোট সাতজন।
প্রেসিডেন্ট জিয়া ও গোলাম ইসহাক খান (মে-নভেম্বর ১৯৮৮)
জেনারেল জিয়া ১৯৮৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে নিজস্ব নীতি অনুসরণ করেছিলেন। নিয়ম লংঘন করে তিনি পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেন। প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ খান জুনেজোকে তার পদ থেকে অপসারণ করেন। জিয়া কোনো প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ না দিয়ে সরাসরি নিজের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ভেঙে যাওয়া মন্ত্রিসভা থেকে মন্ত্রীদের বহাল রাখেন তিনি। যদিও জুনেজোর অনুগতদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। জেনারেল জিয়ার এই সিদ্ধান্ত ছিল একটি বিতর্কিত ও অসাংবিধানিক পদক্ষেপ। একটি নির্বাচনের ঘোষণাও দিয়েছিলেন তিনি।
তবে ১৯৮৮ সালের আগস্টে একটি বিমান দুর্ঘটনায় জিয়ার মৃত্যু হয়। সাংবিধানিক প্রটোকল অনুসরণ করে সিনেটের চেয়ারম্যান সিনেট গোলাম ইসহাক খান ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের ভ‚মিকা গ্রহণ করেন। আর জিয়ার তত্ত্বাবধায়ক মন্ত্রিসভা বহাল রাখেন। ১৯৮৮ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের নতুন তারিখও ঘোষণা করেছিলেন তিনি। তার তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল বেনজির ভুট্টোর দল পিপিপি।
গোলাম মোস্তফা জাতোই (আগস্ট-নভেম্বর ১৯৯০)
পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন গোলাম মোস্তফা জাতোই। ১৯৯০ সালের আগস্টে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দেন। তার আগে ক্ষমতায় ছিলেন বেনজির ভুট্টো। দুর্নীতির অভিযোগে তাকে এই পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছিল।
জাতোই সে বছরের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত তার দায়িত্ব পালন করেন। সাধারণ নির্বাচনের পর পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন)-এর প্রধান নওয়াজ শরিফের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
বলাখ শের মাজারি (এপ্রিল-মে ১৯৯৩)
পাকিস্তানের দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন বলাখ শের মাজারি। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইসহাক খান ১৯৯৩ সালের ১৮ এপ্রিল নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেন। ১৯৯০ সালের সাধারণ নির্বাচনের তিন বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ১৯৯৩ সালে বলাখ শেরকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
মঈনুদ্দিন আহমেদ কোরেশি (জুলাই-অক্টোবর ১৯৯৩)
সেনাবাহিনীর মধ্যস্থতায় একটি চুক্তির অধীনে পিএলএম-এন নেতা নওয়াজ শরিফ ও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইসহাক খান ১৯৯৩ সালের জুলাইয়ে তাদের নিজ নিজ পদ থেকে পদত্যাগ করেন। চুক্তিতে স্বাক্ষরের আগে ইসহাক খান ১৯৯৩ সালের ১৮ জুলাই একজন পাকিস্তানি-আমেরিকান অর্থনীতিবিদ মঈনুদ্দিন আহমেদ কোরেশিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দেন। কোরেশির তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচনি প্রক্রিয়া তত্ত্বাবধানে সেনাবাহিনীর ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করেছিলেন। কোরেশি ও সেনাবাহিনীর যৌথ তত্ত্বাবধানে পাকিস্তানে ১৯৯৩ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় ক্ষমতায় আসে বেনজির ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পিপিপি দল।
মালিক মেরাজ খালিদ (নভেম্বর ১৯৯৬-ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭)
১৯৯৬ সালের নভেম্বরে পাকিস্তান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন জাতীয় পরিষদের সাবেক স্পিকার মালিক মেরাজ খালিদ। বেনজির ভুট্টোকে অপসারণ করে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফারুক লেঘারি তাকে নিয়োগ দেন। প্রায় তিন মাস তিনি এই পদে দায়িত্ব পালন করেন। তার তত্ত্বাবধানে ১৯৯৭ সালের সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেন নওয়াজ শরিফ।
মোহাম্মদ মিয়ান সুমরো (নভেম্বর ২০০৭-মার্চ ২০০৮)
পাকিস্তানের জেনারেল (অব.) পারভেজ মোশাররফের অধীনে প্রায় এক দশক স্বৈরশাসনের অধীনে ছিল পাকিস্তান। স্বৈরশাসনের একপর্যায়ে ২০০৭ সালের নভেম্বরে একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়। তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় আসেন তৎকালীন সিনেটের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মিযান সুমরো। এই পদে চার মাস দায়িত্ব পালনের পর পিপিপি দলের ইউসুফ রাজা গিলানির কাছে তিনি তার ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ২০০৮ সালের পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী দল ছিল পিপিপি।
মীর হাজার খান খোসো (মার্চ-জুন ২০১৩)
২০১৩ সালের মার্চে মীর হাজার খান খোসো পাকিস্তানে ষষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিযুক্ত হন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজা পারভেজ আশরাফের অধীনে পিএমএল-এন’র নেতৃত্বাধীন জাতীয় পরিষদের মেয়াদ শেষে ক্ষমতায় এসেছিলেন তিনি। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো খোসোকে নিয়োগ দিয়েছিল পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন (ইসিপি)। পাকিস্তান আইনের ২২৪-এ অনুচ্ছেদের অধীনে তিনি নিয়োগপ্রাপ্ত হন। সেসময় প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলের নেতা একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রার্থী নির্বাচনে ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করেছিলেন খোসো। ২০১৩ সালের জুনে সাধারণ নির্বাচনের পর তিনি তার দায়িত্ব নওয়াজ শরিফের কাছে হস্তান্তর করেন।
নাসির-উল-মুলক (জুন-আগস্ট ২০১৮)
প্রধানমন্ত্রী হিসাবে খাকান আব্বাসির সাংবিধানিক মেয়াদ হওয়ার ২০১৮ সালের ৩১ মে পাকিস্তানের পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ক্ষমতায় আসেন সাবেক প্রধান বিচারপতি নাসির-উল-মুলক। দায়িত্ব পালন করেন প্রায় দুই মাসের বেশি সময় ধরে। তার দায়িত্বে পাকিস্তানে ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয় পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ দল। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এই দলের চেয়ারম্যান ইমরান খান।
ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী ,সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইমেইল: [email protected], web:www.etihad.news
এম এম রহমান, প্রধান সম্পাদক, ইত্তেহাদ নিউজ, এয়ার পোর্ট রোড, আবুধাবী, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত