নীরব সাক্ষী সোহরাওয়ার্দী উদ্যান


বিপুল জামান:
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সবুজ প্রান্তর ঢাকা তথা বাংলার অনেক কিছুরই সাক্ষী। ঢাকার রাজধানী হওয়া, রাজধানীর গৌরব হারানো, ঘোড়দৌড়ের সঙ্গে মিশে থাকা শ্বেতাঙ্গদের উন্মত্ততা, স্বাধীনতার জন্য বাঙালির আকুলতা, ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ এসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই সবুজ প্রাঙ্গণ। যদিও বারবার পরিবর্তিত হয়েছে এর নাম। লিখেছেন বিপুল জামান
মুঘল ঢাকা
১৬১০ সালে সুবেদার ইসলাম খানের হাতে ঢাকা বিস্তৃত হয়। ওই সময় ঢাকার উত্তরে দুটি নতুন ধরনের আবাসিক এলাকা গড়ে ওঠে। সুবেদার ইসলাম খান চিশতির ভাইয়ের নামানুসারে একটির নামকরণ করা হয় মহল্লা চিশতিয়া এবং সুবেদার ইসলাম খানের সেনাধ্যক্ষ সুজা খানের নামানুসারে অপরটির নামকরণ হয় মহল্লা সুজাতপুর। এর মাঝের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে মসজিদ, মন্দির ও অন্যান্য স্থাপনা ছিল। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন তার ‘ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ বইয়ে লিখেছেন, ‘শুজাতপুর ছিল বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন থেকে বাংলা একাডেমী পর্যন্ত। পুরনো রেসকোর্সের দক্ষিণ-পশ্চিমে ছিল চিশতীয়া। পুরো এলাকাটি ছিল মৌজা শুজাতপুরের অন্তর্গত। মৌজা শুজাতপুর নাম হয়েছিল রাজধানী ঢাকার প্রতিষ্ঠাতা ইসলাম খান চিশতীর ভাই শুজাত খান চিশতীর নামে।’ এই বইয়ে তিনি আরও জানান, পুরনো হাইকোর্ট ভবন থেকে নিয়ে বর্তমান সড়ক ভবন পর্যন্ত মুঘলরা তৈরি করেছিলেন বাগান, যার নাম ছিল ‘বাগ-ই-বাদশাহী’ বা ‘বাদশাহী বাগান’।… এই দুটি এলাকা ও বাদশাহী বাগের মাঝখানের জায়গাটুকু (আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জুড়ে ছিল সবুজ ঘাসে ঢাকা চত্বর। এ বিস্তৃত চত্বরের নাম হয়তো হয়ে গিয়েছিল রমনা। ফার্সি রমনার অর্থ সবুজ ঘাসে ঢাকা চত্বর, ইংরেজিতে লন। পরে সুজাতপুর, চিশতিয়া, বাগ-ই-বাদশাহী নাম বিলুপ্ত হয়ে গেলেও রমনা নামটি গিয়েছিল টিকে, আর এ নামেই পরিচিত হয়ে উঠেছিল পুরো এলাকাটি।’ রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হলে এই এলাকা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। আবাসিক জায়গাগুলো বাদে অন্যান্য এলাকা জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়ে।
ইংরেজ আমলে রমনা
ইংরেজ আমলে রমনা পুনরুদ্ধারে প্রথম হাত দিয়েছিলেন ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস ডস। ১৮২৫ সালে তিনি জেলখানার কয়েদিদের নিয়ে রমনা পরিষ্কারের কাজ শুরু করেন। পরিষ্কারকৃত অংশে গড়ে তোলেন রেসকোর্স ময়দান। ইংরেজ আমলে প্রতি রবিবার এখানে বৈধ ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। ১৮৫১ সালে রেসকোর্সের উত্তর কোণে ব্রিটিশ আমলারা ঢাকা ক্লাব স্থাপন করেন। মুনতাসীর মামুন তার ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী বইয়ে লিখেছেন, ‘১৮৫৯ সালের সার্ভেয়ার জেনারেলের তৈরি ঢাকার মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে, রমনাকে ভাগ করা হয়েছে দুভাবে রেসকোর্স আর বাকি অংশটুকু রমনা প্লেইনস। …নবাব আহছানউল্লাহ এখানে একটি চিড়িয়াখানাও স্থাপন করেছিলেন। …পুরো এলাকাটির নাম দিয়েছিলেন তারা শাহবাগ। …একদিকে শাহবাগ, অন্যদিকে রেসকোর্স। …নগরবাসীর এক অন্যতম বিনোদন ছিল ঘোড়দৌড় দেখা।’
বঙ্গভঙ্গ
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী করা হয় ঢাকাকে। নতুন রাজধানীর জন্য গড়ে তোলা হয় বিভিন্ন স্থাপনা। পরে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে এই স্থাপনা নিয়ে শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পঞ্চাশ দশকের মধ্যেই রমনার বিস্তৃত ময়দানের সীমানা দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। রমনার মূল মাঠ পরিচিত হয়ে উঠেছিল রমনা রেসকোর্স হিসেবে, অপর অংশ রমনা পার্ক হিসেবে। ১৯৪৯ সালে রমনা রেসকোর্স মাঠে ঘোড়দৌড় বন্ধ হয়ে যায়।
মুক্তি সংগ্রামের সাক্ষী
পাকিস্তান সৃষ্টির পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সামনে জিন্নাহ যে ভাষণ দেন সেটির স্থান ছিল কার্জন হলে। তখন রাজনৈতিক সমাবেশের স্থান হিসেবে রেসকোর্স ময়দান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। ভাষা আন্দোলনের সব সমাবেশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কলাভবন ও আশপাশের এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির মিছিলও কলাভবন থেকেই প্রাদেশিক ভবনের দিকে যাত্রা করে। ২১ ফেব্রুয়ারির পরে যেকোনো আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হয়ে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তখনকার রাজনৈতিক আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিল লক্ষণীয়। এসব কারণে জাতীয় আন্দোলনগুলোর সভাসমাবেশের স্থান হিসেবে পল্টনের পাশাপাশি রেসকোর্স ময়দান গুরুত্ব লাভ করে।
আগরতলা মামলা থেকে শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তি পেলে ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানেই তাকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ওই দিনই তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে ছাত্র-জনতা।
১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়ার পরও ক্ষমতা হস্তান্তর না করার ফলে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে আওয়ামী লীগ অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। ৩ মার্চ এই রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু সারা দেশে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং ৭ মার্চ এক সমাবেশ আহ্বান করেন। তিনি জানান, ৭ মার্চে ভাষণে তিনি পরের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
তার এই ঘোষণার পরই সারা দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বাত্মক প্রস্তুতি শুরু হয়। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অতর্কিত হামলার মুখে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে এই রেসকোর্স ময়দানে। এখন যেখানে শিখা চিরন্তন অবস্থিত তার পাশেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মিলিত শক্তি মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এই উদ্যানের নাম রেসকোর্স উদ্যান পরিবর্তন করে অবিসংবাদিত নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে নামকরণ করা হয় ‘সোহরাওয়ার্দী উদ্যান’।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে এসে এখানেই ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। সে বছরই ১৭ মার্চ আরেকটি জনসভায় ভাষণ দেন শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।
১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে¡ ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ যে গণআদালত গঠন করেছিল, সেই আদালতও বসেছিল এই উদ্যানেই।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে আবার ময়দানের সঙ্গে জড়িত ঐতিহাসিক ঘটনাবলি তুলে ধরার উদ্যোগ নেয়। ১৯৯৯ সালে ময়দানে ‘শিখা চিরন্তন’ স্থাপন করে। সেই সঙ্গে যেখানে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল, সেখানে স্বাধীনতা স্তম্ভ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ ও স্বাধীনতা জাদুঘর নির্মিত হয়েছে। স্বাধীনতা স্তম্ভ প্রকল্পের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ জনতার দেয়াল নামে ২৭৩ ফুট দীর্ঘ একটি দেয়ালচিত্র। এটি ইতিহাসভিত্তিক টেরাকোটার পৃথিবীর দীর্ঘতম ম্যুরাল। এর বিষয়বস্তু ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস। এর তিন পাশে রয়েছে কৃত্রিম জলাশয়। জনতার দেয়াল টেরাকোটা ম্যুরালের নিচের অংশে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে স্বাধীনতা জাদুঘর। বিগত কয়েক বছর ধরে অমর একুশে বইমেলার স্থান বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে সম্প্রসারিত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়