বিপিসির এ টি এম সেলিমের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ


চট্টগ্রাম অফিস : দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক অনুসন্ধানে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) এ টি এম সেলিমের অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ মিলেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে একটি ছয়তলা বাড়ি, রাজধানীর বনানী ও গুলশানে তিনটি ফ্ল্যাটের তথ্য পাওয়া গেছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিপিসির জিএম সেলিমের বিরুদ্ধে জমা হওয়া অভিযোগের প্রাথমিক তদন্তে কিছু তথ্যপ্রমাণ পাওয়ার পর পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধানের জন্য দুদকের সহকারী পরিচালক মো. রাজু আহমেদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি ব্যাংক, বীমা ও সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন দপ্তরের চিঠি পাঠিয়ে তথ্য জোগাড়ের পাশাপাশি যাচাই-বাছাই করছেন।
দুদকের তথ্যমতে, চলতি বছরের ২২ মার্চ বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (জিএম) এ টি এম সেলিমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে শত-কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ জমা পড়ে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে জালিয়াতির মাধ্যমে বিপিসিতে চাকরি নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পর গত ৮ মে অনুসন্ধান শুরু করে সংস্থাটি। এ অভিযোগটি অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দুদকের চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়-১ এর সহকারী পরিচালক মো. রাজু আহমেদকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি অনুসন্ধানের স্বার্থে গত ৩০ আগস্ট সেলিমের তথ্য-উপাত্ত চেয়ে ব্যাংক, বীমা, সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি পাঠান। ওই চিঠিতে সেলিম, তার স্ত্রী সুলতানা দিল হাসনাত ও দুই সন্তানের নামে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য সাত কর্মদিবসের মধ্যে দুদকে পাঠানোর জন্য বলা হয়।
সেলিমের নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ১০ ফ্ল্যাট থাকার কথা বলা আছে অভিযোগে। অভিযোগে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের ফয়’স লেক আবাসিক এলাকায় তিনি বিলাসবহুল একটি ছয়তলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। হাজি আবদুল হামিদ রোডের ২/এ নম্বর ওই ভবনটি তিনি স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন। সাত কাঠা জমির ওপর নির্মাণ করা বাড়িটির নাম তার শাশুড়ি জ্যোৎস্নার নামে রাখা হয়েছে। এছাড়া তার রাজধানী বনানীর ৯/এ নম্বর ভবনে, গুলশান-১ এর ২৩ নম্বর রোডে, গুলশান-২ এর ৪২ নম্বর রোডে ফ্ল্যাট রয়েছে। ধানম-ির ২৭ নম্বরে ফ্ল্যাট থাকার অভিযোগ থাকলেও সে ব্যাপারে পুরো তথ্যপ্রমাণ এখনো মেলেনি। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ায় সেলিম তার বন্ধু আবদুল করিমের মাধ্যমে সেখানে বাড়ি কিনেছেন।
সেলিমের চাকরি পাওয়া নিয়েও অভিযোগ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিপিসি ১৯৯৯ সালে চারজন সহকারী ব্যবস্থাপক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। নিয়োগ বোর্ড পরীক্ষার মাধ্যমে সংস্থাটির হিসাব বিভাগে চারজনকে নিয়োগ দেয়। নিয়োগ পাওয়ার তিন মাসের মাথায় মো. মনিরুল ইসলাম নামের একজন চাকরি ছেড়ে আগের কর্মস্থল সিলেট গ্যাস ফিল্ডে যোগদান করেন। একটি পদ শূন্য হওয়ার পর সেলিমের চাচা বিপিসির তৎকালীন কোম্পানি সচিব কামাল উদ্দিন সংস্থার পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপক পদে এ টি এম সেলিমকে নিয়োগ দেন। এ ক্ষেত্রে নিয়মনীতি মানা হয়নি বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
মোংলা অয়েল ইনস্টলেশন প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগও আছে বিপিসির জিএম সেলিমের বিরুদ্ধে। তিনি এ প্রকল্পের সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন। প্রকল্পটির আরডিপিপি (সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) অনুযায়ী, অনুমোদিত ব্যয় ছিল ২০৫ কোটি ৪৬ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। কিন্তু খরচ দেখানো হয়েছে ২০৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। অনুমোদন থেকে অতিরিক্ত ৪ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করায় ২০২০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি অডিট আপত্তি দিয়েছে অডিটকারী প্রতিষ্ঠান খান ওয়াহাব শফিক রহমান অ্যান্ড কোম্পানি। প্রকল্পের শুরুতে ৫০ শতাংশ অগ্রগতি দেখিয়ে ম্যাক্সওয়েল ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস ও পাইপলাইন লিমিটেডকে বিল দেওয়ার বিষয়টি উঠে আসে অডিট রিপোর্টে। অডিটকালে প্রকল্পের অনেক বিল-ভাউচারের হদিস পাওয়া যায়নি। এছাড়া প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার বছর না পার হতেই অফিস ও আবাসিক ভবনের বারান্দায় ফাটল দেখা দেয় বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
এছাড়া বিপিসির অধীনস্ত প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ আছে সেলিমের বিরুদ্ধে। প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা নয়-ছয় করা হয়েছে। জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ধানি জমির একরপ্রতি মূল্য ৩ লাখ ও পানের বরজ থাকা জমির মূল্য একরপ্রতি ৬৩ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। অধিগ্রহণকালে ধানি জমিকে পানের বরজ দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এর মধ্যে ৯৬ লাখ ৬০ হাজার টাকার বেশি লোপাটের তথ্য দুদকের হাতে রয়েছে। ২০২০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ঘুষের টাকা ভাগাভাগির সময় ৬৬ লাখ ৭৫ হাজার ৫৫০ টাকাসহ একজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এ ঘটনার সঙ্গেও এ টি এম সেলিম জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ আছে, স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েলে দুর্নীতি বন্ধে বিপিসিতে অটোমেশনের উদ্যোগ নিলে সেলিম চক্রের বাধার কারণে সেটি থেমে যায়।
জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে পরীক্ষা ছাড়াই বিপিসিতে চাকরি পান এটিএম সেলিম ।বিপিসি সূত্র জানিয়েছেন, এটিএম সেলিমের চাচা কামাল উদ্দিন ছিলেন বিপিসির প্রভাবশালী কর্মকর্তা। যাকে স্থানীয়রা ডিসি কামাল বলেই জানেন। কামাল উদ্দিন প্রথমে বিপিসি সচিব ও পরে পরিচালক পদেও দায়িত্ব পালন করেন। তার আর্শীবাদে পরীক্ষা ছাড়াই নিয়োগ পেয়ে যান এটিএম সেলিম।
এটিএম সেলিম যোগদানের পর থেকে বেপরোয়া দুর্নীতি করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগের সূত্র ধরে এটিএম সেলিমের বেপরোয়া দুর্নীতির তথ্য সামনে আসতে শুরু করেছে। দুদকে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে, সংস্থার হিসাব ও স্বার্থ রক্ষার কথা থাকলেও বরাবরই ব্যক্তিগত হিসেবটাই এটিএম সেলিমের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেয়েছে।
চান্দগাঁও থানার খালাসী লেকের বিপরীত দিতে ৪ ইউনিটের ৬ তলা বিশিষ্ট বিশাল একটি ভবনের মালিক। নগরীর চকবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে নামে বেনামে একাধিক দোকান। শুধু চট্টগ্রাম নয় দুর্নীতির টাকায় এটি এম সেলিমের সম্পদের সম্রাজ্য গড়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকাতেও।
বিপিসির রন্ধে রন্ধে থাকা দুর্নীতি বন্ধে অটোমেশনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া থামিয়ে রেখেছে এটিএম সেলিম চক্র। অটোমেশন হলে দুনীর্তি লুটপাট অনেকাংশে বন্ধ হয়ে যেতো। বিশেষ করে তেল বিক্রি ও মজুদ এক ক্লিকেই দেখা যেতো। তাতে করে অধীনস্থ কম্পানিগুলো (পদ্মা, মেঘনা, যমুনা) ব্যাংকে টাকা ফেলে রেখে ব্যক্তিগত সুবিধা নিতে পারত না। যেভাবে বিপিসি খ্যাত, অখ্যাত (ক্রেডিট রেটিংয়ের নিচে থাকা) ব্যাংকে কয়েক হাজার কোটি টাকা জামানত রেখে কমিশন পেয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠানের সদরদপ্তর চট্টগ্রামে আর তহবিল রাখা হয়েছে একটি ব্যাংকের উত্তরা শাখায়, কেনো কিসের জন্য সে প্রশ্নের উত্তর সবার জানা।
সরকার যখন জ্বালানি সাশ্রয়ের কথা বলছে, তখনও বেপরোয়া এটিএম সেলিম। অফিসের গাড়িটি সারাদিন পারিবারিক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। সকালে তাকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে চলে যায় ছেলে- মেয়েকে স্কুলে আনা নেওয়ার জন্য। দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েটি কখনও চট্টগ্রাম ক্লাবে, কখনও র্যাডিসন হোটেলে সাঁতার কাটতে যায়। বিগত কয়েকমাস মাস ধরে চলছে সেই রুটিন। মেয়ের সাতার শেখার ফাঁকে স্ত্রীকে দোকানে আনা নেওয়া করে এ গাড়ি। গাড়ির মাইল মিটার এবং অফিসের সিসি ক্যামেরার রেকর্ড যাচাই করলেই এসব ধরা পড়বে।
নিজের পকেট ভারি করতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিপিসিকে ঠেলে দিয়েছেন লোকসানের দিকে। ব্যাংকে কয়েক হাজার কোটি টাকা আমানত থাকা অবস্থায় (এসএনডি ও এফডিআর) প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন ব্যাংক ঋণ নিয়ে। এতে দেখা গেছে, আমানতের বিপরীতে প্রাপ্ত সুদের চেয়ে ঋণের বিপরীতে পরিশোধিত সুদের পরিমাণ ২৭৮ কোটি টাকা বেশি। অর্থাৎ ঋণ না নিয়ে নিজেদের আমানত থেকে বিপিসির একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে ২৭৮ কোটি টাকা সাশ্রয় হতো। সবকিছু জেনেও শুধু নিজের মুনাফার ধান্দায় সেই কাজটি করে বিপিসিকে ডুবিয়েছেন এটি এম সেলিম। এই দুর্নীতির বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছে জাতীয় সংসদের সরকারি প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি। ২৩আগস্ট বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি আসম ফিরোজ সাংবাদিকদের বলেন, বিপিসিতে অনেক ঘাটতি রয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি কম। তাদের অনিয়মের চিত্র দেখে কমিটি ‘শকড’ (স্তম্ভিত)। বিভিন্ন কেনাকাটা ও নিরীক্ষায় যেসব আপত্তি এসেছে, তাদের সেগুলো সমন্বয় করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারা কিছুই করেনি।
*গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news