বাংলাদেশ পল্লি উন্নয়ন বোর্ড অনিয়মে বিতরণ করা ঋণ আদায় করে আত্মসাৎ


খুলনা প্রতিনিধি : ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় হতদরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হয় ঋণের টাকা। সেই টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করে নিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তারাই। এখন ব্যাংক থেকে খেলাপি ঋণের দায়ে গরিবের শেষ সম্বল সঞ্চয়টুকু কেটে নিয়ে আর্থিক সমন্বয় করা হচ্ছে। তবে টাকা আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে নারাজ সরকারি ওই দপ্তরটি।বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের (বিআরডিবি) ডুমুরিয়া কার্যালয়ে ঘটেছে এমনি ঘটনা। বছরের পর বছর ধরে গোটা কয়েক কর্মকর্তা এভাবেই আত্মসাৎ করে নিয়েছেন পৌনে দুই কোটি টাকারও বেশি।অনুসন্ধানে জানা গেছে, খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় বিআরডিবির ব্যবস্থাপনায় ১০২টি সমবায় সমিতি পরিচালিত হয়। সরকারি দপ্তরটির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সমিতির ২ হাজার ৫০ জন সদস্যের মধ্যে বিতরণ করা হয়। সেই অর্থ আদায় করে পুনরায় ব্যাংক ঋণ শোধ করা হয়।তবে বছরের পর বছর ধরে ওই উপজেলায় ঋণ বিতরণে অনিয়ম হয়ে আসছে। একই সঙ্গে আদায় করা ঋণ ব্যাংকে পরিশোধ না করে আত্মসাৎ করে নিয়েছেন দায়িত্বরতরা। এখন ব্যাংক খেলাপি ঋণ না পেয়ে সমিতির সদস্যদের জমা রাখা অর্থ থেকে সমন্বয় করে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। একই সঙ্গে নতুন করে আর কোনো ঋণ দেবে না বলে জানিয়েছে।ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) খুলনা শাখার সভাপতি কুদরত-ই খুদা বলেন, ‘গরিবের টাকা সরকারি কর্তাকর্তাদের আত্মসাৎ করা সরাসরি দুর্নীতি। যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে গরিবের সঞ্চয়টুকু বাঁচাতে হবে।’স্থানীয় সংসদ সদস্য ও ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তারা অর্থ আত্মসাৎ করবে, আর গরিবের শেষ সম্বলটুকু কেটে নিয়ে যাবে ব্যাংক। ডুমুরিয়ার জনগণের এত বড় ক্ষতি আমি কিছুতেই হতে দেব না। আমি চাই দুর্নীতি দমন কমিশন সঠিকভাবে অনুসন্ধান করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিক।’
২৯ সমিতিতে খেলাপি পৌনে দুই কোটি টাকা
বিআরডিবির একাধিক নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বর্তমানে ২৯টি সমিতির খেলাপি ঋণ রয়েছে। ২০২৩ সালের ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে বকেয়া রয়েছে ১ কোটি ৭১ লাখ ৯৯ হাজার ৩০৫ টাকা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ওই উপজেলায় ৩৩টি সমিতির মধ্যে ৬০.৮১ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে একটি সমিতিতে ২৪ হাজার ৩৪২ টাকা ঋণখেলাপি ছিল। পরে ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৩৩টি সমিতির মধ্যে ৭৭.৫৬ লাখ টাকা বিতরণ করা হলে ২টি সমিতিতে ১ লাখ ২৫ হাজার ৪০৭ টাকা ঋণখেলাপি থাকে। এরপর দীর্ঘ ৮ বছর ধরে কোনো সমিতির ঋণখেলাপি ছিল না। তবে ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ঋণখেলাপি হতে শুরু করে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৬টি সমিতির মধ্যে বিতরণ করা হয়েছিল ৩৭৮.৩৯ টাকা। যার মধ্যে ৮টি সমিতিতে ঋণখেলাপি রয়েছে ৫৪ লাখ ৮১ হাজার ৮৯৪ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩২টি সমিতির মধ্যে বিতরণ করা হয়েছিল ২৮২.৩৪ টাকা। যার মধ্যে ৪টি সমিতিতে ঋণখেলাপি রয়েছে ৩১ লাখ ৬ হাজার ৯৫১ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩২টি সমিতির মধ্যে বিতরণ করা হয়েছিল ২৮৫.৪৩ টাকা। যার মধ্যে ৮টি সমিতিতে ঋণখেলাপি রয়েছে ৪২ লাখ ২৬ হাজার ২২ টাকা এবং সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৪টি সমিতির মধ্যে বিতরণ করা হয়েছিল ২২৬.২৯ টাকা। যার মধ্যে ৬টি সমিতিতে ঋণখেলাপি রয়েছে ৩৯ লাখ ৩৫ হাজার ৬৮৯ টাকা।
ডুমুরিয়া উপজেলা বিআরডিবি কর্মকর্তা বলেন, সুদে-আসলে এই টাকার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ২২ লাখ টাকার বেশি। এখন ব্যাংক থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে এই টাকা পরিশোধ না হলে, নতুন করে কোনো ঋণ দেওয়া হবে না। দিন দিন ব্যাংকে খেলাপি ঋণের সুদ বাড়ছে।
ব্যাংক থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ১৯ অক্টোবর সোনালী ব্যাংক থেকে একটি চিঠি পাঠানো হয়। তাতে উল্লেখ রয়েছে, ডুমুরিয়া উপজেলায় ১০২টি সমবায় সমিতির ২ হাজার ৫০ জন সমবায়ীর শেয়ার-সঞ্চয়ের জমা করা ২ কোটি ৮৫ লাখ টাকা থেকে সোনালী ব্যাংক খেলাপি ঋণে সমন্বয় করে নেবে।
ঋণ বিতরণে অনিয়ম
ঋণখেলাপি হওয়া ২৯টি সমিতির নথি পর্যালোচনা করে একাধিক গড়মিল পাওয়া গেছে। যার মধ্যে ১২টি সমিতির গ্রাহকরা যেদিন ঋণ পরিশোধ করেছেন তার পরের দিনই নতুন করে ঋণ পেয়েছেন। যার পরিমাণ ১ কোটি ৯ লাখ ৭২ হাজার টাকা। ৮টি সমিতির গ্রাহকরা পূর্বের ঋণ পরিশোধের পরের দিনই ঋণ পেয়েছেন। যার পরিমাণ ৯৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া শোভনা মধ্যেপাড়া সমিতিতে একই দিন পরিশোধ ও ঋণ বিতরণের ঘটনা ঘটেছে। যার পরিমাণ ১৩ লাখ ২০ হাজার টাকা।
নথি যাচাই করে আরও পাওয়া গেছে, চন্ডিপুর মধ্যেপাড়া সমিতির ঋণ বিতরণ সনদে পরিদর্শকের কোনো স্বাক্ষর নেই। বাঘারদাইড় সমিতির সব সদস্যের ঋণ বিতরণের তথ্য ফ্লুইড দিয়ে মুছে ফেলা হয়েছে।
বিআরডিবি খুলনা জেলা কার্যালয়ের উপ-প্রকল্প পরিচালক আফরুজ্জামান বলেন, ২১টি সমিতির নথিতে ঋণ বিতরণের জন্য ন্যূনতম একদিনও সময় নেওয়া হয়নি। ফলে এখানে প্রতীয়মান হয়, ঋণ বিতরণের সঙ্গে যারা ছিলেন তারা ভালো করে সদস্য বাছাই না করেই ঋণ প্রদান করেছেন। আর কিছু নথিপত্রে পরিদর্শকের স্বাক্ষর ফ্লুইড দ্বারা ঘষামাজা করা রয়েছে। তাই এখানেও অনিয়ম হয়েছে।
ঋণের টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ
চন্ডিপুর দক্ষিণপাড়া সমিতি থেকে ১৮ জন গ্রাহক ঋণ নিয়েছিলেন। যার মধ্যে ধর্মদাশ মণ্ডল ঋণ নিয়েছিলেন ৬৬ হাজার টাকা। তিনি বলেন, ‘আমি ১৭ হাজার টাকা পরিশোধ করেছি। তবে আমাকে পরিদর্শক মো. শাহজালাল কোনো ভাউচার দেননি।’ অন্যদিকে বিআরডিবি উপজেলা কার্যালয়ের নথি থেকে পাওয়া গেছে, ধর্মদাশ মণ্ডলের নামে মাত্র ৩ হাজার টাকা ব্যাংকে জমা হয়েছে।
অনুরূপ একই সমিতি থেকে ৬৬ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন তাপস মণ্ডল। তিনি বলেন, ‘আমি এ পর্যন্ত দর্শক মো. শাহজালালের কাছে ২৫ হাজার টাকা পরিশোধ করেছি। সে কখনো কোনো ভাউচার দিত না। বলত অফিসে গিয়ে নথিতে টাকা তুলে দেব।’ তবে বিআরডিবি উপজেলা কার্যালয়ের নথিতে তাপস মণ্ডলের নামে কোনো টাকা জমা হয়নি।
একইভাবে প্রেসন মণ্ডল ৫১ হাজার, সনাতন মণ্ডল ১০ হাজার ও প্রশান্ত বিশ্বাস ১২ হাজার টাকা পরিদর্শকের কাছে জমা দেওয়ার দাবি করলেও তাদের নামে অফিসের নথি বা ব্যাংকে কোনো টাকা জমা হয়নি।
এ ছাড়া বাঘারদাইড় সমিতি থেকে ২০১৯ সালের ২৬ জুন ঋণ নিয়েছিলেন। তাকে একটি নকল পাস বই দেওয়া হয়েছে। তাতে মোট ৫৭ হাজার ৯০৯ টাকা জমা দেখানো হয়েছে। তবে অফিসের নথি বা ব্যাংকে তার নামে কোনো টাকা জমা দেওয়া হয়নি।
এখানেই শেষ নয়। চন্ডিপুর মধ্যেপাড়া সমিতিতে আরও বড় অনিয়ম ঘটেছে। ২০২১ সালের ২৯ জুন ২২ জন সদস্যের মধ্যে ১০ লাখ ৯০ হাজার টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছিল। অফিসের নথিতে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সেখানে পরিশোধ দেখানো হয়েছে ২ লাখ ৫৪ হাজার ৯৯ টাকা। বর্তমানে ঋণখেলাপি রয়েছে ৮ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। তবে ২০২২ সালের ২৮ জুন ওই সমিতির ম্যানেজার বিপ্রদাশ বাছাড় হাত স্লিপের মাধ্যমে পরিদর্শক মো. শাহজালালের কাছে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা প্রধান করলেও তা ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়নি।
অনিয়মের মূল হোতা প্রধান পরিদর্শক
গত কয়েক বছর ধরে এভাবে ঋণের টাকা আত্মসাৎ করে আসছেন পরিদর্শকরা। আর তাদের নেতৃত্বে রয়েছেন প্রধান পরিদর্শক মো. শাহজালাল। তবে তাদের বিরুদ্ধে বিআরডিবি থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. হাসান ইমাম বলেন, ‘আমি ২০২২ সালের ১৯ অক্টোবর ডুমুরিয়া উপজেলায় যোগদান করি। যোগদানের পর থেকে খেলাপি ঋণ আদায়ে উদ্যোগ নেই। এতে তিন পরিদর্শক ক্ষিপ্ত হন আমার ওপর। এ বিষয়ে গত ২৬ সেপ্টেম্বর ডুমুরিযা থানায় প্রধান পরিদর্শক মো. শাহজালাল, পরিদর্শক সৈয়দ মসিউর রহমান ও রথিন তরফদারের নামে সাধারণ ডায়েরি করেছি।’
ডুমুরিয়া থানা সূত্রে জানা গেছে, ওই সাধারণ ডায়েরি বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে প্রধান পরিদর্শক মো. শাহজালাল বলেন, ‘উপজেলা কর্মকর্তা মো. হাসান ইমামের সঙ্গে আমাদের পরিদর্শকদের সঙ্গে একটু মনোমালিন্য হয়েছে। যার কারণে তিনি ওইসব ঋণ তথ্য জোগাড় করছেন। বাস্তবে আমরা টাকা আত্মসাৎ করিনি। করোনার কারণে কিছু গ্রাহক টাকা দিতে পারেনি। যার কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত সাড়ে ৪ বছর ডুমুরিয়া উপজেলায় একাধিক পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে। তবে খুলনা জেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তার দায়িত্বে বহাল রয়েছেন এ কে এম আশরাফুল ইসলাম। আর এই ঋণ বিতরণ ও আদায়ের অনিয়মগুলি হয়েছে তার সময়েই।বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঋণখেলাপির ঘটনা নিয়ে প্রধান কার্যালয় থেকে তদন্ত চলছে। যারা দোষী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে বাংলাদেশ পল্লি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক আব্দুল গাফ্ফার খান বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, ‘যারা উপকারভোগী বা গ্রাহক তারা যদি প্রসঙ্গটি নিয়ে আমার কাছে অভিযোগ দেয়, তবে তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়