অনুসন্ধানী সংবাদ

অনুমোদনহীন কারখানায় মানহীন মশার কয়েলে অতিরিক্ত কেমিক্যাল : স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভোক্তারা

তাড়াতে নিম্নমানের কয়েলের পেছনে ছুটছে মানুষ 3
print news

ঢাকাসহ সারাদেশেই বেড়েছে মশার উৎপাত। রাত দিন সব সময়ই মানুষের সঙ্গী হয়েছে মশা। মশার কামড়ের যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে কয়েল ও ইলেক্ট্রিক ব্যাট সহ অ্যারোসল স্প্রে ব্যবহার করেও মশাকে প্রতিহত করা যাচ্ছে না। যতটুকু সময় মশারির ভেতর সময় কাটছে সেই সময়টুকুও যেনো বাইরে পাহারা দেয় মশা। মশার যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের প্রধান অবলম্বন কয়েল। কিন্তু সেখানে ভেজাল ঢুকায় দিন দিন অসহায়ত্ব বাড়ছে মানুষের। বাজারে নিম্নমানের মশার কয়েল ও মানহীন ইলেক্ট্রিক ব্যাট ছড়িয়ে পড়ায় সাধারণ মানুষ টাকা খরচ করেও কোনো প্রতীকার পাচ্ছেন না।

জানা গেছে, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) মশা নিধনে ১০৩টি কোম্পানিকে অনুমোদন দিলেও বাজারে প্রায় কয়েকশ মশার কয়েল উৎপাদনকারী কোম্পানি আছে। অর্থ্যাৎ অনুমোদনের তুলনায় অনুমোদনহীন মশার কয়েলে বাজার ছেয়ে গেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ) মশার কয়েলে সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক তিন (০.৩) মাত্রার ‘একটিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট’ ব্যবহার নির্ধারণ করেছে। এই মাত্রা শুধুমাত্র মশা তাড়াতে কার্যকর, মারতে নয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অনুমোদনহীন ব্যবসায়ীমহল কর্তৃক প্রস্তুত ও বাজারজাতকৃত কয়েলে শুধু মশাই নয়, বিভিন্ন পোকামাকড়, তেলাপোকা এমনকি টিকটিকি পর্যন্ত মারা যায়! বর্তমানে চীন থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কয়েল আমদানি করা হচ্ছে। এসবেও একই অবস্থা। সূত্র বলছে- এই আমদানিতেও নেই যথাযথ অনুমোদন। বালাইনাশক অধ্যাদেশ- (পেস্টিসাইড অর্ডিন্যান্স ১৯৭১ ও পেস্টিসাইড রুলস ১৯৮৫) অনুসারে, মশার কয়েল উৎপাদন, বাজারজাত ও সংরক্ষণে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অনুমোদন বাধ্যতামূলক। অধ্যাদেশ অনুযায়ী- অধিদপ্তরের অনুমোদন পাওয়ার পর পাবলিক হেলথ প্রোডাক্ট (পিএইচপি) নম্বর ও বিএসটিআই’র অনুমোদন নিয়েই সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে বালাইনাশক পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করার কথা। কিছু অসাধু কোম্পানির প্যাকেটের গায়ে কয়েলে ব্যবহৃত কেমিক্যালের পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নির্দেশিত অনুমোদিত মাত্রার উল্লেখ থাকলেও এসব কয়েলে প্রকৃতপক্ষে কেমিক্যাল অনেক বেশিমাত্রায় ব্যবহারের কারণে তাদের তৈরি কয়েলের ধোঁয়ায়ও মশা, তেলাপোকাসহ অনেক কীট-পতঙ্গই মরছে যদিও তারা বিএসটিআই কর্তৃক অনুমোদিত। এ বিষয়ে বিএসটিআই কর্তৃপক্ষের তদারকিতে অবহেলার অভিযোগ করেন কয়েকটি কয়েল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিরা। অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিএসটিআইয়ের অনুমতি তালিকার বাইরে বাজারে- সুপার ডিসকভারি, প্যাগোডা গোল্ড, তুলসীপাতা, সেফগার্ড, লিজার্ড মেগা, বস সুপার, টাটা হাইস্পিড, মেট্রো, সুপার জাদু, মারুফ পাওয়ার ম্যাজিক, সোলার, মাছরাঙা মেঘা, বাংলা কিলার, হান্টার, বিচ্ছু, চমক, সুপার যাদু, রকেট, সুপার যাদু ব্র্যান্ডের কয়েল অবাধে বিক্রি হচ্ছে। এসব কয়েলের গায়ে ঢাকা, ভৈরব কিংবা চট্টগ্রাম লেখা থাকলেও পূর্ণাঙ্গ কোনো ঠিকানা নেই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসিআইসহ মশার কয়েল উৎপাদনকারী কয়েকটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাজারে বেশির ভাগ কয়েলই সঠিক প্রক্রিয়ায় মান নিয়ন্ত্রিত ও অনুমোদিত নয় এবং বিষাক্ত কেমিক্যাল যুক্ত যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এ ধরনের মারাত্মক ক্ষতিকর কয়েল উৎপাদন ও বাজারজাত করছে ৩০/৩৫টি দেশি বেনামি কারখানা। ভুয়া পিএইচপি নম্বর ও বিএসটিআই’র লোগো ব্যবহার করে আকর্ষণীয় মোড়কে এসব কয়েল বাজারে ছাড়া হচ্ছে। এছাড়া বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে উচ্চমাত্রার একটিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট সম্পন্ন চায়না কয়েল। দেশের বাজার এসব কয়েলে সয়লাব হলেও সংশ্লিষ্টদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, অনুমোদনহীন কয়েলে ‘একটিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট’ (কেমিক্যাল) যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে ক্যান্সার, শ্বাসনালীতে প্রদাহসহ বিকলাঙ্গতার মতো ভয়াবহ রোগ হতে পারে। এমনকি গর্ভের শিশুও এসব ক্ষতির শিকার হতে পারে। খাদ্যে ফরমালিন ও পানিতে আর্সেনিকের প্রভাব যেমন দীর্ঘমেয়াদি, তেমনি এসব কয়েলের বিষাক্ত উপাদান মানুষের শরীরে দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগের বাসা তৈরি করছে।

মুদির দোকানে বিভিন্ন কোম্পানির মশার কয়েল বিক্রি করছেন মিজানুর রহমান। তিনি আরটিভি নিউজকে বলেন, এলাকায় মশা বাড়ায় কয়েলের ব্যবসা জমজমাট। গত দুই মাস আগেও যেখানে দিনে পাঁচ থেকে ছয় প্যাকেট কয়েলের প্যাকেট বিক্রি করতে পারেননি সেখানে বর্তমানে দিনে ত্রিশ থেকে চল্লিশ প্যাকেট কয়েল বিক্রি করেন।

কোন কোম্পানির মশার কয়েল বেশি বিক্রি হচ্ছে জানতে চাইলে মিজানুর রহমান বলেন, এসিআই মশার কয়েল গুণগত মান ভাল হলেও গ্রাহকরা পপুলার, টাইগার, সুপার পাওয়ারসহ বিভিন্ন কোম্পানির মশার কয়েল বেশি কিনছেন। এসিআই মশার কয়েল বিএসটিআইয়ের অনুমোদন রয়েছে কিন্তু গ্রাহকদের চাওয়া যে কয়েলে বেশি মশা মরবে সেই কয়েল চায়। নিম্নমানের মশার কয়েলে শারীরিক সমস্যা হলেও গ্রাহকরা দোকানে এসে বলেন যে কয়েলে বেশি মশা মরবে তাই দেন। নিম্নমানের কয়েল বাজারে চাহিদা থাকায় বেশি বিক্রি হচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজার থেকে আনা বিভিন্ন কোম্পানির মশার কয়েল জ্বালিয়ে মশা তাড়ানো সম্ভব হয় না। আবার কিছু মশার কয়েল আছে, যেগুলো জ্বালানোর পর মশার সঙ্গে ঘরের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা তেলাপোকা ও টিকটিকি মরছে। কারণ মশা মারতে বাজারে যেসব কয়েল কোম্পানির নাম দেখা যায়, সেগুলোর অধিকাংশ বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনে (বিএসটিআই) অনুমোদন নেই। নিম্নমানের মশার কয়েলে বাজার সয়লাভ। যা মানুষের ফুসফুসে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লিভারের রোগী বাড়ছে। গর্ভের শিশুও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

বিএসটিআইয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে বসবাসরত মানুষ সচেতন হওয়ায় মশার কয়েল কেনার ক্ষেত্রে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন দেখেন। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের মানুষ মশার কয়েল কেনার আগে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন রয়েছে কিনা সেটি লক্ষ্য করেন না। ফলে ঢাকার তুলনায় গ্রামাঞ্চলে অসাধু ব্যবসায়ীরা নকল মশার কয়েলে রমরমা ব্যবসা করেন। ঢাকার তুলনায় গ্রামাঞ্চলে বেশি নকল মশার কয়েলেও আমদানি করা হয়। কারণ অসাধু ব্যবসায়ীরা গ্রামের সহজ-সরল মানুষের সুযোগ নিয়ে নিম্নমানের মশার কয়েলে সয়লাভ করেন। এজন্য গ্রামের বাজারগুলোতে বিএসটিআইয়ের অনুমোদনকৃত মশার কয়েলের তুলনায় নিম্নমানের মশার কয়েল বেশি পাওয়া যায়। আর এসব নিম্নমানের কয়েল বিক্রি হচ্ছে প্রচুর।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ ডেস্ক :

About Author

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *