অনুসন্ধানী সংবাদ

রাজউকের চাকরি যেন আলাদীনের চেরাগ :বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীই কোটিপতি!

a86e2843f0b2ec3a2750bcd465425530
print news

বাংলা ট্রিবিউন: বেতন পান সাকুল্যে ৩৫ হাজার টাকা। কিন্তু ঢাকার মধ্য পীরেরবাগে রয়েছে দুটি বাড়ি। এর একটি ১০ তলা, আরেকটি সাত তলা। চড়েন দামি গাড়িতে। স্ত্রীর নামে গড়ে তুলেছেন ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান। ‘অপ্সরা’ নামে সেই প্রতিষ্ঠানের অধীনে চলছে একাধিক ভবন নির্মাণের কাজ। গল্পটা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ- রাজউকের এক তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী মোহাম্মদ শফিউল্লাহ বাবুর। তার পদের নাম রেখাকার (নকশাকার)। রাজউকের চাকরিতে ঢুকে যেন ‘আলাদীনের চেরাগ’ হাতে পেয়েছেন। শূন্য থেকে বনে গেছেন কোটিপতি। শুধু কোটিপতিই না, শত কোটি টাকার মালিক তিনি। সংস্থাটির আরেক কর্মচারী জাফর সাদেক। ২০০৬ সালে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে চাকরিতে ঢুকেছিলেন রাজউকে। সবশেষ রাজউকের এস্টেট-২ (পূর্বাচল)-এর পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলামের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বেতন পান সাকুল্যে ৪০ হাজার। কিন্তু আফতানগরের ডি-ব্লকে তারও রয়েছে আটতলা বাড়ি। শান্তিনগরে আছে ফ্ল্যাট। চড়েন প্রিমিও গাড়িতে। নামে-বেনামে আরও আছে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি।

শুধু শফিউল্লাহ বাবু বা জাফর সাদেকই নন, রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেশিরভাগই কোটিপতি। কথিত আছে, রাজউকে চাকরি করেন, কিন্তু ঢাকায় তার নিজের একটি ফ্ল্যাট বা বাড়ি নেই এমন কর্মকর্তা-কর্মচারী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ঘুষ, দুর্নীতিতে ঠাসা রাজউকে চাকরি পেলেই যেন সবাই ‘আলাদীনের চেরাগ’ হাতে পেয়ে যান। প্লট বরাদ্দ থেকে শুরু করে, বাড়ি তৈরির নকশার অনুমোদন, নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মাণের দেখভাল, ভূমি ছাড়পত্র, অর্থের বিনিময়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে বাড়ি নির্মাণের সুযোগ, রাজউকের প্লট-ফ্ল্যাট বিক্রি, হস্তান্তর, নামজারি, আমমোক্তারনামা, মালিকানা জালিয়াতি সব ক্ষেত্রেই চলে দুর্নীতি। টাকা ছাড়া কোনও সেবাই পাওয়া যায় না সরকারের গণপূর্ত বিভাগের আওতাধীন এই সংস্থায়। এই সুযোগে এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিলে গড়ে তুলেছেন সিন্ডিকেট। সবাই মিলেমিশে হয়ে গেছেন কোটিপতি।সম্প্রতি বেইলি রোডের গ্রিন কজি কটেজ নামে একটি বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৪৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর আলোচনায় এসেছে রাজউকের ঘুষ-দুর্নীতির বিষয়টি। বলা হচ্ছে, রাজউকের ইমারত পরিদর্শকরা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করলে এমন দুর্ঘটনা ঘটতো না। সংশ্লিষ্ট এলাকার ইমারত পরিদর্শকরা অবৈধ অর্থের বিনিময়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে ভবন তৈরির সুযোগ করে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে।দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত রাজউকের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় অর্ধশত কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিটও দেওয়া হয়েছে। এমনকি রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধেও আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। বিচার শেষে অনেকের বিরুদ্ধে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

rajuk 1

১০-তলা-বাড়িমধ্য পীরেরবাগে মোহাম্মদ শফিউল্লাহ বাবুর ১০ তলা বাড়ি

দুদক সূত্র জানায়, এক সপ্তাহও আগেও উত্তরায় পৃথক দুটি নির্মাণাধীন ভবনে অভিযান চালায় দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম। রাজউকের স্থানীয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘ম্যানেজ’ করে অবৈধ ও নিয়মবহির্ভূতভাবে বাড়ি নির্মাণের কাজ চলছিল। দুদক এনফোর্সমেন্ট টিমের সদস্যরা অভিযানে অবৈধ ও নিয়মবহির্ভূতভাবে বাড়ি নির্মাণের সত্যতা পেয়ে রাজউক কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদনও পাঠিয়েছে।দুদক সূত্র জানায়, উচ্চ আদালতের পৃথক দুটি সুয়োমুটো (স্বতঃপ্রণোদিত) রুলের পরিপ্রেক্ষিতে রাজউকের ২৭ কর্মকর্তা-কর্মচারীর অবৈধ সম্পদ অর্জনের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। এর মধ্যে একটি অনুসন্ধানে ১৬ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরুর পর কয়েক জনের বিরুদ্ধে আগে থেকেই দুদকে অনুসন্ধান চলমান ছিল জানতে পারে। এছাড়া বাকি ১১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের সত্যতা পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সুপারিশ করে শিগগির কমিশন বরাবর প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। এছাড়া দ্বিতীয় দফায় আরও ১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান চলমান।দুদকের উপ-পরিচালক ইয়াসির আরাফাত জানান, যাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া গেছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের সুপারিশসহ কমিশন বরাবর প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।দুদকের একটি সূত্র জানায়, রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যাদের বিরুদ্ধেই অনুসন্ধান চালানো হয়েছে, তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ রয়েছে। এর মধ্যে হিসাবরক্ষক এ কে এম বায়েজিদ খান, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর আবদুল মোমিন, নকশাকার এমদাদ আলী, ইমারত পরিদর্শক মনিরুজ্জামান, সার্ভেয়ার মাসুম বিল্লাহ, সুপারভাইজার খালেদ মোশাররফ তালুকদার, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর ইউসুফ মিয়া, বেলাল হোসেন চৌধুরী রিপন, উচ্চমান সহকারী মোহাম্মদ হাসান, নকশাকার শেখ ফরিদ ও রেকর্ডকিপার ফিরোজ। রেখাকার মোহাম্মদ শফিউল্লাহ বাবু ও ব্যক্তিগত সহকারী জাফর সাদেকের বিরুদ্ধে পৃথক অনুসন্ধান চলছে।

rajuk 2

জাফর-সাদেকের-বাড়িরাজধানীর আফতানগরে রাজউকের কর্মচারী জাফর সাদেকের বাড়ি

দুদক সূত্র জানায়, হিসাবরক্ষক বায়েজিদ খানের উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের ১৬ নম্বর সড়কে তিন কাঠার ৫ নম্বর প্লটে ছয়তলা বাড়ির সন্ধান পেয়েছে দুদক। এছাড়া একই সেক্টরের ১২ নম্বর রোডের ২০ এবং ২২ নম্বর দুটি প্লটের মালিকও তিনি। দুটি প্লটে তিনি ৯ তলা বাড়ি নির্মাণ করছেন। ডাটা এন্ট্রি অপারেটর আবদুল মোমিনের পাঁচ কাঠা জমির ওপর একটি বাড়ি রয়েছে। দক্ষিণ মান্ডার ৭১ নম্বর ওয়ার্ডের ৭ নম্বর প্লটের এই বাড়িটির বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। এছাড়া মতিঝিলের ১০ নম্বর কবি জসীম উদ্দীন রোডে তার দুটি ফ্ল্যাটেরও সন্ধান পেয়েছে দুদক। সাভারে টিনশেড বাড়ি ছাড়াও স্ত্রীর নামে পূর্বাচলে প্লট রয়েছে তার। নকশাকার এমদাদের বাড্ডায় একটি পাঁচ তলা বাড়ি ও ডেমরায় দুটি প্লটের সন্ধান পাওয়া গেছে। ইমারত পরিদর্শক মনিরুজ্জামানের দক্ষিণ পীরেরবাগের আমতলা টাওয়ারে কোটি টাকার একটি ফ্ল্যাট ও প্রিমিও গাড়ির সন্ধান পেয়েছে দুদক।

দুদক সূত্র জানায়, সার্ভেয়ার মাসুম বিল্লাহর উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের ৬ নম্বর রোডের ২৪ নম্বর প্লটে সাততলা বাড়ি রয়েছে। সুপারভাইজার খালেদ মোশাররফ তালুকদার রুবেল সাত তলা বাড়ি করেছেন বগুড়ায়। এছাড়া ঢাকার মাদারটেকে কিনেছেন একটি ফ্ল্যাট। অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর ইউসুফ মিয়ার বাড়ির সন্ধান পাওয়া গেছে চট্টগ্রামে। গ্রামের বাড়িতে তিনতলা বাড়ি ছাড়াও বিশাল আকারের দুটি গরুর খামারের সন্ধান পেয়েছে দুদক। অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর বেলাল হোসেন চৌধুরী পল্টনের ৬৬ নম্বর শান্তিনগর একটি ফ্ল্যাট, উচ্চমান সহকারী মোহাম্মদ হাসানের বাড্ডায় একটি ছয়তলা বাড়ি ও আফতাবনগরে প্লট, রেকর্ডকিপার ফিরোজের উত্তরা মডেল টাউনের ১২ নম্বর সেক্টরে ছয়তলা বাড়ির সন্ধান পেয়েছে দুদক।দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে যাদের অবৈধ সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে, তারা কারোরই বৈধ আয়ে সারা জীবন চাকরি করেও একটি ফ্ল্যাট কেনার সামর্থ্য নেই। অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের মাধ্যমে একেকজন কোটিপতি হয়েছেন। এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে রাজউকের চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞার মোবাইল ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *