অনুসন্ধানী সংবাদ

ওসিরা বেপরোয়া : মনমতো পোস্টিং পেতে গুনতে হয় টাকা : সমালোচনার ঝড়

salo 1697582846
print news

নিজস্ব প্রতিবেদক :

হঠাৎ করেই বেপরোয়া হয়ে উঠছেন এক শ্রেণির মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা। বিশেষ করে থানার অফিসার ইনচার্জের (ওসি) দায়িত্বে থাকা পুলিশ পরিদর্শকরা সেদিক থেকে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। মোটা অঙ্কের ঘুষ, চাঁদাবাজি ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ঘটনায় এরই মধ্যে কয়েকজন ওসির বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। যাদের অন্যতম হলেন-গাজীপুরের পুবাইল থানার ওসি শফিকুল ইসলাম, শায়েস্তাগঞ্জ থানার ওসি নাজমুল হক কামাল ও চারঘাট থানার ওসি মাহবুবুল আলম। আসামির পরিবার ও সোর্সের মাধ্যমে বিভিন্ন জনের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা চাঁদাবাজি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে । এ ছাড়াও সম্প্রতি চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানায় পুলিশ হেফাজতে দুদকের এক কর্মকর্তার মৃত্যুর ঘটনায় হত্যার অভিযোগে সোমবার আদালতে সংশ্লিষ্ট থানার ওসি খায়রুল ইসলামসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এসব ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ হলেও এর বাইরেও অনেক অপকর্ম রয়েছে বলেও মনে করেন বিশ্লেষকরা।

 

1697564941 ef9f3128b44caf3881a67fb79510d53e

জানা গেছে, পুলিশ সদর দফতর থেকে ঊর্ধ্বতনরা বরাবরই মাঠ পর্যায়ে নাগরিক সেবা সমুন্নত করতে তাগিদ দিয়ে যাচ্ছেন। গতকাল মঙ্গলবারও পুলিশ সদর দফতরে আয়োজিত ক্রাইম কনফারেন্সে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, ‘থানাকে পুলিশের সেবা প্রদানের প্রধান প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার জন্য কাজ করতে হবে। পুলিশ সদস্যদেরকে আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে।’ অথচ কোনো তাগিদ-নির্দেশনায় যেন তোয়াক্কা করছেন না এক শ্রেণির দুর্নীতি-অপকর্মগ্রস্ত পুলিশ কর্মকর্তারা। তবে এমন ‘অন্ধকার’ চিত্রের বাইরে আবার অনেক মানবিক ও সেবাধর্মী ওসি বা পুলিশ সদস্যও রয়েছেন। যারা বরাবরই পুলিশ বাহিনীর সুনাম উজ্জ্বল করে চলেছেন। কিন্তু বেপরোয়া ও অপকর্মে জড়িত ওসিসহ এমন কিছু পুলিশ সদস্যের অপকর্মে মøান হয়ে যাচ্ছে পুলিশের ভালো কাজের সুনাম।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের গণমাধ্যম শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইনামুল হক সাগর  বলেন, কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে বাংলাদেশ পুলিশ তা সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে থাকে। অপরাধে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে বিভাগীয় ব্যবস্থাসহ কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পুলিশ সবসময় জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করে থাকে।

জানা যায়, টঙ্গীর কেরানিরটেক বস্তির মাদক ব্যবসায়ী রুনা বেগমকে মামলা থেকে রেহাই দেওয়ার কথা বলে ৪ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের পুবাইল থানার ওসি শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে। গত ১ অক্টোবরের একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, সোর্স হৃদয় বলছে ‘স্যার পুরাটাই পাইছি’। এ কথা শোনার পর ওসি বলেন, চলে এসো, তাড়াতাড়ি চলে এসো’। তবে পুবাইল থানার ওসি শফিকুল ইসলাম বলেন, ওই কণ্ঠ তার নয়। আর সোর্স হৃদয়কেও তিনি চিনেন না।

গত ১০ অক্টোবর শারদীয় দুর্গাপূজা ও কমিউনিটি পুলিশিং-ডে উপলক্ষে নাশতা, পানীয় ও ফলমূল সরবরাহ বা আপ্যায়ন খরচ বাবদ চাঁদা দাবি করে তিনটি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেন শায়েস্তাগঞ্জ থানার ওসি নাজমুল হক কামাল। স্কয়ার ডেনিমস লিমিটেড, প্রাণ-আরএফএল ও তাফরিদ কটন মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বরাবর খরচগুলোর কথা উল্লেখ করে প্রত্যেকের কাছে সাড়ে ৩ লাখ টাকা চাওয়া হয়। ওই ঘটনায় ওসি কামালকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহীর জেলা পুলিশ সুপারের নাম ভাঙিয়ে এক আসামির স্ত্রীর কাছে ৭ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেছিলেন চারঘাট থানার ওসি মাহবুবুল আলম। সেই ঘুষ দাবির অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। অডিওতে শোনা যায়, শুধু ঘুষই নয়, তিনি ওই নারীকে মাদকের কারবার করার পরামর্শ দেন এবং নির্বিঘেœ কারবার চালানোর কথাও বলেন। ওসি বলেন, ‘এক মন্ত্রী ছাড়া কারও কথা শুনতে আমি এখানে আসিনি। তিনি আমাকে গাইবান্ধা থেকে এখানে নিয়ে এসেছেন।’ ওই ঘটনায় চারঘাট থানার ওসি মাহবুবুল আলমকে পুলিশ লাইনে প্রত্যাহার করা হয়েছে। একই সঙ্গে ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এ ছাড়াও চট্টগ্রামের চাদগাঁও থানায় পুলিশ হেফাজতে দুদকের সাবেক কর্মকর্তা মোহাম্মাদ শহীদুল্লাহর মৃত্যুতে ওসিসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা, নারায়ণগঞ্জের জমি-সংক্রন্ত ঘটনায় থানায় নিয়ে নির্যাতন করায় সাবেক ওসি মোরশেদ আলম ও সেকেন্ড অফিসার এসআই সাধন বসাকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। গত ২ জানুয়ারি বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনে (ক্র্যাব) এক সংবাদ সম্মেলনে একজন ভুক্তভোগী জুলেখা বেগম অভিযোগ করেন, মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানার ওসির সরাসরি সহযোগিতায় সন্ত্রাসী, হত্যা চেষ্টা ও ডাকাতি মামলাসহ কয়েক মামলার আসামি সালাম এলাকায় তাণ্ডব চালায়।

এভাবেই নানা অপকর্মে হঠাৎ বেপরোয়া হয়ে উঠছে এক শ্রেণির থানা অফিসার ইনচার্জরা (ওসি)। একের পর এক লোমহর্ষক ও বিতর্কিত ঘটনারও জন্ম দিচ্ছেন তারা। জানমাল রক্ষার পরিবর্তে ওসিরা এখন ভক্ষক-ভীতির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এতে সরকারের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে ব্যাপকভাবে। জনমনে প্রশ্ন, বেপরোয়া এই ওসিদের রুখবে কে?

বিশ্লেষকরা বলছেন, ওসিদের বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়-এ রকম বহু অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর কোনো সুরাহা হয় না। ঘটনা একেবারে হাতেনাতে প্রমাণ হলেও পুলিশের বিরুদ্ধে শাস্তি বড়জোর ক্লোজ করা কিংবা চাকরি হেড অফিসে ন্যস্ত করা কিংবা অন্য কোথাও বদলি করা। সবচেয়ে বড় শাস্তির কথা শুনি, সাসপেন্ড করা। কিন্তু সাসপেন্ড তেমন কিছুই নয়, সাময়িক বরখাস্ত। এসব কারণে ওসিরা এখন একেবারেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সময়ের আলোকে জানান, ওসিরা কোনো না কেনোভাবে সরকারের মদদপুষ্ট। এ রকম ঘটনা ডজন ডজন। একটি মনমতো পোস্টিং পেতে তাদের ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা খরচ হয়। তার ওপর থাকে এক থেকে দেড় বছরের মাথায় আবার বদলি। পোস্টিংয়ের খরচা উঠাতেই তাদের সময় চলে যায়, জনসেবা করবে কখন।

এ প্রসঙ্গে সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল‍্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক  বলেন, মন্ত্রণালয়ের জবাবদিহিতার দুর্বলতা, পুলিশ প্রশাসনে দলীয়করণের মাত্রা বেড়ে যাওয়া, অভ্যন্তরীণ গ্রুপিং এবং চেইন অব কমান্ড দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে এ জাতীয় অপরাধ-প্রবণতা বেড়ে গেছে। যারাই ক্ষমতায় আসছে তারাই পুলিশকে অপব্যবহার করছে। আবার পুলিশকে দলের অঙ্গ সংগঠনও মনে করেন অনেকে। পেশাগত পরিচয়ের চেয়ে দলীয় পরিচয়টা বেশি বড় করে দেখেন তারা। এসব অপরাধ কমাতে হলে পুলিশকে দলীয়করণমুক্ত করতে হবে। ওসিদের সততা, নিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আর যারা অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

এ বিষয়ে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক  বলেন, ওসিরা সততা, নিষ্ঠা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এটা অস্বীকার করছি না। তবে কিছু ক্ষেত্রে মিথ্যা ঘটনাও ঘটানো হচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পুলিশ কোনো ধরনের অপরাধের সঙ্গে আপস করে না। অপরাধের প্রমাণ মিললে সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

 

* দেশ  বিদেশের  সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি প্রকৃতি আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়
সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ ডেস্ক :

About Author

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *