অনুসন্ধানী সংবাদ

ভুয়া মাস্টাররোল তৈরি দুই প্রকল্পের বরাদ্দের চাল বাস্তবায়ন কর্মকর্তা-সভাপতির পেটে

Project Cover NB
print news

 

দুই প্রকল্পের বরাদ্দের চাল বাস্তবায়ন কর্মকর্তা-সভাপতির পেটে ছোট যমুনা নদীর ধারে অবস্থিত ছেলেকালী শ্মশান ঘাটটি। নদীতে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে প্রায় ১ লাখ টাকার বালি ভরাট করা হলেও সেখানে প্রকল্পের কোনো সাইনবোর্ড নেই। ছবি: নিউজবাংলা
এ বিষয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) ময়নুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কিছু বলতে পারবো না। সংবাদ না করার অনুরোধ জানাচ্ছি।’

নওগাঁর বদলগাছী উপজেলায় গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কারের (কাবিখা) দুটি প্রকল্পে নামমাত্র লোক দেখানো কাজ করে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্প দুটির প্রায় ২০ টন চাল আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে প্রকল্পের সভাপতি ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে ভুয়া মাস্টাররোল তৈরি করে এসব চাল উত্তোলন করা হয়েছে।

জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিখা) কর্মসূচির আওতায় বদলগাছী উপজেলার নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক দ্বিতীয় কিস্তির ৭টি প্রকল্প অনুমোদিত হয়। পরবর্তীতে অনুমোদিত প্রকল্প কর্মসূচির ১ নম্বর প্রকল্প বদলগাছী সদর ইউনিয়নের ছেলেকালী শ্মশানঘাটে মাটি ভরাটের জন্য ১৫ টন ও ৬ নম্বর প্রকল্প আধাইপুর ইউনিয়নের বৈকণ্ঠপুরের মোকলেছ মুহুরীর বাড়ি থেকে পাকারাস্তা পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারের জন্য ৮ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। এই দুটি প্রকল্পের মোট বরাদ্দের পরিমাণ ২৩ টন চাল যার বাজার মূল্য ১১ লাখ ৪৪ হাজার ২০৮ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে গত জুন মাসে এই প্রকল্পগুলোর কাজের মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এ দুটি প্রকল্পের মধ্যে ১ নম্বর প্রকল্পে ২ টন ও ৬ নম্বর প্রকল্পে ১ টন চালের কাজ হয়েছে নামমাত্রে।

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, বদলগাছী সদর ইউনিয়নের ছেলেকালী শ্মশানঘাটটি ছোট যমুনা নদীর ধারে অবস্থিত। সেখানে ছোট যমুনা নদীতে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে প্রায় ১ লাখ টাকার বালি ভরাট করা হয়েছে। অথচ সেখানে কোনো প্রকল্পের সাইনবোর্ড পর্যন্ত নেই। এমনকি সরকারি কাজ সম্পর্কে জানেন না সেখানকার কোনো ব্যক্তি বা জনসাধারণের কেউ। প্রকল্পটি বরাদ্দ কত, তাও কেউ জানেন না।

 

ছেলেকালী শ্মশানঘাটের আশপাশে বসবাসরতদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘দেড় মাস আগে আমাদের ছোট যমুনা নদীতে অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে শ্মশানে কয়েকদিন বালি উত্তোলন করে ভরাট করা হয়েছে। সেখানে মোটামুটি ১ লাখ টাকার মতো বালি ভরাট করা হয়েছে বলে শুনেছি।

‘অপরদিকে গত ৬ এপ্রিল ছেলেকালী মন্দির ও মহাশ্মশানের সংস্কার কাজ শুরু করেছেন রজতকান্ত গোস্বামী। যারা শ্মশান সংস্কার কাজে আর্থিক সহযোগিতা করতে ইচ্ছুক, তাদের মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে যারা সহযোগিতা করেছেন তাদের সহযোগিতার পরিমাণসহ ২৬ জনের একটি তালিকা তিনি ফেসবুকে আপলোড করেন।’

রজতকান্ত গোস্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘মাস দেড়েক আগে আমরা এই চাঁদা তুলে শ্মশানের সীমানাপ্রাচীরসহ শ্মশানের বিভিন্ন সংস্কার কাজ করেছি।’

সেখানে তো সরকারি ১৫ টন চাল বরাদ্দ রয়েছে- প্রসঙ্গটি তুললে তিনি বলেন, ‘সেটি আমার জানা নেই। তবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ভগিরত আমাদের বলেছিল, তিনি কিছু মাটি কেটে দিবেন।’

এ বিষয়ে ছেলেকালী মন্দির ও শ্মশানের সভাপতি জীতেন্দ্রনাথ মণ্ডলের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা চাঁদা দিয়ে ওই শ্মশানঘাটের সংস্কারের কাজ করেছি।’

সেখানে সংস্কারের জন্য কাবিখার ১৫ টন চাল সরকারিভাবে বরাদ্দ করা হয়েছে, সেটি দিয়ে কী করেছেন?- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকারি বরাদ্দের কথা আমার জানা নেই। তবে আমার শ্যালক ভগিরত আমাদের বলেছিল কিছু বালি/মাটি দিয়ে জায়গাটি ভরাট করে দিবে। তবে সেখানে কত বরাদ্দ, সেটি আমি জানি না।’

আধাইপুর ইউনিয়নের বৈকণ্ঠপুর মোখলেছ মুহুরীর বাড়ি থেকে বৈকণ্ঠপুর পাকারাস্তা পর্যন্ত রাস্তা সংস্কারের কথা থাকলেও সেখানে গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। রাস্তা সংস্কারের কথা থাকলেও মোখলেছ মুহুরীর বাড়ি থেকে কাশিয়ারা ব্রিজ পর্যন্ত নামমাত্র কাজ করা হয়েছে। সেখানেও নেই কোনো সাইনবোর্ড। এলাকার জনগণ জানে না সেখানে বরাদ্দ কত।

কাশিয়ারা গ্রামের ওয়াহেদ আলী, ফরিদা, আশরাফুল ও বৈকণ্ঠপুর গ্রামের মোরশেদসহ প্রায় ২০-২৫ জনের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, দেড় মাস আগে ১০ জন শ্রমিক এসে মোখলেছ মুহুরীর বাড়ি থেকে কাশিয়ারা ব্রিজ পর্যন্ত ৭-৮ দিন ধরে রাস্তার যেখানে যেখানে গর্ত হয়েছিল, সেখানে মাটি দিয়ে পূরণ করেছে এবং রাস্তায় সামান্য কিছু মাটি দিয়েছে। এটুকু রাস্তা সংস্কার করতে সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা বা ১ টন চাল খরচ হওয়ার কথা।

ওয়াহেদ আলী বলেন, ‘যখন রাস্তার মাটি কেটেছিল, তখন ওই রাস্তা দিয়ে আমি ভ্যান গাড়িতে করে জৈব সার পরিবহন করে জমিতে নিয়ে যাই। তাহলে বোঝেন, এখানে কী রকম মাটি কাটা হয়েছে।

 

কাবিখা ১ নম্বর প্রকল্পের সভাপতি (পিআইসি) ছেলেকালী শ্মশান ঘাটের সাধারণ সম্পাদক বিভাষ কুমার অধিকারী বলেন, ‘আমি কিছুই জানি না। আমাকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শ্রী ভগিরত কুমার মণ্ডল প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিসে নিয়ে গিয়ে কয়েকটা কাগজে স্বাক্ষর করতে বলল, তাই আমি স্বাক্ষর করেছি।’

তাহলে কি ওই প্রকল্পের কাজ আপনি করেননি?- প্রশ্ন করলে তিনি ‘আমি পরে কথা বলব’ বলে ফোনটি কেটে দেন।

কাবিখা ৬ নম্বর প্রকল্পের সভাপতি (পিআইসি) উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ভগিরত কুমার মণ্ডল বলেন, ‘বৈকণ্ঠপুরের ওই রাস্তায় আমি ৭০ হাজার টাকার মাটি কেটেছি। আর অফিস খরচের জন্য আমার কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা কেটে নিয়েছে। তাহলে আমি কী কাজ করব? আমাকেও তো লাভ করতে হবে।’

আপনার ওই প্রকল্পের রাস্তা সংস্কারের কথা ছিল বৈকণ্ঠপুর মোখলেছ মুহুরীর বাড়ি থেকে বৈকণ্ঠপুর পাকারাস্তা পর্যন্ত কিন্তু, আপনি রাস্তা সংস্কার করেছেন মোখলেছ মুহুরীর বাড়ি থেকে কাশিয়ারা ব্রিজ পর্যন্ত। পুরো রাস্তা করলেন না কেন?- প্রশ্ন করলে কোনো উত্তর দিতে পারেননি তিনি।

বদলগাছী ছেলেকালী শ্মশান ঘাটে মাটি ভরাট প্রকল্পটিও নাকি আপনি করেছেন?- প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘এই প্রথম এমপি সাহেব আমাকে এ দুটি প্রকল্প দিয়েছে। ওই প্রকল্পের সভাপতি বিভাষ কুমার অধিকারী। তবে কাজটি আমি করেছি।’

প্রকল্পটিতে ছোট যমুনা নদী থেকে অবৈধভাবে ড্রেজার মেশিন দিয়ে নামমাত্র প্রায় ১ লাখ টাকা বা ২ টন চাল খরচ করে বালি ভরাট করে দিয়েছেন?- প্রশ্নেরও কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।

অপরদিকে আধাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ.কে.এম. রেজাউল কবির পল্টন বলেন, ‘ওই রাস্তায় এর আগে চল্লিশ দিনের কর্মসূচির লোক দিয়ে মাটি কাটা হয়েছিল।’

এ বিষয়ে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) ময়নুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কিছু বলতে পারবো না। সংবাদ না করার অনুরোধ জানাচ্ছি।’

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ ডেস্ক :

About Author

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *