অবৈধ ব্যাটারি রিকশার দৌরাত্ম্য : দৈনিক ৭০ লাখ টাকার ভাগবাটোয়ারা


চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : নগরীর অলিগলি দাবড়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। অবৈধ এসব যানের কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। অপচয় হচ্ছে বিদ্যুতের। এসব ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে মাঝেমধ্যে অভিযানও চালায় পুলিশ। তবে এতে কোনো কাজ হয় না। স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী ও পুলিশের কিছু অসাধু সদস্যের যোগসাজশে এখন পুরো নগরজুড়ে দেদারসে চলছে এসব নিষিদ্ধ পরিবহন। এক্ষেত্রে অবৈধ এসব গাড়ি চলতে দেয়া বাবদ নগরীতে প্রতিদিন চাঁদাবাজি হয় কমপক্ষে ৭০ লাখ টাকা।
সূত্রমতে, কোনো রকম সরকারি অনুমোদন ও রাজস্ব আদায় ছাড়াই চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করছে। দৈনিক অটোরিকশা প্রতি ১৩০-১৪০ টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও আবার এই চাঁদার পরিমাণ ১৭০-১৮০ টাকা। এক শ্রমিক নেতা বলেন, ‘পুরো নগরীতে সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ হাজারের মতো ব্যাটারি রিকশা চলাচল করছে।
প্রতিটি গাড়ি থেকে গ্যারেজ মালিকরা চাঁদা বাবদই ১৪০-১৮০ টাকা কেটে রাখেন। যা দৈনিক চাঁদা আদায় হয় ৭০ লাখ টাকা। মাসে যার পরিমাণ ২১ কোটি এবং বছরে ২৫২ কোটি টাকা। এর টাকাগুলো গ্যারেজ মালিক, লাইনম্যান, নেতা ও পুলিশের মধ্যে ভাগ হয়। এরমধ্যে নেতার অংশ সবচেয়ে বড়। এরপর পুলিশের ভাগ।’
সরজমিন দেখা যায়, চান্দগাঁও, বাকলিয়া, বায়েজিদ, খুলশী, কোতোয়ালি, পাহাড়তলী, হালিশহর, আকবরশাহ থানা এলাকায় সবচেয়ে বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশা। এরমধ্যে চান্দগাঁও থানাধীন মৌলভীবাজার থেকে কালুরঘাট ব্রিজ এবং ওয়াসা রোড, পাঠাইন্না গোদা থেকে হামিদচর, ওসমানিয়াপুল থেকে সিএন্ডবি এর আশেপাশের পুরো এলাকা মিলে ১০-১২ হাজার ব্যাটারি রিকশা চলাচল করছে। ওইসব এলাকায় রিকশা নিয়ন্ত্রণ করেন মো. বেলাল, মহিউদ্দিন, লিটন, ইসমাঈলসহ কয়েকজন। তারা স্থানীয়ভাবে যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
বাকলিয়া থানাধীন এক্সেস রোড, চকবাজার ধুনিরপুল থেকে সৈয়দ শাহ রোড ও বড় কবরস্থান হয়ে পুলিশ বিট, আব্দুল লতিফ হাট থেকে চেয়ারম্যান ঘাট এবং আন্দরকিল্লা ও টেরিবাজার থেকে কালামিয়া বাজার পর্যন্ত ৫ হাজার রিকশা নিয়ন্ত্রণ করছেন দেলোয়ার, মনিকা হিজড়া, লাকি হিজড়া, আব্দুল কুদ্দুস, মো. ইসমাঈল, ইব্রাহিম তোহান, শফিক কোম্পানি, হানিফ কোম্পানিসহ ৮-১০ জন গ্যারেজ মালিক।
চকবাজার এলাকার ডিসি রোড, কে.বি আমান আলী রোড, নবাব সিরাজউদ্দৌলা রোড এবং এক্সেস রোডে চলাচল করে কয়েক হাজার ব্যাটারি রিকশা। খুলশী থানাধীন জালালাবাদ থেকে ওয়্যারলেস হয়ে সেগুনবাগান রেলস্কুল ও মামা-ভাগিনার মাজার পর্যন্ত, বিজিএমইএ ভবনের সামনে থেকে ঝাউতলা বাজার হয়ে আমবাগান রেলগেট ও সাউদার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে থেকে পলিটেকনিক মোড় পর্যন্ত ৪/৫ হাজার ব্যাটারি রিকশা চলাচল করছে। ওই এলাকায় মো. জামাল উদ্দিন ও এরশাদ এসব রিকশা নিয়ন্ত্রণ করেন। বায়েজিদ, খুলশী এলাকা ও পাঁচলাইশের হিলভিউসহ আশেপাশের এলাকার নিয়ন্ত্রণ করেন মো. এনাম নামের একজন।
বায়েজিদ থানাধীন জামশেদ শাহ মাজার রোড, কুলগাঁও আবাসিক এলাকা হতে খাজা রোড, অক্সিজেন মোড় থেকে আতুরার ডিপু, চন্দ্রনগর, আরেফিন নগর, বাংলা বাজার টেক্সটাইল মোড় ও হিলভিউ আবাসিক এলাকা, রৌফাবাদ কলোনি, বাংলাবাজার বশর কোম্পানির গ্যারেজ পর্যন্ত ৩-৪ হাজার ব্যাটারি রিকশা সামসু নামের একজনের নিয়ন্ত্রণে চলছে। নগরীর হালিশহর ও পাহাড়তলী থানাধীন ফইল্যাতলী বাজার থেকে সবুজবাগ পেট্রোল পাম্পের মুখ, হালিশহর বি-ব্লক শাহজাহান বেকারির সামনে থেকে আশপাশের পুরো এলাকা, শারীরিক শিক্ষা কলেজ থেকে সাগরপাড়, বণিকপাড়া হরি মন্দির, আইয়ুব খানের গ্যারেজ থেকে পাহাড়তলী থানা এলাকার সাগরিকা রোড, বেপারিপাড়া কাসেম কোম্পানির গ্যারেজ হয়ে আগ্রাবাদ আবাসিক এলাকার ২৯টি সড়ক পর্যন্ত ১৫ হাজারের অধিক ব্যাটারি রিকশা চলাচল করছে। এ ছাড়া আকবর শাহ এলাকায় সবুজের নিয়ন্ত্রণে পাঁচ শতাধিক ব্যাটারি রিকশা চলছে। হালিশহর-পাহাড়তলী থানা এলাকায় ব্যাটারি রিকশা নিয়ন্ত্রণ করেন ছানা উল্লাহ ও রণজিৎ দেবনাথ।
চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্যাটারিচালিত রিকশায় কম পরিশ্রমে বেশি আয় হয়। ফলে পায়েচালিত রিকশা যতটুকু দূরত্বে ৪০ টাকা হাঁকে, সেখানে ব্যাটারিচালিত রিকশা ২০-২৫ টাকায় রাজি হয়ে যায় এবং দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছায়। অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা আরেকবার যাত্রী নিতে পারেন। তবে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানো, অধিক যাত্রী পাওয়ার আশায় চালকদের বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো এবং ওভারটেকিংয়ের প্রবণতা রয়েছে বলেও চালকরা স্বীকার করেন। রিকশাচালক ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যাটারির রিকশা সারাদিন চালানো লাগে না। আধবেলা চালালেই ১৫-১৬টা ট্রিপে ৫০০ টাকার মতো থাকে। এখন গ্যারেজগুলাতে ব্যাটারি রিকশা বেশি। আর এই রিকশা চালাতেও আরাম। অবৈধের বিষয়টা গ্যারেজ মালিক জানে।’
তবে মালিকরা লাভবান হলেও ব্যাটারিচালিত রিকশায় চড়তে গিয়ে ঝুঁকিতে পড়ছেন যাত্রীরাই। নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের চলাচলের প্রধান বাহন রিকশায় চড়ে প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন অনেকে। রিকশাচালক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সিটিতে চালানো নিষেধ থাকা সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে চালাচ্ছি। অনেক সময় পুলিশ জরিমানা করে রেকার বিল করে। তারপরও এসব মিটিয়েই চালাতে হয়। দায়িত্বরত পুলিশ সার্জেন্ট সুখেন চন্দ্র দে জানান, আমাদের বিভাগের প্রধান সড়কে এই রিকশা দেখতে পাবেন না। প্রতিদিন ২০-৩০টা রিকশা ধরে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি। এসব ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আটক করার সময় আমাদের ট্রাফিক পুলিশের উপর হামলার ঘটনাও ঘটে। আমরা ঝুঁকি নিয়ে এসব অটোরিকশা আটক করি।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ মাসুদ আহাম্মদ বলেন, অবৈধ ব্যাটারি রিকশার দৌরাত্ম্য বন্ধে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। এক্ষেত্রে আমাদের নির্দেশনা হলো রাস্তায় এই গাড়ি দেখামাত্রই ধরা, জরিমানা করা। তবে এখানে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। জব্দ গাড়িগুলো রাখার মতো আমাদের পর্যাপ্ত জায়গা (ডাম্পিং প্লেস) নেই। ফলে গাড়ি ধরে জরিমানা করে একদিন পর ছেড়ে দেয়া হয়। যেদিন ধরে সেদিনও ছেড়ে দিতে হচ্ছে। যে কারণে মনে হচ্ছে চালকরা রাস্তায় এই অবৈধ গাড়ি নামানোর সাহস পাচ্ছে। এক্ষেত্রে আমরা সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা ঈদের পর গাড়িগুলো ডাম্পিংয়ের জন্য আমাদেরকে একটা জায়গা দেবেন বলেছেন। আশা করছি এরপর এই বিষয়ে আমরা শক্ত পদক্ষেপ নিতে পারবো। পুলিশ সদস্যদের যোগসাজশে সিএনজি অটোরিকশার এই দৌরাত্ম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই বিষয়ে আমাদের ঠিক জানা নেই। তবে খোঁজ নিচ্ছি। আর আপনার কাছে স্পেসিফিক তথ্য থাকলে আমাকে দিন। আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিবো।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়