ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের গ্রেপ্তার রিমান্ড ও মনোনয়ন


শহীদুল্লাহ ফরায়জী : একজন ব্যারিস্টার, একজন বীর উত্তম, সাবেক সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী এবং ৭৬ বছর বয়স্ক প্রবীণ সম্মানিত নাগরিক শাহজাহান ওমর। তিনি নিজ হাতে বাসে আগুন দিতে পারেন তা সারা পৃথিবীর তাবৎ মানুষ বিশ্বাস না করলেও সরকার করেছে। জনগণের কাছে, আদালতের সামনে তাকে সন্ত্রাসী হিসেবে উপস্থাপিত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের এই রাষ্ট্রে একজন ‘বীর উত্তম’কে হয়রানিমূলক মামলায় গ্রেপ্তার এবং রিমান্ডের অসম্মান- মূলত সমগ্র মুক্তিযুদ্ধকেই রিমান্ডে নেয়ার নামান্তর। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের এবং নক্ষত্রসম উচ্চতার বীরদের জীবন সায়াহ্নে এত অমর্যাদা ও অসম্মান করা কি রাষ্ট্রের জন্য জরুরি ছিল? এই মাটিতে কি আর ভবিষ্যতে কোনো বীরের জন্ম হবে!শাহজাহান ওমরের ওপর চরম অন্যায় করা হয়েছে। মনোনয়ন দিয়ে এই অন্যায়ের প্রতিকার করা যায় না। কারাগারে এবং রিমান্ডে রেখে দল পরিবর্তনের সম্মতি আদায়- অন্যায়, গর্হিত ও চরম অসম্মানজনক কাজ।প্রজাতন্ত্রের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বীর শাহজাহান ওমরের প্রতি বৈষম্যমূলক ও অমানবিক আচরণের প্রতিবাদে এ পর্যন্ত একজন নাগরিক বা একজন মুক্তিযোদ্ধা বা রাষ্ট্রের কোনো একটি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসেনি। কয়েক হাজার বছর পূর্বে গ্রিসে নৈতিক বিবেচনা ছিল ক্রীতদাসদের প্রতি কঠিন ভাবে বৈষম্যমূলক। শত্রুকে যেকোনো মূল্যে পরাস্ত, হেনস্তা এবং হেয় করার কোনো বিকল্প চিন্তা ছিল না, অধিকন্তু নির্যাতন করে তাদের কাছ থেকে সাক্ষ্য আদায় করাও নীতিগতভাবে সমর্থনযোগ্য ছিল।সেই ক্রীতদাসীয় বর্বরাচরণ- রক্ত দিয়ে কেনা স্বাধীনতার একজন বীর সিপাহশালারের সঙ্গে আমরাও করলাম! অকারণেই একজন জাতীয় বীরের মর্যাদা বিনষ্ট করে দিয়ে আমরা আত্মতৃপ্তি অনুভব করছি। এতে আমাদের কোনো অনুশোচনা হয় না, অনুতাপ হয় না।গত ৪ঠা নভেম্বর মধ্যরাতে রাজধানীর একটি এলাকা থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ- বিএনপি নেতা, সাবেক সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরকে গ্রেপ্তার করে।
প্রজাতন্ত্রের সরকার পুলিশের অভিযোগে নিশ্চিত হয়েছেন শাহজাহান ওমর নিউমার্কেট এলাকায় বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সম্পৃক্ত। এই অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। অগ্নিসংযোগ-এর ঘটনায় কীভাবে শাহজাহান ওমর সম্পৃক্ত হলেন, কয়টা বাসে আগুন লাগিয়েছিলেন, কী কী দ্রব্য ব্যবহার করেছিলেন, কখন-কোথায় থেকে অগ্নিসংযোগের পরিকল্পনা করেছিলেন, ভবিষ্যতে আরও নাশকতা করার পরিকল্পনা আছে কিনা- এসব নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাকে চার দিন রিমান্ডে রাখা হয়। রিমান্ড শেষে আদালতে তোলা হয় এবং রাষ্ট্রপক্ষ অপরাধের যৌক্তিকতার প্রমাণস্বরূপ তাকে কারাগারে পাঠানোর আবেদন করে। এর ভিত্তিতে আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়। এরকম গুরুতর অভিযোগের মামলায় অন্য কেউ জামিন না পেলেও ২৯শে নভেম্বর বিকালে তিনি জামিন পেয়ে সন্ধ্যায় কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। সরকার এই জামিনের বিরোধিতা করেনি।
কারা মুক্তির পরের দিন অর্থাৎ ৩০শে নভেম্বর তিনি মনোনয়নপত্র জমা দেন এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাকে দলীয় মনোনয়ন প্রদান করে। রাজনৈতিক দল হচ্ছে নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পন্ন একটি প্রতিষ্ঠান। অন্য দল থেকে লোক সংগ্রহ করতে গিয়ে অন্যায়ভাবে রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করা রাজনৈতিক দলের নৈতিকতা অনুমোদন দেয় না। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সরকার ও বিরোধীপক্ষের সম্পর্ককে রূপদান করা; বিরোধী দলকে নির্মূল করা নয়। ক্ষমতার পালাবদল নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্রের নিয়মিত প্রত্যাশিত ও গ্রহণীয় অংশ। এই বিশ্বাসের জায়গাটি অবিশ্বাসে রূপান্তর হলে দেশ হয় নৈরাজ্য কিংবা স্বৈরাচারী শাসনের দিকে চলে যায়।
প্রথম প্রশ্ন- মুক্তিযুদ্ধের একজন বীর সিপাহশালার বাসে আগুন দিয়েছে, এটা সরকারের কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে প্রতীয়মান হওয়ার পরও তাকে দলীয় মনোনয়ন দেয়ার সিদ্ধান্ত কি সাংঘর্ষিক না সামঞ্জস্যপূর্ণ?রাষ্ট্রের চোখে বা সরকারের দৃষ্টিতে বাসে আগুন দেয়ার মতো নির্মম-ভয়াবহ অপরাধে অভিযুক্ত অপরাধী শাহজাহান ওমর। তার বিচার এখনো অনিষ্পন্ন। সরকারি আইনজীবী তাকে সন্ত্রাসী হিসেবে উপস্থাপন করে তার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য আদালতের প্রতি আবেদন জানানোর কথা। কিন্তু হঠাৎ তার জামিন প্রাপ্তি এবং অব্যবহিত পরেই সরকারি দলের মনোনয়ন লাভ করে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করা এক বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। সরকার যাকে সন্ত্রাসের অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে, রিমান্ডে নিয়েছে, সেই অভিযোগের নিষ্পত্তি হওয়ার পূর্বেই সরকারি দল তাকেই মনোনয়ন দেয়ার নৈতিক অধিকার সংরক্ষণ করে কিনা? সরকার যাকে অপরাধী হিসেবে আখ্যায়িত করে অপরাধের আরও বড় উৎস খুঁজে বের করার জন্য রিমান্ডে নিয়েছে, তাকেই রাজনৈতিকভাবে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করতে পারে কিনা? সরকার যার বিরুদ্ধে আদালতে অপরাধী হিসেবে সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করছে আবার একই সঙ্গে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। সরকার এটা পারে কিনা! শাহজাহান ওমরকে সন্ত্রাসী হিসেবে গ্রেপ্তার করে বা তার বিরুদ্ধে কল্পিত অভিযোগ এনে তার যে মানবিক মর্যাদা গুঁড়িয়ে দিয়েছে, সমাজের চোখে তাকে যে হেয় করা হলো এর দায়-দায়িত্ব কে নেবে?দ্বিতীয় প্রশ্ন- সরকারি দলে যোগদান করলে বাসে আগুন দেয়ার ফৌজদারি অপরাধ বিলুপ্ত হয়ে সন্ত্রাসী থেকে ভালো মানুষে রূপান্তরিত হয়ে যায় কিনা? তাহলে নিশ্চয়ই আগুন সন্ত্রাসের সকল মামলা যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, শাহজাহান ওমরের প্রতি সরকারের আচরণ থেকে তা স্পষ্ট হয়েছে। সরকারের উচিত এই ধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় গ্রেপ্তারকৃতদের দ্রুত মুক্তি দেয়া এবং ক্ষতিপূরণ প্রদান করা। এটাই প্রজাতন্ত্রের নৈতিক দায় ও কর্তব্য। কোনো নিরপরাধ নাগরিককে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা, রিমান্ডে নেয়া বা আদালতে দণ্ডিত করা হলে সেটাকে আর রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে নাগরিককে সর্বোচ্চ সুরক্ষা দেয়া, অপরাধীকে শাস্তির আওতাভুক্ত করা। রাজনৈতিক স্বার্থে বা দলীয় স্বার্থে নিরপরাধকে অপরাধী করলে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যায়। আইন আছে অথচ আইনের প্রয়োগ হবে না- এমন রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব বিলুপ্ত হয়ে যাবে। রাষ্ট্রের ভিত্তি হচ্ছে আইন, সেই আইনকেই যদি নির্বাসনে দেয়া হয় তাহলে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে পরিগণিত হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকবে না।তৃতীয় প্রশ্ন- ২৯শে নভেম্বর রাতে মুক্তি পেয়ে শাহজাহান ওমর নৌকার প্রতীক নিয়ে কীভাবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। তিনি কখন কার কাছে আওয়ামী লীগের দলীয় ফরম এবং অঙ্গীকারনামা পূরণ করে প্রাথমিক সদস্যপদ নিয়েছেন, কোন কমিটি কর্তৃক তার প্রাথমিক সদস্যপদ গৃহীত হয়েছে, জেলা কমিটি বা উপজেলা কমিটি কখন তার পক্ষে সুপারিশ প্রদান করেছেন বা আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ডের নিকট মনোনয়ন চেয়েছেন? আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত তালিকায় শাহজাহান ওমরের নাম নেই এবং তাকে নিয়ে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদীয় বোর্ডের সভাও অনুষ্ঠিত হয় নাই তাহলে তার নৌকা প্রতীক কীভাবে চূড়ান্ত হলো?নির্বাচন কমিশনে দলের গঠনতন্ত্রে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কথা বলা হলেও, শাহজাহান ওমরের বেলায় তা প্রতিপালিত হয়েছে কিনা তাও অনুসন্ধান করা উচিত। সরকার সুযোগ বুঝে চোখের পলকে সত্য থেকে, সংবিধান থেকে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরে যায়। সরকার কতোটুকু সত্য গোপন করে আর কতোটুকু সত্য প্রকাশ করে তা ইতিহাসের কাছে দ্রুতই উন্মোচিত হয়ে যায়।সংবিধান এবং আইনকে যদি দলের বা ব্যক্তির ইচ্ছাধীন করা হয় তাহলে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকারের দিকে ধাবিত হবে, কেউ তা প্রতিরোধ করতে পারবে না। মুক্তিযুদ্ধের রাষ্ট্রে এমন অবিচার, শহীদদের আত্মার প্রতি অসম্মান ছাড়া আর কিছু নয়। রাষ্ট্র ও জনগণের মাঝে যে চুক্তিমূলক সম্পর্ক রয়েছে, সে চুক্তি লঙ্ঘন করা বা ভঙ্গ করা নৈতিকতার বিচারে অনুমোদনযোগ্য নয়। রাষ্ট্র এবং নির্বাহীদের ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার থেকে নাগরিক সুরক্ষা না পেলে আইনি ন্যায্যতা ও অন্যায্যতার সীমারেখা মুছে দিলে রাষ্ট্রকে আর রাষ্ট্র বলা যায় না।