সৌন্দর্য হারাচ্ছে কুয়াকাটা


প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম আকর্ষণ ও জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাব দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া এবং সাগরের অস্বাভাবিক জোয়ারে এখন তছনছ। ভরা পূর্ণিমার প্রভাবে সৃষ্ট এ জোয়ারের প্রবল স্রোতে সৈকত লাগোয়া নয়নাভিরাম জাতীয় উদ্যান, পশ্চিমের লেম্বুর চর, গঙ্গামতি সংরক্ষিত বন ও খাজুরার বিনোদন স্থানগুলো হয়ে পড়েছে সৌন্দর্য। গত বৃহস্পতিবার সরেজমিন দেখা যায়, পাঁচ দিনের অস্বাভাবিক জোয়ারে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের তাণ্ডবে কুয়াকাটা সৈকতের বেলাভূমের উচ্চতা অন্তত এক মিটার কমে গেছে। জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে বালুর স্তর। উত্তাল ঢেউয়ের অব্যাহত তাণ্ডবে দীর্ঘ সৈকতের বেলাভূমি ধুয়ে এমনটি হয়েছে। এ ছাড়া তীব্র ঝড়ো হাওয়া ও প্রবল ঢেউয়ের আঘাতে সৈকতের ঝাউ বাগানসহ শত শত গাছপালা উপড়ে গেছে।
সরেজমিন আরো দেখা যায়, গত পাঁচ দিনে সাগরের ফুঁসে ওঠা জোয়ারে সৈকতে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য গর্ত। ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সৈকতের কোথাও জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটায় বিচের তিন-চার ফুট বালু ধুয়ে সৈকত অনেক নিচু হয়ে গেছে। প্রস্থ কমেছে ২০-২৫ ফুট। জায়গা দেবে গেছে। স্রোতের তোড়ে পুরো সৈকতই এখন এবড়ো খেবড়ো হয়ে আছে। এ অবস্থা এবারই শুধু দেখা দিয়েছে তা-ই নয়, কয়েক বছর ধরেই চলছে সৈকতে ভাঙনের খেলা। এতে সৈকতের পরিধি হয়ে যাচ্ছে সঙ্কুচিত। ট্যুরিজম পার্ক থেকে শূন্য পয়েন্টের পশ্চিম দিকের ১০০ মিটার পর্যন্ত সৈকত রক্ষায় জিওব্যাগ ও জিওটিউব স্থাপনের চলমান কাজেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জিও ব্যাগ ও জিও টিউব ঢেউয়ের ঝাপটায় সরে গিয়ে এবড়ো-খেবড়ো হয়ে গেছে। ফলে পর্যটকের বিচরণ ও গোসলের মূল জায়গা শূন্য পয়েন্টসহ দুই পাশের সৈকত শ্রীহীন হয়ে গেছে। পর্যটকের চলাচলে ঝুঁকি বেড়েছে। আর জোয়ারের সময় গোসল করতে গিয়ে অনেকে আহত হচ্ছেন।
স্থানীয় লোকজনের ভাষ্যানুযায়ী পাঁচ দিনে ১০ দফা জোয়ারে সৈকতের অন্তত ২০ ফুট স্থান সাগরে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে মসজিদ, মন্দির, দোকানসহ শতাধিক ছোট-বড় ধর্মীয় ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ক্রমেই ঝুঁকিতে পড়েছে খাজুরা, মাঝিবাড়ি, মিরাবাড়ি পয়েন্টের বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ। সাগরের ভাঙনের এমন ভয়াবহতায় উদ্বিগ্ন কুয়াকাটার বাসিন্দারা।
করিম উদ্দিন নামের একজন জেলে বলেন, ‘১০-১৫ বছর আগেও সৈকত কত্ত চওড়া আছেলে। আর অ্যাহন হেই সৈকত ভাঙতে ভাঙতে ছোড অইয়া যাইতেছে।’
ব্যবসায়ী মো. আবু সালেহ বলেন, ‘সাগর যেন কুয়াকাটাকে গিলে-গিলে খাচ্ছে। এভাবে ভাঙন অব্যাহত থাকলে আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে কুয়াকাটার মূল বাঁধই ভাঙনের কবলে পড়বে।’
পর্যটকদের অভিযোগ, এখন আর জোয়ারের সময় ওয়াকিং জোন থাকে না। নদীর পাড়ের মতো হয়ে যায়।
বিচ ঘেঁষা খুদে দোকানি স্বপন, ইদ্রিস ও আলতাফ হোসেন জানান, এবারের পাঁচ দিনের অস্বাভাবিক জোয়ারে দোকানের মধ্য থেকে পানির ঝাপটা গেছে।
ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটার সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল হোসেন রাজু জানান, এবারের জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটায় বিচের তিন-চার ফুট বালু ধুয়ে সৈকত অনেক নিচু হয়ে গেছে। প্রস্থ কমেছে ২০-২৫ ফুট। যদিও ফি বছর শূন্য পয়েন্টের এক-দেড় কিলোমিটার এলাকা জরুরি প্রতিরক্ষা প্রকল্পের মাধ্যমে জিও ব্যাগ ও জিও টিউব স্থাপনের মধ্য দিয়ে সাগরের ভাঙনের কবল থেকে সৈকত রক্ষার চেষ্টা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু সৈকতের চরম ঝুঁকিপূর্ণ বাকি অন্তত সাড়ে ১০ কিলোমিটার এলাকা অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে পাঁচ কিলোমিটার সৈকত তীব্র ভাঙনপ্রবণ এরিয়া হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে। এসব এলাকায় জোয়ারের সময় মূল সৈকত থাকছে না। জোয়ারে উত্তাল ঢেউয়ের তাণ্ডব সরাসরি বন্যানিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধে আঘাত করছে। ফলে চরম ঝুঁকিতে রয়েছে কুয়াকাটা পৌরসভাসহ লতাচাপলী এলাকার মানুষ ও তাদের সম্পদ। ঝুঁকিতে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা।
কলাপাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৪৮ নম্বর পোল্ডারের ১৭ দশমিক ২৫০তম কিলোমিটার থেকে ৩৭ দশমিক ২৫০তম কিলোমিটার পর্যন্ত বেড়িবাঁধের বাইরের দীর্ঘ ২০ কিলোমিটার মূলত কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত এলাকা নির্ধারণ করা রয়েছে। এর মধ্যে গঙ্গামিত লেকের ২৪ দশমিক ২৫০ তম কিলোমিটার থেকে আন্ধারমানিক নদী মোহনার ৩৪ দশমিক ৭৫০তম কিলোমিটার পর্যন্ত সাড়ে ১০ কিলোমিটার সৈকত সর্বাধিক ব্যবহৃত। যেখানে মূলত পর্যটকরা বিচরণ করেন। এই সাড়ে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে ২৭ দশমিক ৪০০ কিলোমিটার অংশ থেকে ৩২ দশমিক ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ৫ দশমিক এক কিলোমিটার সাগরের তীব্র ভাঙন এলাকা। তীব্র ভাঙনপ্রবণ এলাকার জিরো পয়েন্টের পশ্চিমে ৫০০ মিটার এবং পুবে দুই কিলোমিটার মোট আড়াই কিলোমিটার গ্রিন সি ওয়াল ও জিও টিউবের ব্যবহার মাধ্যমে ২০১৮ সালে সৈকত এলাকা রক্ষার সিদ্ধান্ত হলেও পরে তা বাতিল হয়ে যায়। ফলে অরক্ষিত হয়ে পরে কুয়াকাটা সৈকত। এরপর থেকে টানা কয়েক বছর জরুরি প্রতিরক্ষা প্রকল্পের মাধ্যমে সৈকতের শূন্য পয়েন্ট থেকে দুই দিকে জিও টিউব ও জিও ব্যাগ স্থাপন করে ভাঙন রোধের চেষ্টা চলছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী খালিদ বিন অলিদ জানান, বর্তমানে সৈকতে ঝুঁকিপূর্ণ অংশের মধ্যে এক হাজার ১০০ মিটার সাগরের তীব্র ভাঙনের কবল থেকে রক্ষায় এমন জরুরি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এক কোটি ৯৭ লাখ টাকা ব্যয় জিওব্যাগ ও জিওটিউব স্থাপনের মধ্য দিয়ে জরুরি প্রতিরক্ষায় এ কাজ চলমান রয়েছে। কিন্তু হঠাৎ পাঁচ দিনের টানা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় অস্বাভাবিক জোয়ারে উত্তাল ঢেউ ও সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে চলমান কাজের অনেক ক্ষতি হয়েছে। সৈকতের অন্ত এক মিটার বেলাভূমি ধুয়ে গেছে। অনেকটা নিচু হয়ে গেছে। তবে স্থায়ীভাবে প্রতিরক্ষায় প্রকল্প তৈরি করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে বলে জানালেন এই কর্মকর্তা।