কীর্তিতে অনন্য নাজমুন নাহার রীনা : ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হওয়ার,হয়েছেন সফল উদ্যোক্তা


বরিশাল অফিস : নাজমুন নাহার রীনা। একজন প্রচার বিমুখ নারী উদ্যোক্তা।একে একে পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা। সরকার থেকে শুরু করে বেসরকারিভাবে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন পদকও। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ঘোষিত বরিশাল বিভাগে শ্রেষ্ঠ পাচঁ জয়ীতার একজন নাজমুন নাহার রীনা। অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী হিসেবে রীনা ক্রেস্ট, নগদ ২৫ হাজার টাকা এবং সনদপত্র অর্জন করেন। আরটিভি জয়া আলোকিত নারী সম্মাননা ২০২৪’ সম্মাননা পেলেন নাজমুন নাহার রীনা। বরিশালে অসহায় নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করায় রাঁধুনী কীর্তিমতী সম্মাননা অর্জন করেন নাজমুন নাহার রীনা। এক সপ্তাহে বড় দুটি সম্মাননা পাওয়া অনেক সম্মানের।কাজের স্বীকৃতিতে তিনি আরো উৎসাহিত হবেন বলে জানালেন রীনা।
ফেলে দেয়া পলিথিন দিয়ে নতুন পলিমার তৈরি করে পরিবেশ দূষণ রোধের পাশাপাশি স্থানীয় নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করায় সর্ব মহলে প্রশংসিত নাজমুন নাহার রীনা।তিনি একজন সফল উদ্যক্তা।বরিশাল বিসিককে আধুনিক ও উন্নয়ন করার উদ্যোক্তাদের একজন হলেন তিনি। কুটির ও বস্ত্র শিল্প সহ বিভিন্ন ব্যবসায় উদ্যোগের মাধ্যমে শত শত মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি এবং প্রতিবন্ধী নারীদের পুনর্বাসনে নিরলস কাজ করে যাওয়া বরিশালের অন্যতম সফল উদ্যোক্তা নাজমুন নাহার রীনা ।
নাজমুন নাহার রিনা জানান, খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, মাদারীপুরসহ সারাদেশ থেকেই ভাঙ্গারী ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে এই ফেলে দেয়া পলিথিন সংগ্রহ করেন তিনি। এখানে কর্মরত দরিদ্র মহিলারা বেশিরভাগই সামাজিকভাবে অবহেলিত ও প্রতিবন্ধী। প্রায় ৬০-৭০ জন লোকবল নিয়ে ময়লা ছেড়া পলিথিন পরিষ্কার করে তা দিয়ে পুনরায় ব্যবহার উপযোগী বড় পলিথিন তৈরি হয় আমার গড়া বিসমিল্লাহ পলিমার কারাখানায়।
বিসমিল্লাহ পলিমার এন্ড প্যাকেজিং ছাড়াও নাজমুন নাহার রিনা নক্সিকাথাসহ হস্তশিল্প উপকরণ তৈরি করে তা বাজারজাত করেন এই প্রতিষ্ঠান থেকেই। এ কাজে তাকে সহযোগিতা করে বরিশাল জেলা প্রশাসনের অধীন সামাজিক প্রতিবন্ধী মেয়েদের পুনর্বাসন কেন্দ্রের মেয়েরা। জেলা প্রশাসনের প্রবেশন কর্মকর্তা সাজ্জাদ পারভেজ তা নিয়মিত তদারকি করেন। সাজ্জাদ পারভেজ বলেন, বিসমিল্লাহ পলিমারে আমাদের মেয়েরা নিরাপদ এবং তাদের শান্তিপূর্ণ জীবনের নিশ্চয়তা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক রিনা মেয়েদের জন্য একটা মাসিক সম্মানিও দেন যা তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে বলে জানান সাজ্জাদ পারভেজ।
নাজমুন নাহার রিনার বাবা ছিলেন একটি দোকানের এক হাজার টাকা বেতনের কর্মচারী। পরিবারকে ভালো রাখতে রিনা অল্প বয়সে কাজ নিয়ে পারি জমান বিদেশে। নিজের সম্বল এনে তুলে দেন স্বামীর হাতে। স্বামী জমি আর অলঙ্কার পেয়ে নাজমুন নাহার রিনাকে ডিভোর্স দেন। এতে রিনা ডুবে যান চরম অসহায়ত্বে। কখনো ভাবতেও পারেননি তার সুদিন ফিরবে। তবে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। এখন সব হারানো সেই রিনা দুটি কারখানার মালিক।
নাজমুন নাহার রিনা বলেন, সমাজ আমাকে একদিন সবদিক থেকে বিমুখ করেছিল। কিন্তু আমি জানতাম পরিশ্রম আর চেষ্টা অক্ষুণ্ন রাখলে জয় আসবেই। যে সমাজ আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল, সেই সমাজ আজ আমাকে সম্মান করে। আমি মনে করি এই সম্মান আমার না, আমার কাজের।
বরিশাল বিসিকে বিসমিল্লাহ পলিমার অ্যান্ড প্যাকেজিং ও রিনা কটন মিলস নামে দুটি কারখানার মালিক রিনার অধীনে দেড় শতাধিক কর্মী কাজ করছেন। তার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রায় ১২শ নারী সাবলম্বী। কর্মক্ষেত্র বাড়িয়েছেন জুতা, নকশি কাঁথা, অলঙ্কার এবং পাটপণ্য তৈরিতে। দায়িত্ব পালন করছেন বরিশাল উইমেন চেম্বারের পরিচালক পদে।
নাজমুন নাহার রিনা বলেন, ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হব। কিন্তু ১৯৮৯ সালে এসএসসি পাস করার পর জীবনের জন্য সাঁতার দিতে হয়। বাবা তার বন্ধুর সাথে ব্যবসা করতে গিয়ে মূলধন হারিয়ে ভোলায় একটি দোকানে ১ হাজার টাকা বেতনে কাজ নেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় আমি। পরিবারে অভাব লেগেই থাকতো। সেই অভাব থেকে মুক্তি পেতে পাড়ি জমাই ঢাকায়। সেখানে এক মামার বাসায় আশ্রয় নিয়ে একটি কলেজে ভর্তি হলেও নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য ৮১০ টাকা বেতনে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিই। ওই চাকরি করেই এইচএসসি পাস করি। বেতন অবশ্য বেড়ে ১৪শ টাকা হয়েছিল। সেই টাকায় নিজের চলা, পরিবারকে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু পরিবারকেও সাপোর্ট দিতে হচ্ছিল। আমি ছাড়া তখন পরিবারের বিকল্প আয়ের উৎস ছিল না।
ওই সময়ে চিত্রবাংলা পত্রিকা খুবই বিখ্যাত ছিল। সেই পত্রিকার একটি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানতে পারলাম কুয়েতে নারী শ্রমিক নিচ্ছে। ১৯৯৭ সালে আমি কুয়েতে পারি জমাই। একটি পরিচ্ছন্নতা কোম্পানির সুপারভাইজার পদে সেখানে কাজে যোগ দেই। সেখানে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতাম। আমি জানতাম ওটাই আমার আমার জীবনের সব থেকে বড় সুযোগ। সুযোগ কাজে না লাগাতে পারলে কখনো আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব না। কিন্তু জানতাম না সেই ঘুরে দাঁড়ানোর পর আরও বড় বাধা অপেক্ষা করছে।
নাজমুন নাহার রীনা…..
কুটির ও বস্ত্র শিল্পসহ বিভিন্ন ব্যবসায় উদ্যোগের মাধ্যমে শতাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছেন নাজমুন নাহার রীনা। পাশাপাশি প্রতিবন্ধী নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে পুনর্বাসনে কাজ করছেন। বিভিন্ন ট্রেডে বারো শতাধিক নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করেছেন তিনি। এক সময়ে কর্মী হয়ে কুয়েতে পাড়ি জমানো নাজমুন নাহার রীনা দেশে ফিরে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরে রীনা কটন মিলস এবং বিসমিল্লাহ পলিমার এন্ড প্যাকেজিং নামে দুটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও শুরু করেন জুতা, নকশি কাঁথা, অলঙ্কার এবং পাট পণ্য তৈরির ব্যবসা। তিনি বরিশাল উইমেন চেম্বারের পরিচালক পদে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসায়ীক ও সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত আছেন।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়