স্বাস্থ্য

বাকেরগঞ্জে জাহানারা ক্লিনিক এন্ড ডায়গনস্টিক সেন্টারের রমরমা ব্যবসা, ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু

baker 1
print news

সংবাদদাতা,বাকেরগঞ্জ, বরিশাল।

বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলায় বাস স্ট্যান্ড বিআইপি কলোনি সংলগ্ন বাকেরগঞ্জ বরগুনা আঞ্চলিক সড়কের পাশে ২০১১ সালে গড়ে ওঠে জাহানারা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার।২০১৩ সালে ক্লিনিকটি যৌথ ব্যাবসায়িক চুক্তিনামা করে ২০ জন অংশীদার মালিক হয়।

বরিশাল শের- ই -বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরকারি চাকরি করছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় ডাক্তার এস এম মনিরুজ্জামান শাহীন অধ্যক্ষ পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ, সহকারি অধ্যাপক অর্থো- সার্জারি ডা:মো: খাদেমুল ইসলাম, সহকারি অধ্যাপক চর্ম ও যৌন ডা: কামরুজ্জামান, সহকারি অধ্যাপক (ফরেনসিক বিভাগ) ডা:মো:রেফায়তুল হায়দার, সহকারী অধ্যাপক ডা: নজরুল ইসলাম নিউরোলজি শেরে -বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সরকারি বেতন-ভাতাও পাচ্ছেন ঠিকঠাক। এখন এই সরকারি চিকিৎসকরা রীতিমতো মালিক হয়ে জাহানারা ক্লিনিক এন্ড ডায়গনস্টিক সেন্টারের ব্যবসাও করছেন। আর সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকেই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এসব ক্লিনিক এন্ড ডায়গনস্টিক সেন্টারের। নিজেরা মালিকানার ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে ডা: নজরুল ইসলামের কন্যা সাইয়ারা রাখশান্দা মাহেরু, ডা: কামরুজ্জামান শাহিন এর স্ত্রী মেহেরুন আফরোজ, ডাক্তার রেফায়তুল এর স্ত্রী কামরুন নাহার অনি, ডা. মনিরুজ্জামান এর মা রাশিদা বেগম, ডা.মো: খাদেমুল ইসলামের স্ত্রী বিসিএস ক্যাডার ডা. শার্মিন আক্তার কে ক্লিনিক ভবনের চুক্তিপত্র সহ মালিকানা দেখানো হয়েছে। আর ডাক্তারেরা রয়েছেন জাহানারা ক্লিনিক এন্ড ডায়গনস্টিক সেন্টারের পরিচালনা পরিষদে। তাদের প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা রোগী দেখার চেম্বার রয়েছে ওই ক্লিনিকে।

দীর্ঘ ১০ বছর এই ক্লিনিকে থেকে কমিশন বাণিজ্য সরকারি ডাক্তারদের যেন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাহানারা ক্লিনিক এন্ড ডায়গনস্টিক সেন্টার থেকে আসা এই কমিশন বাণিজ্যে গা ভাসিয়ে কতিপয় চিকিৎসক এতোটাই বেপরোয়া হয়ে পড়েছেন যে, একেকজন রোগীর জীবন যেন তাদের কাছে একেকটি টাকার মেশিন। অর্থাৎ রোগীর জীবন যতোটা ঝুঁকিতে পড়তে থাকবে তাদের কমিশনের মাত্রাও ঠিক সেই হারে বাড়তে থাকবে। এখন পর্যন্ত এমনই ঘটনার বলি হয়েছেন বাকেরগঞ্জ পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ রুনসী গ্রামের মোঃ হারুন খলিফার কন্যা শিল্পী বেগম। সিজারিয়ান অপারেশনের সময় জাহানারা ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসা মৃত্যুবরণ করেন। সাম্প্রতিক সময় পাদ্রীশিবপুর ইউনিয়নের খ্রিস্টান পাড়ার বৃদ্ধ রেমাঙ্গ গোমেস বাক প্রতিবন্ধী পা ভেঙ্গে ডা.মো: খাদেমুল ইসলামের কাছে চিকিৎসা দিতে আসলে তার ভাঙ্গা পা রেখে ভালো পায়ে ব্যান্ডেজ করে দেয়। ডা.রেফায়তুল হায়দারের বিরুদ্ধে রয়েছে ব্যাপক অভিযোগ তিনি বাকেরগঞ্জে শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসেবে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছেন। আর এই পরিচয়ে উপজেলা সাধারণ মানুষ অসুস্থ হলে তাদের শিশুকে নিয়ে যান জাহানারা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। রোগী পেলেই নিজেদের ইচ্ছেমতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা টেস্ট বাণিজ্য ও পাশাপাশি নিজেদের মনগড়া চিকিৎসা পত্র দিয়ে থাকেন রোগীদের। সহকারি অধ্যাপক (ফরেনসিক বিভাগ) ডা.মো:রেফায়তুল হায়দার, ফরেনসিক বিভাগের ডাক্তার হয়ে জাহানারা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চেম্বার খুলে রোগী দেখার নামে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।

১১ সেপ্টেম্বর সরজমিনে জাহানারা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে  সংবাদ মাধ্যম গেলে দেখতে পায়। ডিএমএফ ডাক্তার বনি আমিন আবাসিক মেডিকেল অফিসার পরিচয়ে এক শিশুর পায়ে মচকে যাওয়া স্থানে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে। ওই শিশুটির চিকিৎসা বাবদ ফি নিয়েছেন ৪০০ টাকা। একজন ডিএমএফ চিকিৎসার নামে প্রতারণা করে প্রতিমাসের লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে, ডিএমএফ ডাক্তার বনি আমিন প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজারকে ফোন করে এবং সাংবাদিকদের ক্যামেরা দেখে গা ঢাকা দেয়।

সপ্তাহের শুক্রবার ও নির্ধারিত সময়ে এমবিবিএস ডাক্তার তাদের চেম্বারে বসেন। এছাড়া ওই ক্লিনিকে রোগী আসলে তাদেরকে চিকিৎসা দেয় ডিএমএফ ডাক্তার ও নার্স, ক্লিনারেরা। একাধিক ভুক্তভোগী পরিবারের সাথে কথা হলে তারা জানান, বছরের পর বছর ধরে ডাক্তার ছাড়া চিকিৎসা দিয়ে আসছে জাহানারা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। রোগী গেলেই তাদেরকে বিভিন্ন রকমের টেস্ট করিয়ে ২০০০ টাকা থেকে শুরু করে ৩০০০ টাকা নিয়ে নেয়। চিকিৎসা নামে টেস্ট বাণিজ্য এখন জাহানারা ক্লিনিকে নিয়মে পরিণত হয়েছে। ভুক্তভোগীরা দুর্নীতিবাজ ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, একশ্রেণির দালাল ও সরকারি হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে সিন্ডিকেট করেই এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। এই ক্লিনিকে ১ জন এমবিবিএস আবাসিক ডাক্তার ও ৬ জন নার্স থাকার কথা থাকলেও শুধু দুই জন নার্স রয়েছেন ডাক্তার নেই।আবার গাইনি বিশেষজ্ঞ না থাকলেও অন্য ডাক্তার দিয়ে সিজার করানো হচ্ছে। এ কারণে তৃণমূলে ৫০ শতাংশ সিজার হচ্ছে ত্রুটিপূর্ণ। এসব ত্রুটিপূর্ণ সিজারের কারণে মা ও শিশু উভয়ের জীবন পরবর্তী সময়ে বিপন্ন হয়ে পড়ে। বেঁচে থাকলেও স্বাভাবিক জীবনে তাদের ফিরে আসার সম্ভবনা কম বলে গাইনি বিশেষজ্ঞরা জানান। সরকারি ডাক্তারদের ক্লিনিক বাণিজ্যের অর্থ লেনদেন হয়েছে বাকেরগঞ্জ ইসলামী ব্যাংক ও জনতা ব্যাংকের শাখায়। জনতা ব্যাংক বাকেরগঞ্জ শাখায় ব্যাংক স্টেটমেন্টে দেখা যায়, ডাক্তার মো: কামরুজ্জামান, ডা.মো:রেফায়তুল হায়দার ও ডা.মো: মনিরুজ্জামান শাহিন জাহানারা ক্লিনিক এন্ড ডায়গনিক সেন্টারের নামে বিগত বছরগুলোতে লাখ লাখ টাকা লেনদেন করেছেন। যাহার অ্যাকাউন্ট নম্বর -০১০০০৪৩৮৩২৫৯৫৪। এছাড়াও ডা.মো: খাদেমুল ইসলাম বাকেরগঞ্জ শাখার ইসলামি ব্যাংকে জাহানারা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার এর নামে অ্যাকাউন্ট থেকে বিগত বছরগুলোতে লেনদেন করেছেন। যাহার অ্যাকাউন্ট নম্বর -৩৮৫। এছাড়াও প্রত্যেক ডাক্তার তাদের চেম্বারে কোম্পানি থেকে পাওয়া স্যাম্পল ঔষধ ২ মাস পর পর খোলা বাজারে পাইকারদের কাছে বিক্রয় করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

এ বিষয়ে সহকারি অধ্যাপক অর্থো- সার্জারি ডা.মো: খাদেমুল ইসলামের কাছে জানতে ফোন করা হলে তিনি জানান, আমরা জাহানারা ক্লিনিকের মালিকানা আছি। তিনি স্বীকার করে বলেন, আমার স্ত্রীর নাম দেওয়া হয়েছে মালিকানায়।

এ বিষয়ে জানতে চাও হয় ডাক্তার শারমিন আক্তারের কাছে, তিনি সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কথা বলতে অনিচ্ছু। অন্য ডাক্তারদের কাছে ফোন করা হলে কেউ ফোন রিসিভ করেনি।

এ বিষয়ে বরিশাল সিভিল সার্জন ডাক্তার মারিয়া হাসান জানান, সরকারি হাসপাতালের কর্মকর্তা হয়ে বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকানা থাকা বিধানে নেই। জাহানারা ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার এর বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ ডেস্ক :

About Author

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *