এশিয়া সংবাদ

ব্রিকসের নতুন সদস্যদের তালিকায় বাংলাদেশ নেই কেন?

image 103572 1692761710
print news

বিবিসি বাংলা :

ব্রিকসের ১৫ তম বৈঠকে জোটটির সাথে বাংলাদেশের যুক্ত না হওয়ার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে অর্থনীতি এবং ভূ-রাজনীতির বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে আসছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।তবে বিষয়টিকে এখনই কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন না তারা। তারা বলছেন যে, প্রকৃত কারণ জানতে হলে আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।যদিও কেউ কেউ বলছেন, এবার সদস্যপদ দেয়ার ক্ষেত্রে কিছু বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছে। হয়তো সেসব বিষয়ে বাংলাদেশ তুলনামূলক পিছিয়ে থাকায় এ দফায় বাংলাদেশকে সদস্যপদ দেয়ার ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হয়নি।বৃহস্পতিবার ব্রিকস সম্মেলনের শেষ দিনে ছয়টি দেশকে এই জোটে যুক্ত হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। সম্মেলনের স্বাগতিক দেশ দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা বলেন, এসব দেশ হচ্ছে সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আর্জেন্টিনা, মিশর এবং ইথিওপিয়া।বাংলাদেশও এই জোটে যোগ দিতে পারে বলে এর আগে আভাস পাওয়া গেলেও নতুন ছয়টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই।সর্বশেষ নতুন সদস্য দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অন্তর্ভূক্ত না হওয়া নিয়ে এখনো কোন আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি বাংলাদেশ।ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২২শে অগাস্ট দক্ষিণ আফ্রিকা যান।এ বছর জুনের মাঝামাঝি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, অগাস্টে বাংলাদেশ আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট -ব্রিকসের সদস্য পদ লাভ করতে পারে।

যুক্ত না হবার সম্ভাব্য কারণ

দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়ে ব্রিকসে সম্মেলনের পাশাপাশি বুধবার চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পরে এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, “(চীন বলেছে) ব্রিকসে যখন আপনি যাতে আপনি জয়েন করতে পারেন, সেই জন্যে আমাদের সবসময় সমর্থন থাকবে।”পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বার্তা থেকে আশা তৈরি হয়েছিল, এবার হয়তো বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্যপদ পাবে। তবে বৃহস্পতিবার ব্রিকস সম্মেলনের শেষ দিনে জোটটিতে যোগ দিতে যেসব দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, সেখানে বাংলাদেশের নাম নেই।এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, প্রথমত ব্রিকসে যাদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তার মধ্যে সবগুলো দেশই অর্থনৈতিকভাবে সামনের দিকে অগ্রসরমান দেশ এবং এদের সবার অর্থনৈতিক অবস্থাই বাংলাদেশের তুলনায় ভাল।“আমরা তো এখনো এলডিসিভূক্ত দেশ হিসেবেই আছি। আর ব্রিকসে যারা আছে তাদের লেভেলটা তো আরেকটু উপরে।”

তাঁর মতে, বিকল্প একটা অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করার মতো সক্ষমতা রাখে এমন সব দেশকেই এবার ব্রিকসে যোগ দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

সেই জায়গায় বাংলাদেশ এখনো সে ধরণের ভূমিকা পালন করতে পারবে কিনা সে বিষয়টিও হয়তো বিবেচনায় নেয়া হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

“দ্বিতীয় কারণ হতে পারে যে আমরা সাম্প্রতিক কালে আগ্রহ দেখিয়েছি। কাজেই আগ্রহ দেখানো এবং তার জন্য মোবিলাইজেশন যেটা দরকার সেটা কতটুকু হয়েছিল সেটা ব্যাপার। আর আমার ধারণা সে কারণেই বিষয়টা হয়তো বিবেচনায় আসে নাই,” বলেন মি. কবীর।

তবে এবার ব্রিকসে যোগ দিতে না পারার বিষয়টিকে কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে দেখতে নারাজ সাবেক এই কূটনীতিক।

তিনি বলেন, “এটা ব্যর্থতা বলবো না। এটা বলতে পারেন যে, আমরা একটু বেশি প্রত্যাশা হয়তো করেছিলাম।”

“অথবা এটাকে আশাবাদ তৈরি করে একটা অবস্থান বা একটা ভাবমূর্তি তৈরি করার জন্য হয়তো চেষ্টা করা হয়েছিল যা বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না।”

চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, বাংলাদেশ বাদ পড়ার যথাযথ কারণ জানতে অপেক্ষা করা উচিত।

তাঁর মতে, এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, বাংলাদেশকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং বলা হয়েছিল যে, চারটি দেশকে যুক্ত করা হলে তার মধ্যে একটি বাংলাদেশ হবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা দেখা যায়নি।

“এর কারণ হতে পারে, তারা যে ক্রাইটেরিয়া বিবেচনায় নিয়েছে সেগুলোর সাথে হয়তো বাংলাদেশ ম্যাচ করেনি, পরবর্তীতে যখন তারা আবার অ্যাড করবে তখন হয়তো আসতে পারে। তবে এগুলো সবই ধারণা মাত্র।”

তবে এটিকে কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে দেখতে চান না তিনি।

তিনি বলেন, “সব কিছুতেই তো আর দিনে দিনে সাফল্য পাওয়া যায় না, অনেক কিছু আছে যেগুলোতে অনেক সময় লাগে।”

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন সম্প্রসারনের বিষয়টি কয়েক ধাপে আলোচনা হয়েছে।

“কোন সূচকের ভিত্তিতে নতুন সদস্য নেয়া হবে কি-না কিংবা কীভাবে গ্রহণ করা হবে। এসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে অর্থনীতির আকার ও জাতীয় মাথাপিছু আয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাই বলা যায় নতুন সদস্য নেয়ার ক্ষেত্রে পুরোপুরি ঐক্যমত না থাকলে একটি মাপকাঠি ছিলো,”  বলছিলেন তিনি।

মি. ভট্টাচার্য যে দুটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন এ দুটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের চেয়ে ইথিওপিয়া ছাড়া অন্যদেশগুলো, অর্থাৎ যাদের সদস্যপদ দেয়া হয়েছে তারা এগিয়ে।

বাংলাদেশের বাদ পড়াটাকে কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে দেখতে চান না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. নিলয় রঞ্জন বিশ্বাসও। তিনি বলেন, বাংলাদেশ নিজে থেকে এখানে আগ্রহ দেখিয়েছে বিষয়টি সেরকম নয়। বরং বাংলাদেশকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এবং সেখানে বাংলাদেশ ইতিবাচকভাবে সাড়া দিয়েছে।

“সেই কনটেক্সটে এটাকে ঠিক এখনই ফেইলিয়র বলাটা, অত্যুক্তি করা হয়ে যাবে। আরেকটু বোধ হয় এটা অ্যানালিসিস করতে হবে। ”

বাংলাদেশের বাদ পড়ার পেছনে এখনই কোন কারণ বোঝা সম্ভব নয় বলেও মনে করেন মি. বিশ্বাস। তিনি বলেন, এ বিষয়ে এখনই কোন মন্তব্য করার সময় আসেনি।

তবে যেসব দেশকে ব্রিকসে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে সেগুলো বিশ্লেষণ করার মতো বলে মনে করেন তিনি।

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, চীন যেসব দেশে সমস্যা মেটাতে মধ্যস্থতা করেছে সেসব দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। যেমন সৌদি আরব এবং ইরান। আবার ইথিওপিয়াতে চীনের বড় বিনিয়োগ রয়েছে।

এছাড়া আঞ্চলিক একটা ভারসাম্যও মাথায় রাখা হয়ে থাকতে পারে বলেও মনে করেন তিনি। যেমন, ছয়টি দেশের মধ্যে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ আমেরিকা- সব এলাকার দেশই রয়েছে।

ব্রিকস হল উদীয়মান অর্থনীতির পাঁচটি দেশ– ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং সাউথ আফ্রিকার প্রথম অক্ষরের সমন্বয়ে নামকরণ করা একটি জোট।
রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা

ভারতের গবেষণা প্রতিষ্ঠা অবজারভার ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী জনসংখ্যা, আয়তন এবং অর্থনৈতিক আকারের দিক থেকে ব্রিকস জোট বর্তমান বিশ্বের একটি বড় শক্তি।

২০১৪ সালের হিসেবে, ব্রিকসের পাঁচটি সদস্য দেশে প্রায় ৩২০ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ।

এই পাঁচ দেশ পৃথিবীর ২৫ শতাংশ এলাকা জুড়ে রয়েছে এবং বৈশ্বিক জিডিপি’র প্রায় ২৫ শতাংশও এ দেশগুলোর।

এমনকি বর্তমানে ব্রিকস সম্মিলিতভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ৪৩ শতাংশ (আট ট্রিলিয়ন ডলার) নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্বের যত পণ্যসেবা উৎপাদন হয় তার ২১ শতাংশ আসে এই পাঁচটি দেশ থেকে।

ব্রিকসের সদস্য দেশগুলো বেশ আগে থেকেই নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন, ব্রিকস মুদ্রা প্রবর্তন এবং নিজস্ব রিজার্ভের কথা বলে আসছে।

এটি কার্যকর হলে ব্রিকস দেশগুলো তাদের নিজেদের মুদ্রায় ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারবে। এতে ডলারে নির্ভরতা কমবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা।

তবে এই জোটে যোগ দেয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হচ্ছে জোটভুক্ত কিছু দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ততটা মসৃণ না।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ ডেস্ক :

About Author

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *