রাজনীতি

হাইব্রিড নেতাদের খোঁজে পুলিশ

neelavneel23 1459679205
print news

প্রায় পনেরো বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের হাইব্রিড নেতাদের অপকর্ম নিয়ে বিব্রত দলের হাইকমান্ড আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। এ জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে  পুলিশের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে বিভিন্ন সময় বিএনপি-জামায়াতসহ অন্য দল থেকে এসে পদ পেয়ে যাওয়া নেতাদের অপকর্ম নিয়ে দলের মধ্যেই সমালোচনা হয়েছে। কখনো কখনো তাদের হাইব্রিড আখ্যায়িত করা হয়েছে, কখনো ‘কাউয়া’র মতো শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।

ভোল পাল্টে অনুপ্রবেশ করা এসব নেতা আওয়ামী লীগ ও সরকারের দাপট দেখিয়ে ঢাকাসহ সারা দেশে নানা অপকর্ম করছেন। টেন্ডার-বাণিজ্য থেকে শুরু করে এমন কোনো অপরাধ নেই যা করছেন না তারা। তাদের কর্মকা-ে ক্ষুব্ধ সরকারের হাইকমান্ড। ১৪ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু সাজাপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাত্রলীগ, তাঁতী লীগসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সহানুভূতি প্রকাশ করে স্ট্যাটাস দিতে দেখা যাচ্ছে। এতে বিব্রত কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতারা।

শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সংগঠনটিতে অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করার কথা বলেন।

এর আগে আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।

এর ধারাবাহিকতায় অপকর্মে জড়িত হাইব্রিড নেতাদের বিরুদ্ধে পুলিশকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে দুই মাস আগে সরকারের হাইকমান্ড থেকে বলা হয়েছে।

নির্দেশনা পেয়ে পুলিশ সদর দপ্তর পুলিশের সব কটি ইউনিটকে আওয়ামী লীগের হাইব্রিড নেতাদের বিষয়ে খোঁজ নিতে বলেছে। ইতিমধ্যে গোয়েন্দা সংস্থা, মহানগর, জেলা ও থানা পুলিশ তালিকা করার কাজ শুরু করে দিয়েছে। ওই সব নেতার পাশাপাশি তাদের দলে প্রবেশের ব্যবস্থা ও সহায়তা যারা করে আসছেন, তাদেরও আইনের আওতায় আনার জন্য বলা হয়েছে।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ  বলেন, ‘অন্য দল থেকে যারা এসেছে, তারা নানা অপকর্ম করছে। আমাদের সফলতাগুলো তাদের কারণে নষ্ট হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে নীতিনির্ধারক ফোরামে আলোচনা হয়েছে। এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দেশ  বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বিশাল রাজনৈতিক দল। পনেরো বছর ধরে আমরা দেশ পরিচালনা করছি। দেশের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছেন। কিন্তু একটি চক্র উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। অশুভ চক্র দলের ভেতরে প্রবেশ করে নানা অপকর্ম করছে বলে আমরা তথ্য পাচ্ছি। তাদের চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে বলা হয়েছে।’

পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত আইজিপি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা  জানান, আওয়ামী লীগের হাইব্রিড নেতাদের চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সরকারের হাইকমান্ড থেকে একটি নির্দেশনা এসেছে। এ জন্য পুলিশের সব কটি ইউনিটকে বিশেষ বার্তা দেওয়া হয়েছে। বিএনপি, জামায়াতের অনেক নেতা তাদের পরিচয় গোপন করে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলোতে প্রবেশ করে নানা অপকর্ম করছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, এই হাইব্রিড নেতাদের সবধরনের সহায়তা করছেন আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা। তাদেরও আইনের আওতায় আনার কাজ চলছে। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, বরিশাল বিভাগের একটি জেলায় মঞ্জু মুসল্লি নামে এক হাইব্রিড নেতা একসময় বিএনপির রাজনীতি করতেন। কিন্তু ওয়ান-ইলেভেনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দলে যোগ দিয়ে নানা রকমের অপকর্ম করছেন। এখনো তার পরিবারের ১১ সদস্যের মধ্যে আটজনই বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করে আসছেন। অথচ তাদের দাপটে এলাকার লোকজন তটস্থ। এ রকম হাজার হাজার হাইব্রিড নেতা আছেন সারা দেশে। তাদের দ্রুত সময়ে চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেশ রূপান্তরকে জানান, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং দলটির সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোয় যেসব ‘অতিথি নেতা-কর্মী’ ঢুকে পড়েছেন, তাদের তালিকা তৈরির নির্দেশনা পেয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। নির্দেশনা পেয়ে এসব হাইব্রিড নেতার কর্মকা-, অতীতসহ বিস্তারিত তালিকা তৈরির কাজও শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

তারা বলছেন ২০১৯ সালে ক্যাসিনো ও টেন্ডারবাজদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযানের সময় হাইব্রিড নেতাদের বিষয়টি সামনে চলে আসে। যে দলই ক্ষমতায় থাকে ওই সব নেতা সেই দলে ঢুকে সুবিধা নিচ্ছেন। তারা টেন্ডার, চাঁদাবাজিসহ সব ধরনের অপরাধ করছেন। এসব নেতাকে বেশি লালন-পালন করছেন আওয়ামী লীগ বা যুবলীগেরই শীর্ষ নেতারা। মূলত তাদের আশকারা পেয়েই তারা বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে বিএনপি-জামায়াতের অনেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। কোথাও কোথাও ‘নব্য’ আওয়ামী লীগারদের কারণে ত্যাগী নেতা-কর্মীরা কোণঠাসা থাকার পাশাপাশি হামলা ও মামলার শিকার হচ্ছেন। আওয়ামী লীগের মূলধারার বাইরে থেকে মনোনয়ন নিয়ে যারা সংসদ সদস্য হয়েছেন, তারা বিভিন্ন দল থেকে লোক এনে দলের ভেতরে গ্রুপিং তৈরি করেছেন বলে পুলিশ তথ্য পেয়েছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডারবাজি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা বিষয় নিয়ে তাদের সঙ্গে মূলধারার নেতা-কর্মীদের বিরোধ তৈরি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, দেশের কোথাও কোথাও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা নিজেদের আধিপত্য বাড়াতে বিএনপি-জামায়াতের লোকদের দলে জায়গা দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য বা অবস্থান টিকিয়ে রাখতে আওয়ামী লীগে আশ্রয় নিয়েছেন। মূলত তারাই নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ড চালাচ্ছেন।

ডিএমপি ও জেলার কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, অনেক নাশকতা মামলার আসামিও আওয়ামী লীগেরই একশ্রেণির নেতার সঙ্গে আঁতাত করে দলে ঢুকে টেন্ডারবাজি, অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ নানা অপরাধ করছেন। ক্যাসিনো খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া একসময় ফ্রিডম পার্টি করতেন। জাতীয় পার্টির আমলে ছাত্র সমাজের রাজনীতি করেছেন। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে ওই দলে যোগ দেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে যুবলীগ দক্ষিণের সাবেক সভাপতি ক্যাসিনো ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের মাধ্যমে সাংগঠনিক পদ পর্যন্ত বাগিয়ে নেন। ঠিকাদার জি কে শামীম একসময় জাতীয় পার্টি এবং তারপর বিএনপি করেছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায়বিষয়ক সম্পাদক পরিচয়ে টেন্ডারবাজি করে কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সাবেক পরিচালক লোকমান হোসেন খালেদা জিয়ার আস্থাভাজন ছিলেন। অথচ তিনি গত ১৩ বছর আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আঁতাত করে অর্থ কামিয়েছেন। বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত সফিউদ্দিন মোল্লা পনুকে নিয়েও রাজধানীর আশকোনা ও দক্ষিনখান এলাকায় চলছে আলোচনা। একসময় তিনি বিএনপির রাজনীতি করলেও বর্তমানে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করছেন। তার আপন সম্বন্ধি পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন। পনুর অন্য স্বজনরাও বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃর্ক্ত। দক্ষিণগাঁওয়ের আরেকজন জামায়াত মতাদর্শী সুরুজ মিয়াও এখন আওয়ামী লীগের থানা কমিটিতে ঢোকার চেষ্টা করছেন বলে পুলিশের কাছে তথ্য এসেছে।

মাসখানেক আগে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে নির্দেশনা এসেছে জানিয়ে পুলিশের কর্মকর্তারা আরও বলেন, জেলা, উপজেলা, থানা, ইউনিয়ন পর্যায়ে যেসব নেতা ‘অতিথি পাখি’ হয়ে আওয়ামী লীগে প্রবেশ করেছে তাদের তালিকা করার কাজ শুরু হয়েছে।

পুলিশ সূত্র জানায়, কিছুদিন আগে গণভবনে আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় বলা হয়েছে, দলে হাইব্রিড এবং সুবিধাবাদীদের দাপটে প্রকৃত ত্যাগী নেতা-কর্মীরা কোণঠাসা হয়ে আছেন। আর এই কারণে তৃণমূলের সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে। একই কারণে বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ ও এবং তার অঙ্গ সংগঠনগুলোর মধ্যে বিরোধ চলে আসছে।

দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুর পর ফেসবুকে শোক জানিয়ে পোস্ট দেওয়ার কারণে এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগের ৬৬ নেতা-কর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার ও অব্যাহতি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তাদের মধ্যে জামালপুরে ১৮, চট্টগ্রামে ১৬, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৯, পাবনায় ৭, নরসিংদীতে ৬, সাতক্ষীরায় ৩ গোপালগঞ্জে ৬ ও যশোরে একজন ছাত্রলীগ নেতা রয়েছেন। তবে ফেসবুকে শোক প্রকাশ করা নেতার সংখ্যা আরও বেশি বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ ডেস্ক :

About Author

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *