সমাধান হতে পারে আলাপ-আলোচনা আর সংলাপের মাধ্যমেই
 
                                
আমীন আল রশীদ : বছর দশেক আগে হরতালের দিন ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় করা মামলায় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য শেখ রবিউল আলমসহ দলটির অঙ্গসংগঠনের আরও ১০ জনকে আড়াই বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গত ৩০ অক্টোবর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত এই রায় দেন। এই রায়ের অর্থ হলো, শেখ রবিউল আলমসহ যে ১০ জন সাজাপ্রাপ্ত হলেন, তাদের কেউই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। শেখ রবিউল রাজধানীর ধানমণ্ডি এলাকা থেকে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী।এর আগে গত ২৫ অক্টোবর পুরনো দুটি মামলায় যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক আলী সরকারসহ বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের ২৫ নেতা-কর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন ঢাকার সিএমএম আদালত। এছাড়া চলতি মাসে তিনটি মামলায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এম শাহজাহান, দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিবসহ ২৫ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন একই আদালত। তার মানে এই নেতাদের মধ্যেও যারা আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থী ছিলেন, তাদের কেউই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। কেননা সম্প্রতি হাইকোর্টের একটি রায়ে বলা হয়েছে, দুর্নীতি মামলায় ২ বছর সাজা হলেই তিনি নির্বাচনে অযোগ্য। বলা হচ্ছে, এই রায়ের অর্থ হলো, শুধু দুর্নীতির মামলা নয়, বরং যেকোনও ফৌজদারী মামলায় ন্যূনতম দুই বছর সাজা হলেই তিনি নির্বাচনে অযোগ্য। যদিও এর আগে নিম্ন আদালতে সাজাপ্রাপ্তরা উচ্চ আদালতে আপিল করে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। এ বছর সেই সুযোগ থাকছে না বলে অনেকেই মনে করছেন। যদি তা-ই হয় তাহলে এবার বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলেও দলটির অসংখ্য নেতা, যাদের প্রার্থীর হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, তারা ভোটে অযোগ্য বিবেচিত হবেন। ফলে বিরাট সংখ্যক সম্ভাব্য প্রার্থী নির্বাচনে অযোগ্য হলে বিএনপি ওই নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা—সেটি বিরাট প্রশ্ন।
এরকম বাস্তবতায় গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে সহিংসতার পরদিন রবিবার সকালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেফতার করা হয়। দুদিন পরে মঙ্গলবার গ্রেফতার করা দলে স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস এবং যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে। এদিন ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দাবি করেন, হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ছয় দিনে তাদের দলের চার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।রাজধানীর ফকিরাপুল এলাকায় বিএনপির সঙ্গে সংঘর্ষে পুলিশ সদস্য নিহতের ঘটনায় পল্টন থানায় করা মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন। শোনা যাচ্ছে, দলের আরও একাধিক সিনিয়র নেতা গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও বলেছেন, ‘বিএনপির নেতারা হয় জেলে না হয় পালিয়ে থাকবে।’ প্রশ্ন হলো, দেশের অন্যতম প্রধান এবং ক্ষমতার রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির সিনিয়র ও গুরুত্বপূর্ণ নেতারা যদি জেলে কিংবা পালিয়ে থাকেন, তাহলে তারা কী করে নির্বাচনে আসবে? এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশন কিংবা সরকারের তরফে যদি কোনও সংলাপ বা আলোচনারও উদ্যোগ নেওয়া হয়, সেখানেই বা বিএনপি কী করে অংশ নেবে?দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুই আড়াই মাস আগে ক্ষমতাসীন দলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের এভাবে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে সরকার আসলে কী বার্তা দিচ্ছে? বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচন? যদি তাই হয় তাহলে সেই নির্বাচন কি অংশগ্রহণমূলক হবে? নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে এবং একটি অন্যতম প্রধান দল নির্বাচনে না এলে কিংবা আসতে না পারলে সেই নির্বাচন কি দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে? যদি না হয় তাহলে বিগত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো আরও একটি খারাপ নির্বাচনের উদাহরণ তৈরি হবে।যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে; যেভাবে বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে—তাতে শেষমেষ তাদের নির্বাচনে আসা এখন পর্যন্ত অনিশ্চিত। আবার এটিও শোনা যায় যে, বিএনপি চায় নির্বাচন না হোক। কারণ তাদের দলের ভেতরে নেতৃত্বের কোন্দল রয়েছে। যে কারণে তারা হয়তো চায় নির্বাচন না হোক এবং আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কেউ ক্ষমতা গ্রহণ করুক—যাতে তারা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে পারে। কিন্তু সময়মতো নির্বাচন না হলে তার পরিণতি কী হয়, সেটিও দেশবাসীর অজানা নয়। অতএব আগামী দিনগুলো দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ২৮ অক্টোবরের সহিংসতাপরবর্তী পরিস্থিতি যেদিকে মোড় নিচ্ছে, তাতে জানুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে কিনা, জনমনে সেই প্রশ্নও রয়েছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, ‘সময়মতোই নির্বাচন হবে। কে চোখ রাঙাল আর কে চোখ বাঁকাল, তা নিয়ে পরোয়া করি না।’
ব্রাসেলসে ‘গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরাম’ সম্মেলনে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা জানাতে মঙ্গলবার বিকালে গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বিএনপির সঙ্গে সংলাপের সম্ভাবনাও নাকচ করে দেন।জানুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে একই অবস্থান প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালেরও। গত ৩১ অক্টোবর মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচন করা ছাড়া নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কোনও বিকল্প নেই। পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, ইসিকে যথাসময়ে নির্বাচন করতে হবে।এখানে সিইসির এই ‘পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন’ শব্দগুলো গুরুত্বপূর্ণ। তার মানে নির্বাচন কমিশনও হয়তো ধারণা করছে যে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। যদি সত্যিই পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় তখন নির্বাচন হলে সেটি দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য হবে কি? নাকি নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ইসি এবং সরকার খুব একটা চিন্তিত নয়? তারা কি ভাবছে যে, যেকোনও পরিস্থিতিতে নির্বাচন সম্পন্ন করে ফেললে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে? জনমনে শঙ্কা এখানেই যে, যদি সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে পরিস্থিতি আাপতত নিয়ন্ত্রণ করে নির্বাচন সম্পন্ন করে নতুন করে সরকার গঠন করেও ফেলে, তারপরে কী হবে? দেশের অর্থনীতির ওপর কোনও বিদেশি চাপ তৈরি হবে? যদি হয় তাহলে সেটি মোকাবিলা করার মতো সক্ষমতা রয়েছে কিনা?এইসব বাস্তবতা মাথায় রেখে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যাতে সংঘাতপূর্ণ হয়ে না ওঠে এবং যতটুকু হয়েছে সেটি যাতে আর প্রলম্বিত না হয়, সেজন্য সরকারের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি বিরোধী দলগুলোরও। যেকোনও মূল্যে ক্ষমতায় থাকা এবং যেকোনও উপায়ে ক্ষমতা থেকে নামানোর এই খেলায় যদি সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়, তার দায় কেবল বিরোধীদের নয়, সরকারকেও নিতে হবে। এবারও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব না হলে সেটি জনজীবনে খারাপ প্রভাব ফেলবে তাতে সন্দেহ নেই। তার চেয়ে ভয়াবহ হবে যদি বিএনপি, জামায়াত এবং ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমে যায়। সরকারদলীয় নেতাকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন মিলে সেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে গেলে বড় ধরনের সংঘাত হবে কিনা—সেই শঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তাহলে সমাধান কী? সব সময়ই যে কথাটি বলা হয় তা হলো, সব পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা আর সংলাপের মাধ্যমেই সমাধান হতে পারে। কিন্তু বিএনপির সঙ্গে যে আওয়ামী লীগের কোনও সংলাপ হবে না, সেটি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়েই প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন। তাছাড়া আলোচনা বা সংলাপের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বড় কোনও রাজনৈতিক সংকটের সমাধান হয়েছে—তারও নজির নেই। অতএব আগামী জানুয়ারির মধ্যে হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে যাবে এবং টানা চতুর্থবারের মতো শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হবে, অন্যথায় নির্বাচন বানচাল হয়ে যাবে, যা দেশকে নতুন সংকটের দিকে ঠেলে দেবে। এর মাঝামাঝি কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কম।
লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
 
         
        



 
                         
                            