অনুসন্ধানী সংবাদ

অনলাইনে চিপস বিক্রির নামে শত কোটি টাকা পাচার

online tk
print news

১০ কোটি চিপস কিনতে লাগবে ১৩০ টাকা। ২০ কোটি চিপস কিনলে ২৫০, ৩০ কোটিতে ৩৫০ টাকা দিতে হবে। পর্যায়ক্রমে ১০০ কোটি চিপস কিনতে লাগবে ১১০০ টাকা। ‘বস তিন পাত্তি ’ ‘রয়েল তিন পাত্তি’ জুয়া খেলার চিপস বিক্রি করতে ফেসবুকে রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে এসব দর তুলে ধরা হয়েছে। শুধু ফেসবুকে নয়, যে কোনো প্রয়োজনীয় অ্যাপ কিংবা ওয়েবসাইটে ঢুকলেই চোখে পড়ছে অনলাইনে ক্যাসিনো খেলার বিজ্ঞাপন। বিভিন্ন তারকাদের ছবি এডিট করে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে এসব বিজ্ঞাপন। মূলত বিদেশ থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এসব অ্যাপ ও ওয়েবসাইট। তবে দেশে থাকা বিভিন্ন এজেন্টদের সমন্বয়ে চিপস বিক্রির কাজটি করছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা ডিস্ট্রিবিউটর ও সাব-ডিস্ট্রিবিউটরগণ।

মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেই সবচেয়ে বেশি লেনদেন হচ্ছে এসব চিপস। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমেও পেমেন্ট করার সুযোগ রয়েছে। জনকণ্ঠের অনুসন্ধানে শতাধিক অ্যাপ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্যাসিনো অ্যাপই তৈরি করা হয়েছে শুধু বাংলাদেশের জন্য। যার মধ্যে বেশিরভাগই ১০ লাখের ওপরে ডাউনলোন করা হয়েছে। ব্যবহারকারীদের কাছে দিনে প্রায় ৩০-৫০ লাখ টাকার চিপস বিক্রি করা হচ্ছে। এভাবে মাসে পাচার হচ্ছে শত কোটি টাকা।
জানা গেছে, দেশে সরকারি দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু প্রভাবশালী লোকের ছত্রছায়ায় বিভিন্ন ক্লাবে আধুনিক ও পূর্ণাঙ্গ ক্যাসিনো গড়ে উঠেছিল। পুরোপুরি অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ক্যাসিনোগুলো ২০১৯ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে উচ্ছেদ করে। এর পরই মূলত ধীরে ধীরে অনলাইনে বিস্তার হতে শুরু করে বিভিন্ন জুয়ার সাইটগুলো। লেনদেনের মাধ্যম হচ্ছে ক্যাশবিহীন ব্যাংকিং লেনদেন (যেমন ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড ইত্যাদি) বা মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন (যেমন বিকাশ, রকেট, নগদ, উপায়, পেপাল ইত্যাদি) বা বিটকয়েনসহ অন্য যে কোনো ক্রিপ্টোকারেন্সি ইত্যাদি। কারণ, এতে সহজে ধরা পড়ার ভয় নেই। ক্যাসিনো বা জুয়া খেলায় সহজে টাকা আয় করা যায় প্রাথমিকভাবে।

এটিও জুয়ার প্রতি মানুষকে আকর্ষিত করার ফাঁদ। কয়েকবার স্বল্প পরিমাণে টাকা পেয়ে যারা জুয়া খেলেন, তারা লোভে পড়ে যান। কম পরিশ্রমে বেশি লাভের জন্য এরপর জুয়াড়িরা বেশি টাকা দেন জুয়ায়। যখন দেওয়া মূল টাকা ফেরত আসে না, তখন পরেরবার নিশ্চয়ই ফেরত পাব, এই আশায় আবার টাকা খরচ করেন তারা। পরবর্তী সময়ে সেই টাকাও না পেলে দিশেহারা হয়ে ওই টাকা ফেরত পাওয়ার আর কোনো উপায় না পেয়ে ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে বারবার টাকা দিতে থাকেন জুয়ায়।
জনকণ্ঠের দীর্ঘ অনুসন্ধানে গ্লোরি ক্যাসিনো নামে একটি অ্যাপ পর্যালোচনা করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, এই অ্যাপটি বাংলাদেশে ১৮ লাখের অধিক ডাউনলোড করা হয়েছে। অ্যাপের ভিতরে ৪ হাজারের অধিক গেমস রয়েছে। তবে যে কোনো গেম খেলতেই আগে টাকা ডিপোজিট করতে হয়। অ্যাপটিতে দেখা যায় কে কত টাকা ডিপোজিট করছে। এক ঘণ্টায় ৩ হাজারের অধিক ব্যক্তি ডিপোজিট করেছেন। সর্বনি¤œ ৪০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১৫০০ টাকা এক বারে ডিপোজিট করা যায়। মোবাইল ব্যাংকিং যেমন- বিকাশ, রকেট, নগদ ও উপায়ের মাধ্যমেই অর্থ ডিপোজিট করা যায়।

নগদের মাধ্যমে ডিপোজিট করতে গিয়ে দেখা যায়, এজেন্টের নাম প্রতিবারই পরিবর্তন হচ্ছে। শুরুতেই এসেছে এম এস মাহি ট্রেডিং করপোরেশন নামে একটি এজেন্টের নাম। এরপরে এসেছে তামিম এন্টারপ্রাইজ নামে একটি এজেন্টের নাম। এভাবে দ্য নিউ সোহাগ মটরস, আমিন এন্টারপ্রাইজ, দ্য স্টার লিমিটেড, বৈশাকি করপোরেশন, দিপু এন্টারপ্রাজের নাম আসে। এসব এজেন্টের বিস্তারিত তথ্য জানতে মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানি নগদকে ই-মেইল করা হলেও কোনো উত্তর আসেনি। ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেখে ক্রেতা পরিচয়ে রয়েল তিন পাত্তি চিপস কিনতে ০১৭৩৩২৯০৪৬৫ এই নম্বরে ফোন দিলে হাফিজ নামে এক ব্যক্তি এ প্রতিবেদককে জানান, বিকাশে টাকা দিলেই মিলবে কোটি কোটি চিপস। এ ছাড়া ক্যাসিনো লেভেলও পরিবর্তন করা যায়। আইডি ভিআইপি প্যাকেজ করা হয়।

জানালেন, ‘৫৫ কোটি চিপস একবারে কিনলে জেল থেকে বের হতে পারবেন। আপনার চিপস আনলক হয়ে যাবে।’ নিয়মিত গ্লোরি ক্যাসিনো অ্যাপে জুয়া খেলতেন মুরাদ হোসেন (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ‘প্রথমে আমি ৪০০ টাকা ডিপোজিট করি। শুরুতে আমি প্রচুর লাভ করতে থাকি। ক্যাসিনো লেভেল বাড়াতে আমি ডিপোজিও বাড়াতে থাকি। এভাবে ৪২ হাজার টাকা আমি ডিপোজিট করি। কিন্তু এক টাকাও লাভ করতে পারিনি। ক্যাসিনো হেরে একবার মোবাইলও ভেঙে ফেলেছিলাম।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে একটি অ্যাপ ডাউনলোড করেই মোবাইল ফোনে গেম বা জুয়া খেলতে পারছেন বাংলাদেশীরা। ফলে ঘরে বসেই সহজে জুয়ার আসরে যোগ দিচ্ছেন অনেকে। বাংলাদেশী জুয়াড়িদের কাছে অনলাইনে জুয়া বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। জুয়া খেলার অর্থ লেনদেন হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে। বিকাশ, রকেট, উপায় নগদসহ অন্যান্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জুয়াড়িরা অর্থ লেনদেন করে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন ক্রেডিট কার্ড। ফলে জুয়ার অর্থ সরাসরি চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। অনুসন্ধানে জানা যায়, অনেক ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে জুয়ার মুদ্রা কেনা হয়। স্থানীয় জুয়া এজেন্ট এমএফএস বিক্রয়কর্মীর সঙ্গে দেখা করে অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। এজেন্টরা চক্রের প্রধানের কাছে নগদ টাকা পৌঁছে দেয়। চক্রপ্রধান আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে টাকা বাইরের দেশে পাঠায়।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর (এমএফএস) প্রায় পাঁচ হাজার অবৈধ এজেন্ট রয়েছে। এসব এজেন্টের মাধ্যমে গত এক বছরে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। এজেন্টরা হুন্ডির মাধ্যমে এই টাকা পাচার করেছে। সম্প্রতি মাল্টার একটি অনলাইন গেমিং প্রতিষ্ঠানে ২০ জন বাংলাদেশীর এমএফএসের (মোবাইল ব্যাংকিং) নিবন্ধিত হিসাব খুঁজে পায় বিএফআইইউ। এসব হিসাবে এক বছরে প্রায় ৩৩ কোটি টাকা জমা হয় এবং প্রায় ২২ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়।

এ ছাড়া রাশিয়া থেকে পরিচালিত আরেকজুয়ার সাইট মোস্টবেট-এর সঙ্গে জবাংলাদেশী কয়েকজনের মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের লেনদের পর্যালোচনা করেছে বিএফআইইউ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৬ মাসের লেনদেনে দেখা যায়, প্রতিটি এমএফএস অ্যাকাউন্টে মাসে গড়ে ৫০ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক ও মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে ততোধিক চক্র বিভিন্ন সিক্রেট গ্রুপে জুয়ায় আসক্তদের যুক্ত করে। তা ছাড়া জুয়া পরিচালনাকারীরা বেকার যুবকদের অল্প সময়ে টাকা কামানোর লোভ দেখিয়ে তাদের সর্বস্ব লুটে নেয়। অবৈধভাবে ই-ট্রানজেকশনের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচারও করে জুয়া পরিচালনাকারীরা। বিশেষ করে আইপিএল, বিপিএল ও বিশ্বকাপের সময় এসব লেনদেন বেড়ে যায়। বেশিরভাগ জুয়া হয় ক্রিকেট ও ফুটবল নিয়ে। মানি লন্ডারিং নিয়ে সিআইডি কাজ করলেও অনলাইন জুয়াড়ি চক্রের বিরুদ্ধে র‌্যাবও মনিটরিং ও অভিযান পরিচালনা করে থাকে।
ওয়ার্ল্ড গ্যাম্বলিং মার্কেট রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে শুধু অনলাইন জুয়া বা গেমের বাজারমূল্য ছিল ৬৩৫৩ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২৩ সালে এর ব্যাপ্তি ১১.৭% বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে এবং এই অনলাইন জুয়ায় বাজারমূল্যের গ্রাফ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ এর সংবিধানে জুয়া খেলা নিরোধ করা হয়। সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বাংলাদেশের জুয়া প্রতিরোধে প্রচলিত আইনেও জুয়া খেলা অবৈধ। কিন্তু এ আইন ১৮৬৭ সালে অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলে প্রণীত এবং এতে সাজার পরিমাণও খুব নগণ্য।

পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট অনুযায়ী, যে কোনো ঘর, স্থান বা তাঁবু জুয়ার আসর হিসেবে ব্যবহৃত হলে তার মালিক বা রক্ষণাবেক্ষণকারী, জুয়ার ব্যবস্থাপক বা এতে কোনো সাহায্যকারী তিন মাসের কারাদ- বা অনূর্ধ্ব ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ে দ-িত হতে পারেন। এ রকম কোনো ঘরে তাস, পাশা, কাউন্টার বা যে কোনো সরঞ্জামসহ কোনো ব্যক্তিকে জুয়া খেলারত বা উপস্থিত দেখতে পাওয়া গেলে তিনি এক মাস পর্যন্ত কারাদ- বা ১০০ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-িত হতে পারেন। অর্থাৎ এই আইন শুধু প্রকাশ্য জুয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং দণ্ড বিধি বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে উপযোগী নয় বলেই পুলিশের মত। ২০১৯ সালে রাজধানীতে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে বিভিন্ন জুয়ার আসর থেকে শতাধিক ব্যক্তি আটক হলে আইনের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি তখন আলোচনায় আসে। তখন অবশ্য এই আইনে কোনো মামলা দেওয়া হয়নি। তবে ১৫৬ বছরের পুরনো আইন সংশোধন করে একে যুগোপযোগী করা জরুরি বলে জানিয়েছে পুলিশ।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ ডেস্ক :

About Author

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *