কেএনএফ-এর মূল কেন্দ্র বাংলাদেশ, ভারত ও মায়ানমারের সীমান্ত ট্রায়াঙ্গল


ঢাকা প্রতিনিধি : বান্দরবানের থানচি ও রুমায় ব্যাংকে দুর্ধর্ষ ডাকাতি ও থানায় হামলার পর কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে। এ ঘটনার পর থেকে একটি প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই সামনে চলে আসছে। কেএনএফ আসলে কতটা শক্তিশালী? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে।বাংলাদেশ সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হিসেবে বর্ণনা করলেও সংগঠনটি তাদের ফেসবুক পাতায় দাবি করেছে, তারা কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন নয়।কেএনএফ-এর দাবি, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির অন্তত ৬টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে তারা। যদিও দলবদ্ধভাবে তাদের বম হিসেবে প্রচার করছে অনেকে।২০২২ সালের এপ্রিলে আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ করে ফেসবুকে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম উপজেলাগুলোর সমন্বয়ে পৃথক রাজ্য দাবি করে কেএনএফ। তখনই সাংগঠনিক প্রধান হিসেবে নাথান বমের নাম ঘোষণা করে তারা।একই বছর পার্বত্য এলাকায় ‘জঙ্গি বিরোধী’ একটি সমন্বিত অভিযান চালায় নিরাপত্তা বাহিনী। তখন কেএনএফ-এর বিরুদ্ধে জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দিল শারক্বীয়া সদস্যদের দুর্গম পাহাড়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়ার অভিযোগ করা হয়েছিল। ওই অভিযানের পর কেএনএফ-এর সশস্ত্র তৎপরতা খুব একটা দৃশ্যমান ছিল না।এরই মধ্যে গত মঙ্গলবার রাত ৮টার দিকে বান্দরবানের রুমায় উপজেলা প্রশাসন কমপ্লেক্স ভবনে হামলা চালিয়ে সোনালী ব্যাংক থেকে অস্ত্র ও টাকা লুট করে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। এ সময় তারা ব্যাংকের ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এরপর থেকেই ফের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে কেএনএফ। এর পরদিন (বুধবার) দুপুরে থানচি বাজারে সোনালী ও কৃষি ব্যাংকে হামলা চালানো হয়।দুই দিনের অভিযানের পর র্যাবের মধ্যস্থতায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর রুমা বাজারের পাশের এলাকা থেকে নেজাম উদ্দিনকে উদ্ধার করা হয়।কেএনএফ-এর বিরুদ্ধে শুক্রবার থেকেই সাঁড়াশি অভিযানের ঘোষণা দিয়েছে র্যাব। বাহিনীটি বলেছে, অভিযানে ‘পাহাড়ে জঙ্গি বিরোধী অভিযানের মতো সব ধরনের কৌশল’ প্রয়োগ করা হবে।এদিকে স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে, থানচিতে প্রকাশ্য দিবালোকে বাজার ঘিরে দুটি ব্যাংকের শাখায় হামলাকারী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা থানারই দেড় থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থান করে থাকতে পারে বলে তারা মনে করছে।
কেএনএফ কতটা শক্তিশালী
বান্দরবানে এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেছেন, গত কয়েক দিনে ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের ঘটনার দুটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে তারা মনে করেন। প্রথমত, টাকা লুট ও অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া এবং দ্বিতীয়ত নিজেদের সক্ষমতা প্রদর্শন করা।সক্ষমতা বলতে কেএনএফ-এর শক্তি বা সামর্থ্যের কথা বোঝানো হলে এই প্রশ্নও আসে যে, কেএনএফ প্রকৃত অর্থে কতটা শক্তিশালী।সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কেএনএফ তাদের অস্ত্রের মজুত বাড়িয়েছে। শক্তি বৃদ্ধি করেছে তাদের সশস্ত্র শাখার। কয়েকটি গ্রুপে ভাগ হয়ে তারা ধারাবাহিকভাবে হামলা করছে।আগের তুলনায় ৩-৪ গুণ সদস্য বাড়িয়ে কেএনএফ এখন আরও দুর্ধর্ষ। তাদের সক্রিয় নারী সদস্যরা ব্যাংক ডাকাতি ও থানচি থানায় হামলায় সরাসরি অংশ নেয়। সংগঠনটির সশস্ত্র শাখাকে চিহ্নিত করার জন্য একাধিক টিম গঠন করেছে পুলিশ।রুমা ও থানচিতে হামলার ঘটনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ওই ঘটনার জন্য কেএনএফকে অভিযুক্ত করেছেন। তবে কেএনএফ এ বিষয়ে এখনও কোনো বক্তব্য দেয়নি।কেএনএফ বা কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন’ হিসেবে বিবেচনা করছে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী।থানচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন জানান, তাদের ধারণা থানচিতে হামলাকারী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা থানার দেড়-দুই কিলোমিটারের মধ্যেই অবস্থান করছে।তিনি বলেন, পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে যা বুঝতে পারছি তাতে আমাদের মনে হয় আশেপাশের পাহাড়ে তারা আছে। তবে তাদের এমন কোনো শক্তি নেই যা নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হবে। একটা পরিস্থিতি হয়েছে সেটি মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বান্দরবানের শান্তি আলোচনা বিষয়ে কেএনএফ-এর বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ হয়েছিল তাদের কয়েকজন ধারণা দিয়েছেন, কেএনএফ-এর সামরিক শাখার সদস্য সংখ্যা সাড়ে তিনশ থেকে চারশর মতো হতে পারে।
কেন এই হামলা
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে শুরু করা কেএনএফ ২০২২ সালের শেষ দিকে ফেসবুকে বেশ সক্রিয় ছিল। তখন ফেসবুকে ও ইউটিউব পোস্টে কেএনএফ তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ ছাড়াও শুরু থেকেই সরকার ও জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিয়েছিল।তারও আগে তারা ফেসবুকে জানিয়েছিল, তাদের একটি কমান্ডো দলও আছে, যার নাম হেড হান্টার কমান্ডো টিম।ওই বছরের জুলাই মাসে ফেসবুকে কেএনএফ জানায়, তাদেরে একদল কমান্ডো মিয়ানমারের কাচিন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এসেছে। এরপর অগাস্টে সামরিক পোশাক পরিহিত একদল ব্যক্তির ছবি দিয়ে কেএনএফ দাবি করে তারাই তাদের কমান্ডো।পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকা নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম মনে করেন, কেএনএফ-এর শক্তি ও সমর্থন খুব একটা আছে বলে তিনি মনে করেন না।তিনি বলেন, তবে আমার মনে হয় তাদের যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়ায় তারা একটু বড় হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। পরে জঙ্গি ইস্যুটি সামনে আসার পর কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে এসেছে। আবার কেএনএফ আলোচনায় আসায় হয়তো আত্মতুষ্টি তৈরি হয়েছে। সেই সুযোগেই এবারের ঘটনা ঘটেছে।তবে কেউ কেউ আবার মনে করেন, বান্দরবানের শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সঙ্গে আলোচনায় আসার কারণে কেএনএফ-এর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবারের হামলার একটি কারণ হতে পারে।এমদাদুল ইসলাম বলেন, বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর মধ্যে এটা বিশ্বজুড়ে দেখা যায়। মূল নেতৃত্ব সরকারের সঙ্গে আলোচনায় যেতে চাইলে তার পরবর্তী ধাপ বা অন্য স্তর থেকে আঘাত আসে। তারা হয়তো ভাবে সমঝোতা হয়ে গেলে তাদের আর অর্জন কী থাকলো। তার মতে রুমা ও থানচির ঘটনায় সেটিও একটি কারণ হতে পারে।বান্দরবানের শান্তি আলোচনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলছে, তাদের ধারণা, শান্তি আলোচনা ঘিরে কেএনএফ-এর সামরিক ও রাজনৈতিক শাখার মধ্যে বিরোধ তৈরি হতে পারে। তবে এরও কোনো প্রমাণ নেই।
আঞ্চলিক আশীর্বাদ থাকতে পারে কি না
কেএনএফ-এর সঙ্গে ভারতের মিজোরাম ও মিয়ানমারের কুকিদের যোগসূত্রের কথা শোনা গেলেও তার দৃশ্যমান প্রমাণ খুব বেশি দেখা যায় ননা। আবার আরাকান আর্মির সঙ্গে কেএনএফ-এর সখ্যতা সহজ নয়। কারণ, ঐতিহাসিকভাবেই কুকি ও মগদের মধ্যে বন্ধুত্বের চেয়ে সংঘর্ষই হয়েছে বেশি।এমদাদুল ইসলাম বলেন, মিজোরামে বম জনগোষ্ঠীর অবস্থান আছে। তবে বাংলাদেশে এসব করার জন্য কেএনএফ তাদের আশীর্বাদ পাচ্ছে বলে মনে হয় না।তিনি বলেন, মিজোদের সঙ্গে এখানকার বমদের মিল আছে। কেএনএফ-এর শীর্ষস্থানীয় কেউ কেউ সেখানে যেতেও পারেন। আবার মিয়ানমারের আরাকান আর্মিও তাদের ব্যবহার করতে পারে বা যোগসূত্র তৈরি করতে পারে। কিন্তু এগুলো এখনও নিছক ধারণা।তবে বান্দরবানের কয়েকটি সূত্র বলছে, কেএনএফ-এর মূল কেন্দ্র বাংলাদেশ, ভারত ও মায়ানমারের সীমান্ত ট্রায়াঙ্গল। সেখানেই জিরো পয়েন্টে তাদের অবস্থান এবং তারা বাংলাদেশের ভেতরেই সক্রিয় থেকে কাজ করে বলে দাবি করেছে কয়েকটি সূত্র।এসব সূত্রের দাবি, ২০২২ সালে পাহাড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের পর থেকে কেএনএফ বড় ধরনের অর্থ সংকটে পড়ে। এ কারণে সংগঠনটির একটি অংশ ব্যাংক ডাকাতির পরিকল্পনা করে থাকতে পারে। আর অন্য কোনো বিষয়ে অসন্তোষ থাকলে সেটি কেএনএফ-এর দিক থেকে আগামী ২২ এপ্রিল অনুষ্ঠেয় তৃতীয় সরাসরি আলোচনায় তুলে ধরার সুযোগ ছিল।
কেএনএফ’র প্রশিক্ষণ মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশে
বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিচ্ছে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) বিশেষ ট্রেনিংপ্রাপ্ত অন্তত একশ কমান্ডো। মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশে প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা বাংলাদেশে এসেছে। সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র জানিয়েছে এ কথা।সূত্রটি জানায়, কেএনএফের ওই বিশেষ কমান্ডো দলের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ফেরোসিয়াস ওয়াইল্ড-বোর’ (এফডব্লিউবি)। মিয়ানমারের কাচিন প্রদেশে কাচিন বিদ্রোহীদের কাছে কমান্ডো ট্রেনিং নিয়ে গত মার্চের মাঝামাঝি তারা বান্দরবানে ফিরে আসে। তারপর ব্যাংক ডাকাতি, থানা ও বাজারে আক্রমণ এবং উপজেলা সদরে ত্রাস সৃষ্টি করে।কেএনএফের তথ্য ও ইন্টেলিজেন্স উইংয়ের কর্নেল সলোমন গত শুক্রবার সমকালের কাছে তাদের কমান্ডো দল মিয়ানমারে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফেরার কথা স্বীকার করেন। তবে আর কোনো কথা বলতে রাজি হননি তিনি। কেএনএফের এই কমান্ডোরা দ্রুত কোথাও হামলা চালাতে সক্ষম বলে জানিয়েছে সংগঠনটির একটি সূত্র।আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, ‘ফেরোসিয়াস ওয়াইল্ড-বোর’ সদস্যদের বয়স ১৮ থেকে ২২ বছরের মধ্যে। কেএনএফের বাছাই করা সদস্যদের নিয়ে এই কমান্ডো টিম গঠন করা হয়েছে। তাদের বেশির ভাগের বাড়ি রুমায়। তবে অল্প কয়েকজন রয়েছে থানচির। গত ডিসেম্বরে তারা কাচিন প্রদেশে যায়। সেখানে কমান্ডো প্রশিক্ষণ শেষে মার্চের প্রথম সপ্তাহে বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে ফেরে। তাদের অনেকের হাতেই রয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্র।স্থানীয়রা বলছেন, কমান্ডো দলের নেতৃত্বেই রুমা ও থানচিতে প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে ব্যাংক ডাকাতি ও পুলিশ-আনসারের অস্ত্র লুটের ঘটনা ঘটে। রুমা ও থানচি বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, গত ৫০ বছরে তারা এমন ভয়ংকর ঘটনা দেখেননি। কেএনএফ পাহাড়ে ভয়াবহ তাণ্ডব চালিয়েছে।এদিকে শনিবার কেএনএফ চুক্তি ভঙ্গ করে সংঘাতে জড়ানোর ব্যাপারে একটি বিবৃতি দিয়েছে। কেএনএফ সেখানে ১০টি বিষয় তুলে ধরেছে। তার মধ্যে রয়েছে, কেএনএফ সদস্য নয় এমন নিরীহ গ্রামবাসীকে কারাগার থেকে এক মাসের মধ্যে পর্যায়ক্রমে মুক্তি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চার-পাঁচ মাস পরও তা হয়নি।
দু বছর আড়ালে কেএনএফ শীর্ষ নেতা নাথান বম
কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সশস্ত্র গ্রুপের শীর্ষ নেতা নাথান বম বছর দুয়েক ধরে নিজেকে আড়ালে রেখেছেন। বর্তমানে তিনি ভারতের মিজোরামে অবস্থান করছেন বলে জানা যাচ্ছে। বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে ব্যাংক ডাকাতি ও থানায় হামলার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে স্নাতক করা নাথান আবার আলোচনায়। এই হামলার নেপথ্যে তিনি রয়েছেন বলে ধারণা অনেকের।নাথানকে গ্রেপ্তারে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সহায়তা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বাংলাদেশ। তাঁর বিরুদ্ধে থাকা মামলা ও অপকর্মের তথ্য যুক্ত করে শিগগির ইন্টারপোলকে চিঠি দেওয়া হবে। এর পর রেড নোটিশ জারির প্রক্রিয়া শুরু হবে। নাথান যাতে বিশ্বের অন্য কোনো দেশে নির্বিঘ্নে পালিয়ে থাকতে না পারেন, এটা নিশ্চিত করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। রাত পর্যন্ত ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশি ৬৪ জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ ছিল। পাহাড়ে গোপন আস্তানায় নিয়ে জামায়াতুল আনসার আল ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার নামে জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ঘটনায় নাথানের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে। চুক্তি করে টাকার বিনিময়ে ওই প্রশিক্ষণের আয়োজন করছিলেন চারুকলার প্রাক্তন ছাত্র নাথান। শনিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বান্দরবান পরিদর্শনে যান। সেখানে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন মন্ত্রী। ওই বৈঠকে নাথানের কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে নাথানের ব্যাপারে ইন্টারপোলের সহায়তা নেওয়ার বিষয়টি উঠে আসে। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন।
শান্তি আলোচনা প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে হঠাৎ কেএনএফের শক্তির মহড়ায় পাহাড়ের সাধারণ বম সম্প্রদায়ের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। পরপর কয়েকটি ঘটনার কারণে স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হচ্ছে। জরুরি কারণ ছাড়া অনেকে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। কেএনএফের এমন কর্মকাণ্ডে তাদের সাধারণ জীবনযাপন প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করেছেন অনেকে। বম সম্প্রদায়ের অনেকে আবার কেএনএফের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতেও ভয় পাচ্ছেন। কারণ, এর আগেও কেএনএফ সদস্যরা সাধারণ বম জনগোষ্ঠীর কয়েকজনকে অপহরণ করে হত্যা করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘চর’ সন্দেহে তাদের ওপর আক্রমণ করা হয়েছিল। তবে হঠাৎ কেএনএফ এত শক্তি ও অস্ত্র কোথায় পেল, এ নিয়ে তাদের মধ্যেও আছে নানা প্রশ্ন।
বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি জারলম বম বলেন, পাঁচ মাস আগে নাথানের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়েছিল। তখন তিনি মিজোরামে অবস্থান করছেন বলে দাবি করেন। তিনি অনেক দিন ধরেই পলাতক। তবে তার গ্রুপের লোকজন পাহাড়ে আছে। কেএনএফকে শান্তি আলোচনায় আনতে প্রথম দফা যে বৈঠক হয়েছিল, তার আগেই নাথানের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। বৈঠকে কেএনএফের পক্ষ থেকে কারা থাকবে, সেটা ঠিক করে দিয়েছিল নাথান। এর পর দীর্ঘদিন থেকে তিনি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক লালথেন বম শান্তি আলোচনা কমিটির ১৮ সদস্যের অন্যতম। তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে নাথান বমের এক মাস আগে কথা হয়। কেএনএফ যে ছয় দফা দাবি জানিয়ে আসছে, বাস্তবে তা পূরণ করা অসম্ভব বলে নাথানকে জানিয়েছি।’
বম সম্প্রদায়ের আরেক বাসিন্দা লালভেন বম বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে সাধারণ বমরা ভীতিকর অবস্থার মধ্যে রয়েছে। কেএনএফের ভয়ে কেউ কেউ মুখ খুলতে চায় না। কথা বললে তাদের বাড়িঘরে হামলা হতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।পাহাড়ের আরও একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পার্বত্য এলাকায় বম সম্প্রদায়ের প্রায় ১৫ হাজার বাসিন্দা। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মিজোরামের দিকে চলে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে ভর্তি হওয়ার পরপরই বম সম্প্রদায়ের মধ্যে নাথান বমের পরিচিতি বাড়ে। পাঁচ ভাই ও এক বোন তার। ভাইবোনের মধ্যে নাথান সবার ছোট। তার স্ত্রী লেলসমকিন বম বান্দরবানের রুমা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নার্স হিসেবে কর্মরত। তবে নাথানের সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে– এমন আলোচনা এলাকায় রয়েছে।
কেউ কেউ আবার বলছেন, সরকারি চাকরি থেকে যাতে ইস্তফা দিতে না হয়, এ কারণে নাথানের সঙ্গে বিয়েবিচ্ছেদের কথা প্রচার করে আসছেন তার স্ত্রী। এ ছাড়া নাথানের আরেক ভাই বান্দরবানের সোনালী ব্যাংকে চাকরি করতেন। মাস পাঁচেক আগে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন, এখনও কারাগারে আছেন। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সন্দেহজনক লেনদেনের কারণে দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় তাকে।আরেকটি সূত্র জানায়, বান্দরবানের রুমা সুসাং ও সিমপ্ল্যাকিংপাড়া থেকে কয়েক মাস আগে বম সম্প্রদায়ের ১২-১৫ জন তরুণী ঘর ছাড়ে। স্থানীয়দের ধারণা, কেএনএফের সশস্ত্র গ্রুপ কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএ) সঙ্গে প্রশিক্ষণ নিতে তারা ঘর ছেড়েছে। সম্প্রতি বান্দরবানে দুর্ধর্ষ ডাকাতি ও থানায় হামলায় কেএনএফের নারী সদস্যদের অংশ নিতে দেখা গেছে।সাধারণ বম সম্প্রদায়ের মধ্যে অর্থনৈতিক ও শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া পরিবারের সদস্যদের টার্গেট করে থাকে কেএনএফ। বমপাড়ার কোনো বাসিন্দাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যদাতা বলে সন্দেহ হলে কেএনএফ তাদের ঘরবাড়িতে হামলা চালায়। ধান-চাল ও গৃহস্থালির জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। আবার অনেকের বাসায় গিয়ে খাবার ও পানি দেওয়ার জন্য চাপ দেয় তারা।নাথান বমের সঙ্গে পড়াশোনা করা এক পাহাড়ি নাগরিক বলেন, ২০১৮ সালে শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে বান্দরবানের একটি গির্জায় বড় ধরনের অনুষ্ঠান করা হয়। সেখানে নাথান বম উপস্থিত ছিলেন। সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথাবার্তা বলেছিলেন। তখনও কেউ ধারণা করতে পারেনি ধীরে ধীরে একটি সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের শীর্ষ নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করে কিছুদিন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরির চেষ্টা করেন নাথান। এর পর একটি এনজিও চালান।
নাথান বম পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যার দিকে থেকে পঞ্চম স্থানে বম জনগোষ্ঠীর সদস্য। এই জাতিগোষ্ঠীর প্রায় সবাই খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী। বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার এডেনপাড়া সড়কে নাথানের পৈতৃক নিবাস।জনশ্রুতি রয়েছে, ২০১৭ সালের দিকে বম সম্প্রদায়ের ৪০ সদস্যকে মিয়ানমারের কোচিন রাজ্যে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠান নাথান। তারা ফেরত আসার পর পরই নাথান গোপন তৎপরতা শুরু করেন। তিনি ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র জমাও দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই মনোনয়নপত্র বৈধ হয়নি। নাথানের আর নির্বাচনও করা হয়নি। ২০২২ সালের দিকে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে একটি আলাদা রাজ্য গঠনের ঘোষণা দেন তিনি। এর পর কেএনএফের কর্মকাণ্ডের নানা ছবিও পোস্ট করতে থাকেন।
এদিকে একাধিক সূত্র জানায়, বান্দরবানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর রুদ্ধদ্বার বৈঠকে কেএনএফের কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা আলোচনা হয়। সেখানে উঠে আসে অর্থ সংগ্রহ করতেই কেএনএফ ডাকাতি করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ হিসেবে বলা হয়, অর্থ সংগ্রহ তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য না হলে সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার নেজাম উদ্দিনকে অপহরণের পর তারা মুক্তিপণ দাবি করত না। কেএনএফের অন্য উদ্দেশ্য মুখ্য হলে ম্যানেজারকে জিম্মি করে দেনদরবার করা। অতীতে অর্থ সংগ্রহের জন্য কেএনএফ নানা অপকর্মে জড়িয়েছে। এ ছাড়া কেএনএফ হঠকারী একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে সংগঠনের পরিচিতি বাড়াতে চেয়েছে। এর উদ্দেশ্য হতে পারে– পরবর্তী সময়ে দেশি-বিদেশিদের ‘নজর’ অব্যাহত রাখা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বান্দরবানে পুলিশ, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য বাড়ানোর বিষয়টিও আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে উঠে আসে।র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) কর্নেল মাহাবুব আলম বলেন, ডাকাতি ও থানায় হামলায় জড়িত সবাইকে শনাক্ত করা হবে। প্রযুক্তিগত তথ্য বিশ্লেষণ ও গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তাদের আইনের আওতায় আনব। বান্দরবানের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। র্যাবের ফোর্স এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতা সেখানে বাড়ানো হয়েছে।রুমা থানার ওসি শাহ জাহান বলেন, লুট হওয়া ১৪টি অস্ত্র দ্রুত উদ্ধারে জোর দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য যৌথ অভিযানও চলছে।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়