ঠিকাদারের টাকা তুলে নিলো কলেজছাত্রী, নেপথ্যে ঘুষ বাণিজ্য


ঢাকা প্রতিনিধি : সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কাজ করার টেন্ডার নেয় এসএ এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির মালিক দ্বীন ইসলাম কাজ পেলেও সেটি নিজে করেন না, অন্য প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে করান। আর এই সুযোগে অন্য প্রতিষ্ঠান কাজ না করেই দ্বীন ইসলামের প্রতিষ্ঠানের নামে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ব্যাংক একাউন্ট খোলে। এরপর সেই একাউন্টের নামে বিলের চেক তুলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। এই টাকা তুলতে মালিকের ভূমিকা পালন করেছে কলেজছাত্রী দিলারা। এসব কাজে সহায়তা করতো দিলারার স্বামীও। রাজধানীর কোতোয়ালী থানায় দায়ের করা একটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এমন প্রতারণার তথ্য জানতে পারে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। ডিবি বলছে, মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিজে কাজ না করে অন্য জনকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়ে করাতে গিয়েই হয়েছে বিপত্তি। কাজ করার পর মূল ঠিকাদারের নামে বিল উঠে। তখন ব্যাংকের কিছু অসাধু ব্যক্তি ও ভুয়া ঠিকাদার মিলে ভুয়া এনআইডিতে একই নামে একাউন্ট খুলে। এরপর সেই একাউন্টে কাজের মূল বিল বাবদ পাওয়া চেক ভাঙ্গায় অর্থাৎ টাকা তুলে নেয়। চক্রের মূলহোতা ও সহযোগীসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলার পর পুলিশ প্রথমে ভুয়া ঠিকাদার রমজান হোসেনকে আটক করে। এরপর তার স্ত্রী মোসা. দিলারাকে তার বাসা থেকে আটক করে এবং তার হেফাজত থেকে নগদ ২৪ লাখ টাকা ও অন্যান্য মালামাল জব্দ করে। পরে ওই মামলায় ডিবি পুলিশ মামলার ৪ নম্বর আসামি জসিম উদ্দিনকেও আটক করে। ১ ও ২ নম্বর আসামি আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেয়।
বুধবার (৬ মার্চ) নিজ কার্যালয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, মেসার্স এসএ এন্টারপ্রাইজ নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক দ্বীন ইসলাম। তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঠিকাদারি করেন। মেসার্স এসএ এন্টারপ্রাইজ সুনামগঞ্জের পিডব্লিওডি’র একটি ঠিকাদারি কাজ নেন। কাজটি সম্পূর্ণ করার জন্য মেসার্স এসএ এন্টারপ্রাইজের পক্ষ থেকে সাব-ঠিকাদার জসিম উদ্দিনকে অথোরাইজেশন দেওয়া হয়।তিনি কাজটি সম্পূর্ণ করার জন্য রমজান হোসেন ও আবু কাওসারের সঙ্গে ৭ শতাংশ কমিশনে চুক্তিবদ্ধ হন। রমজান হোসেন ও আবু কাওসার ৫-৬ লাখ টাকার কাজ করেন। বাকি কাজ অসম্পূর্ণ রেখে পিডব্লিউডি অফিসে ঘুষ দিয়ে ১৫ লাখ টাকার বিল উঠিয়ে পালিয়ে যায়। কাজটি সম্পূর্ণ করার জন্য পিডব্লিউডি অফিস থেকে চাপ দিতে থাকলে বাধ্য হয়ে জসিম উদ্দিন বাকি কাজ শেষ করে। রমজান হোসেন ও আবু কাওসার মিলে সে কাজের বিলও আত্মসাৎ করার পরিকল্পনা করে।
এই পরিকল্পনায় রমজান তার স্ত্রীকে যুক্ত করে। কাওসারকে নিয়ে রমজান তার বাসায় স্ত্রী মোসা. দিলারাকে নিয়ে বৈঠক করে বলে, তারা সুনামগঞ্জ পিডব্লিউডিতে ৩৪ লাখ টাকার একটি কাজ করেছে। কিন্তু বিল তুলতে পারছে না। আবু কাওসার মোসা. দিলারাকে বলে যে, সে যদি টাকাটা তুলতে তাদের সহায়তা করে তবে দেড় লাখ টাকা দেওয়া হবে। আবু কাওসার তাৎক্ষণিকভাবে দিলারাকে দেড় লাখ টাকার চেক দিয়ে বলে, বিল উত্তোলন করা গেলে সে এই চেকেই টাকা তুলে নিতে পারবে। আবু কাওসার আরও বলে, টাকা উত্তোলনের জন্য মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স এসএ এন্টারপ্রাইজের নামে ভুয়া ট্রেড লাইসেন্স তৈরি করতে হবে। যার প্রোপাইটার বা মালিক হিসেবে দেখানোর জন্য সুমি আক্তার মাহমুদা নামে একটি এনআইডি কার্ড দেন।
এরপর রমজান হোসেন দিলারাকে নিয়ে পূবালী ব্যাংক বাসাবো শাখায় মেসার্স এসএ এন্টারপ্রাইজ নামে ব্যাংক একাউন্ট খুলে। খুব চতুরতার সাথে সুমি আক্তার মাহমুদার এনআইডি কার্ডের সাথে দিলারার নিজের ছবি ব্যবহার করে মেসার্স এসএ এন্টারপ্রাইজ প্রোপাইটার সুমি আক্তার মাহমুদা নামে ব্যাংক একাউন্ট খুলে। এই কাজে তাদেরকে সহায়তা করে ব্যাংকটির সেই শাখার কর্মকর্তা পলাশ। এর বিনিময়ে রমজান হোসেন পলাশকে ৫০ হাজার টাকা দেয়। এরপর তিনজনই সুনামগঞ্জ গিয়ে হোটেলে উঠে। আত্মসাৎ পরিকল্পনায় জড়িত খোদ সাব-ঠিকাদার জসিমও সুনামগঞ্জে যাওয়ার পর সাব-ঠিকাদার ও আগের বকেয়া কাজ করা জসিম উদ্দিন তাদের সাথে যোগ দেয়। রমজান ও কাওসার মিলে সুনামগঞ্জ পিডব্লিউডি অফিসে বিল পাস করানোর জন্য যায়। পিডব্লিউডি অফিসের এসডি আশরাফ হোসেন, এসও এনামুল ও আবুল হাসান, একাউন্টেন্ট লতাকে ৬ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চারটি চেকের মাধ্যমে বিল পাস করিয়ে নেয়।
রমজান হোসেন নিজেকে জসিম পরিচয় দিয়ে পিডব্লিউডি অফিস থেকে চেকগুলো নিয়ে আসে। চারটি চেকে মোট ৩৩ লাখ ৪৯ হাজার ২৪৫ টাকা প্রদান করার জন্য বলা হয়। চেকগুলো নিয়ে তারা পূবালী ব্যাংক লিমিটেড, দরগা গেট ব্রাঞ্চ, সিলেট শাখায় যায়। মুখে মাস্ক পড়ে নিজেকে জসিম উদ্দিন পরিচয় দিয়ে চেকগুলো ক্যাশ করার জন্য ব্যাংকের ভিতরে যায় রমজান। ব্যাংক কর্মকর্তা মেসার্স এসএ এন্টারপ্রাইজের প্রোপাইটার হিসেবে সুমি আক্তার মাহমুদা ওরফে দিলারাকে ফোন দিয়ে জানতে চান যে, টাকাগুলো ক্যাশ করে দিবেন কিনা। তখন দিলারা সম্মতি দেয়। এরপরই রমজান ৩৩ লাখ ৪৯ হাজার ২৪৫ টাকা উত্তোলন করে ও ৩০ লাখ টাকা ডাচ-বাংলা ব্যাংক সিলেট ব্রাঞ্চ থেকে দিলারার ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ওয়ারী ঢাকা শাখার একাউন্টে জমা করে। বাকি ৩ লাখ ৪৯ হাজার ২৪৫ টাকা রমজান হোসেন নিজের একাউন্টে জমা রাখে।
প্রতারিত হওয়া ও পুরো বিষয়টি জানার পরে সাব-ঠিকাদার জসিম উদ্দিন ডিএমপি’র কোতোয়ালী থানায় মামলা করেন। মামলা হলে পুলিশ রমজান হোসেনকে আটক করে। জামিনের কথা বলে বাবা বেলাল হোসেন রমজানের স্ত্রী মোসা. দিলারার কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা নেয়। বাকি টাকা ব্যাংক থেকে তুলে দিলারা নিজের কাছে রাখে। ডিবি পুলিশ দিলারাকে তার বাসা থেকে আটক ও বাকি ২৪ লাখ টাকা ও অন্যান্য মালামাল জব্দ করে। পরে মামলার বাদী জসিম উদ্দিনকেও আটক করা হয়। ১ ও ২ নম্বর আসামি আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সব স্বীকার করেছেন।ঢাকা মহানগর ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, এ ধরণের প্রতারণার কারণে মূল ঠিকাদাররা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আবার মূল ঠিকাদার থেকে পাওয়ার নিয়ে যারা কাজ করছেন তারাও কখনও কখনও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তিনি বলেন, এসব ঘটনায় পিডব্লিউডি’র অফিস ও ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা জড়িত। আমরা তদন্ত করছি। তদন্তের প্রেক্ষিতে আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়