মতামত

প্লাস্টিকে মোড়া বাংলাদেশ

magura 20220608103133
print news

নাভিদ সালেহ : ১৬১০ সাল। মুঘল সালতানাৎ-এর সেনাপ্রধান, বাংলার সুবেদার ইসলাম খান চিশতী, বারো-ভূঁইয়া মুসা খাঁকে পরাস্ত করেন। বাংলার রাজধানীকে রাজমহল থেকে স্থানান্তরিত হতে হবে। বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী ঢাকার চেয়ে উত্তম ঠিকানা আর কী হতে পারে! পৃথিবীর আর সব প্রধান নগরীর মতো স্থাপনা হয় মহানগর ঢাকার। সে সময়, বুড়িগঙ্গা ছিল গঙ্গার সমুদ্রযাত্রা পথের সহযাত্রী। গঙ্গা থেকে যমুনা, যমুনা থেকে ধলেশ্বরী; আর এরই শাখানদী হিসেবে বুড়িগঙ্গার জন্ম হয়েছিল বলে জানা যায়। আজ ২৭ কিলোমিটার দীর্ষ এই নদীটিকে প্রায় চেনাই যায় না। এর গভীর জলরাশি আর চোখে পড়ে না। নদীটির কাছেও যেন ঘেঁষা বারণ। যতদূর চোখ যায়, নানারঙের প্লাস্টিক বর্জ্যই কেবল নজরে আসে। ছৈ নৌকোগুলোকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো দেখায়, প্লাস্টিকের এই মহানদীতে। প্লাস্টিক বর্জ্য যেন শ্বাসরোধ করে ক্ষণে ক্ষণে হত্যা করে চলেছে বুড়িগঙ্গাকে। বাংলাদেশ জন্মের পর মাত্র চার দশক সময়ের ভেতর আমরা এই প্রাণসঞ্চারী স্রোতস্বিনীকে একটি পয়ঃপ্রণালীতে রূপান্তরিত করেছি। প্লাস্টিক দূষণ আজ একটি জাতীয় জরুরি অবস্থার অবতারণা করেছে বৈকি!

প্রতি বছর, বিশ্বে ৪৫ কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। ২০১৯ সালের উপাত্ত মতে, বাংলাদেশে ব্যবস্থাপনাহীন প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ টনের মতো; বৈশ্বিক প্লাস্টিক বর্জ্যের যা ২.৪৭ শতাংশের মতো। আঞ্চলিক তুলনায়, ভারত আমাদের চেয়ে ১৩ গুণ বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি করছে; তবে, ভারতের ভূখণ্ডের আয়তন কিন্তু বাংলাদেশের ২২ গুণ। অর্থাৎ, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই দেশটিকে আমরা সযত্নে প্লাস্টিক দিয়ে মুড়ে চলেছি বছরের পর বছর। প্লাস্টিক নামের এই অপচনশীল পদার্থ সংশ্লেষের ইতিহাসটি কী?

হাতির দাঁতের বিকল্প হিসেবে ১৮৬৯ সালে জন ওয়েসলি হায়াট নামক একজন মার্কিন উদ্ভাবক, তুলার তন্তুর সঙ্গে কর্পূরের বিক্রিয়ার মাধ্যমে প্লাস্টিক-সদৃশ পদার্থ তৈরী করেন। এরপর, উনিশ শতকের গোড়ার দিকে, যুক্তরাষ্ট্রে দ্রুত বিদ্যুতায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজন হয়ে পড়ে একটি অন্তরক পদার্থের বা ইন্সুলেটরের। লিও বেকল্যান্ড তৈরি করেন প্রথম সিনথেটিক প্লাস্টিক, যার নাম দেওয়া হয় বেকলাইট। সেই শুরু। অতঃপর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নাইলনের আবিষ্কারে ইন্ধন জোগায়। ওয়ালেস ক্যারোথারের উদ্ভাবিত নাইলন থেকে তৈরি হতে থাকে যুদ্ধের সরঞ্জাম: প্যারাসুট, বর্ম, হেলমেট ইত্যাদি। প্লাস্টিক মানব ইতিহাসে নিজের স্থান করে নিতে থাকে। আজ বাংলাদেশে আমরা প্রতিবছর জনপ্রতি কমপক্ষে ৬.২৭ কেজি প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি করছি! এই বর্জ্য হয় ফেলা হচ্ছে কোনো জলাশয়ে, কিংবা তা রয়ে যাচ্ছে ভাগাড়ের বর্জ্যের স্তূপে। নগর ও গ্রামাঞ্চলে বর্জ্য নিক্ষেপ, নিষ্কাশন ও এর প্রভাব নিয়ে আলোকপাত করেছেন ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব তাঁর সাম্প্রতিক প্রকাশিত “বাংলাদেশের পানি, পরিবেশ ও বর্জ্য” নামের সুলিখিত গ্রন্থে। প্লাস্টিক দূষণের গুরুত্ব এবং এর প্রতিকারের কিছু ভাবনা নিয়ে আজকের সম্পাদকীয়।

প্লাস্টিক নানাবিধ। পলিথিন ব্যাগ বাংলাদেশে সর্বাধিক প্রচলিত এবং এটি তৈরি হয়ে থাকে নিম্ন-ঘনত্বসম্পন্ন পলিইথিলিন থেকে। এছাড়া উচ্চ-ঘনত্বের পলিইথিলিন থেকে তৈরি হয় নানা পাত্র, শ্যাম্পু-সাবানের বোতল ইত্যাদি। অন্যদিকে, পলিইথিলিন টেরাফথালেট থেকে পানির বোতল তৈরি হয় আর নাইলন থেকে বানানো হয় দড়ি। এছাড়া রয়েছে সম্প্রতি প্রচলিত ম্যালামাইন, যা ম্যালামাইন ফরমালডিহাইড। ম্যালামাইন অত্যন্ত টেকসই আর তাই জনপ্রিয়। তবে, সব প্লাস্টিকই অবশ্য টেকসই। সমস্যা তো এখানেই। যে পদার্থ পানিতে নষ্ট হয় না, রোদে জ্বলে না, এমনকি ভঙ্গুরও নয়, সে পদার্থ পরিবেশে বর্জ্য হিসেবে নিক্ষিপ্ত হলে তার গুণাগুণ তো অক্ষুণ্ন থাকবেই। এর ফলে, তা পারসিসটেন্ট অর্থাৎ অপচনশীল স্থায়ী পদার্থ হিসেবে পরিবেশে থেকে যাবে দশকের পর দশক। পাঠকের মহল্লার ডাস্টবিনের বর্জ্য যদি সরিয়ে না নেওয়া হয়, বা তা যদি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর জড়ো হতে থাকে ও অপচনশীল থাকে, তবে পুরো এলাকাই যে বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হবে। প্লাস্টিক এভাবেই আমাদের খাল-খন্দ, নদ-নদীতে নিক্ষিপ্ত হবার পর সেখানে আটকে থাকছে দীর্ঘ সময় ধরে। ফলে আমরা পাচ্ছি অবরুদ্ধ পয়ঃপ্রণালি আর দূষিত নদী। বর্ষার অতিবৃষ্টির পানি সরার উপায় হারাচ্ছে। জলাবদ্ধ হয়ে পড়ছে নগর। এগুলো তো হলো দৃশ্যমান সমস্যা। এছাড়াও রয়েছে বৃহৎ প্লাস্টিক বর্জ্যের ক্ষয়জাত ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণিকা বা মাইক্রোপ্লাস্টিকের অদৃশ্য স্বাস্থ্যঝুঁকি।

মাইক্রোপ্লাস্টিক একসময় নানা আধুনিক প্রসাধন সামগ্রীতে যুক্ত করা হতো। বর্তমানে পাশ্চাত্যে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণিকা বৃহৎ প্লাস্টিকের আলোকরাসায়নিক বিনাশের মাধ্যমেও তৈরি হতে পারে। এই মাইক্রোপ্লাস্টিকের আধিক্য পরিবেশ দূষণের একটি বিশেষ কারণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। এর পেছনের কারণ হিসেবে প্লাস্টিক থেকে নিঃসরিত সম্ভাব্য রাসায়নিক পদার্থ– যেমন বিপিএ, থ্যালেটস, ইত্যাদিকে মূলত দায়ী করা হচ্ছে। তদুপরি, বিশেষ আকারের মাইক্রোপ্লাস্টিক, যেমন আঁশের মতো মাইক্রোফাইবার মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর জন্যে বিশেষ হুমকির কারণ। জলজ প্রাণীসমূহ মাইক্রোপ্লাস্টিক বা মাইক্রোফাইবার আহার করলে তা তাদের পাকস্থলীকে জড়িয়ে অক্রিয়াশীল করে ফেলে। এর পাশাপাশি, মাইক্রোপ্লাস্টিক ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ কিংবা ভারী ধাতুর বাহক হিসেবে যেহেতু কাজ করে তাই তা ভক্ষণে যে কোনো প্রাণী বা মানবের শরীরে এই ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থনিঃসরিত হতে পারে এবং ক্রমান্বয়ে সঞ্চিত হতে পারে।

প্লাস্টিকের আরেকটি পরোক্ষ অদৃশ্য প্রভাব হলো বৈশ্বিক উষ্ণায়নে এর অবদান। প্রায় ৯৮ শতাংশ প্লাস্টিক জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উৎপাদিত হয়। প্রচলিত জীবাশ্ম জ্বালানি-ভিত্তিক প্লাস্টিকের উৎপাদন, ব্যবহার এবং নিষ্পত্তির সঙ্গে যুক্ত গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের মাত্রা ২০৪০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক কার্বন বাজেটের ১৯ শতাংশে বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আমরা সিমেন্ট শিল্পকে উষ্ণায়নের কারিগর বলে জানি। সিমেন্টের কার্বন বাজেটে অবদান কিন্তু ৮ শতাংশের বেশি নয়। প্লাস্টিকশিল্প তাই জলবায়ু পরিবর্তনে একটি অন্যতম প্রতিনায়ক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই অপচনশীল আপাতঃস্থায়ী পরিবেশ দূষক প্লাস্টিকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ, দৃশ্যমান ও অদৃশ্য প্রভাবের কথা তো জানা হলো। এর প্রতিকারের কি কোনো উপায় নেই? এক্ষেত্রে নিরুত্তর থাকার পথ আর খোলা নেই।

প্রথমত: যে প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশে আমরা ইতোমধ্যে নিক্ষেপ করে ফেলেছি তা সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। ইউএনডিপি, ইউনেপ, জাতিসংঘ ফাউন্ডেশন প্লাস্টিক অপসারণের নানা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কানাডা ও রুয়ান্ডা প্লাস্টিক দূষণ রোধে সবচেয়ে অগ্রগামী। তবে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ২০২১ সালে “প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আইন” প্রণয়ন করেছে। এই আইন বলছে: “পহেলা জুলাই, ২০২২ থেকে একক-ব্যবহার্য প্লাস্টিকের উৎপাদন, আমদানি, মজুত, বিতরণ, বিক্রয় এবং ব্যবহার নিষিদ্ধ”। তাই দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে এমনি আইনের দাবি আমাদের জানাতেই হবে। আর সোনালি আঁশের দেশ বাংলাদেশে তো প্লাস্টিকের বিকল্প রয়েছেই। পাটশিল্প পুনরুজ্জীবনের জন্যে প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে সর্বক্ষেত্রে পাটজাত দ্রব্যের ব্যবহারে উৎসাহ দিলে বাংলাদেশের উন্নয়নই ত্বরান্বিত হবে।

তৃতীয়ত: ব্যক্তি পর্যায়েও প্লাস্টিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন আনা জরুরি। যেমন, খাবার কেনার সময়ে প্লাস্টিক প্যাকেজিং-এ মোড়া সামগ্রী কেনা থেকে বিরত থাকা যেতে পারে। এতে খাবার সরবরাহকারীরা প্যাকেজিং-এ প্লাস্টিক ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হবে। একইভাবে ফ্যাশন শিল্পে প্লাস্টিকের ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করতে হলে ক্রেতার মনোভাব এবং পছন্দ-অপছন্দই নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়াবে। এখানে দায় কিন্তু তাই আমাদের সকলের। একক-ব্যবহার্য প্লাস্টিক বর্জন ও প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহারকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে আপনি, আমি সকলে এই কৃত্রিম, অপচনশীল দূষকের হাত থেকে আমাদের পরিবেশকে বাঁচাতে পারি। আসুন, সরকারের কাছে প্লাস্টিক-নিষিদ্ধকারী আইনের দাবি জানাই আমরা। আসুন, প্লাস্টিক যে আসলে একটি সস্তা দ্রব্য এবং অনাকর্ষণীয়, সেই সত্যটিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করি। পরিবেশ-বান্ধব পদার্থের ব্যবহারে নিজেরা নিয়োজিত হই, আর উৎসাহিত করি আত্মীয়, পরিজন, বন্ধু, আর মহল্লাবাসীকে।

আগামীর শিশুদের জন্যে এই বাংলাদেশকে বাসযোগ্য করে যেতে হবে। কালকের শিশুরা যেন পরিবারের সঙ্গে বুড়িগঙ্গায় আবার প্রমোদ ভ্রমণে বেরুতে পারে। ধলেশ্বরী নদী যেন তাদের আর গরুর গাড়িতে পার হতে না হয়। ছৈ নৌকাগুলো পাল তুলে দেওয়ার অপেক্ষায় আছে। কণ্ঠে ভাটিয়ালি সুর বেঁধে এই নৌকার মাঝিরা চেয়ে আছে আমাদেরই দিকে।

নাভিদ সালেহ: যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট অস্টিনের অধ্যাপক

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *