খুলনায় ৫০৮ কোটি টাকার কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাহাবুব ব্রাদার্স


ইত্তেহাদ নিউজ,খুলনা : পদ্মা সেতু হয়ে খুলনা মহানগরীতে প্রবেশের অন্যতম মাধ্যম রূপসা সেতু হয়ে শিপইয়ার্ড সড়ক। এ ছাড়া জিরোপয়েন্ট দিয়ে গল্লামারী সড়ক এবং তেলিগাতি হয়ে কুয়েট অ্যাপ্রোচ সড়ক দিয়েও নগরীতে প্রবেশ করা যায়। নগরে প্রবেশের প্রধান তিন সড়কের কাজ করছে সরকারি তিনটি সংস্থা।সড়ক ও সংস্থা তিনটি হলেও কাজ করছে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘মাহাবুব ব্রাদার্স’। ধীরগতির কাজে তিনটি সড়ক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভুগছে মানুষ। জানা গেছে, খুলনা সিটির মেয়র এবং ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারের। এ কারণে তারা কাজ বাস্তবায়নকারী সরকারি সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পাত্তা দেন না। চাকরি হারানোর ভয়ে তারা ঠিকাদারকে বেশি চাপও দিতে পারেন না।সম্প্রতি শেরেবাংলা সড়ক চার লেন এবং জিরোপয়েন্ট সড়কের মূল কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু অন্য সড়ক দুটির কাজ এখনও স্থবির। ভাঙাচোরা সড়কের কারণে দুর্ভোগ ওই এলাকার মানুষের নিত্যসঙ্গী।তিনটি সড়কের মতো মাহাবুব ব্রাদার্সের সব ঠিকাদারি কাজের গতিই মন্থর। সময়মতো কাজ না করায় প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে বিপাকে পড়েছে বাস্তবায়নকারী সরকারি সংস্থাগুলো। এর মধ্যে খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণে ধীরগতির কারণে চটেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। রীতিমতো সভা করে ৩০ জুনের মধ্যে কাজ শেষ না হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (কেডিএ) শিপইয়ার্ড সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণে ধীরগতি নিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একনেকের বৈঠকে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। সড়কের কাজ তদারকি করতে দুই দফা খুলনা এসেছেন গণপূর্ত সচিব। এরপরও কাজে গতি আসেনি। সড়কের জন্য প্রতি মাসেই মন্ত্রণালয়ের কড়া বাক্যবাণে জর্জরিত প্রকল্পের কর্মকর্তারা।
এ ছাড়া কেডিএর নতুন বিপণিবিতান এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) নির্মাণ নিয়েও সংশ্লিষ্টদের ভোগাচ্ছে এই ঠিকদারি প্রতিষ্ঠান।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেসিসি, কেডিএ, সড়ক বিভাগ ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬টি উন্নয়নকাজ এখন মাহাবুব ব্রাদার্সের নিয়ন্ত্রণে। এসব কাজে বরাদ্দ ৫০৮ কোটি টাকা।এর মধ্যে কেডিএর শিপইয়ার্ড সড়ক চার লেন প্রকল্পের আওতায় সড়ক, ড্রেন ও ফুটপাত, একটি ব্রিজ, একটি স্লুইসগেট নির্মাণের কাজ পেয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে কেডিএ। শুরুতে চুক্তি মূল্য ছিল ১৪৩ কোটি টাকা। পরে সেটি বাড়িয়ে ১৫৪ কোটি টাকা করা হয়।কেডিএর খুলনা নিউমার্কেটের পাশে নতুন বিপণিবিতান নির্মাণের কাজও পেয়েছে মাহাবুব ব্রাদার্স। ২০২৩ সালের জুনে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। দোতলা বেজমেন্টসহ ৫ তলা বিপণিবিতান নির্মাণের চুক্তি মূল্য ৯৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
কেসিসির আধুনিক বর্জ্য পরিশোধন কেন্দ্র এবং কুয়েট অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণের কাজও পেয়েছে মাহাবুব ব্রাদার্স। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে তাদের সঙ্গে কেসিসির চুক্তি হয়। এই কাজের মূল্য ৭৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ভবন নির্মাণের কাজও করছে তারা। ২০২২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি কাজ উদ্বোধন হয়। এর ব্যয় ৫৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।সড়ক বিভাগের শেরেবাংলা সড়ক চার লেন এবং জিরোপয়েন্ট মোড় উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের দুটি কাজও মাহাবুব ব্রাদার্সের। দুটি কাজের মূল্য ১২৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
প্রতিটি কাজেই ধীরগতি, ভোগান্তি
খুলনা শিপইয়ার্ড সড়কটি নিয়ে প্রায় ১১ বছর ধরে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন ওই এলাকার মানুষ। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে মাহাবুব ব্রাদার্স কাজ শুরু করলে আশার সঞ্চার হয়েছিল এলাকাবাসীর মনে। অবশ্য সেটি ভাঙতে সময় লাগেনি। গত দুই বছরে সড়কে প্রথম ধাপের কাজই শেষ হয়নি। ভাঙাচোরা সড়কে এখনও হেলেদুলে চলছে যানবাহন। দুই পাশে ড্রেন, ফুটপাতের অনেক কাজ এখনও বাকি। ব্রিজ ও স্লইসগেটের পাইলিং হলেও মূল কাজ এখনও শুরু হয়নি।বিপণিবিতানের কাজ শেষ করার কথা রয়েছে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে। কিন্তু এখনও পাইল তৈরিই শেষ হয়নি। গত ৩০ মার্চ পর্যন্ত ২ হাজার ৪১০টি পাইলের মধ্যে ১ হাজার ৯১০টি তৈরি হয়েছে। গত ২৫ মার্চ বেজমেন্টের মাটি কাটার কাজ শুরুর কথা। তা এখনও হয়নি। নির্ধারিত সময়ে এই কাজও শেষ না হওয়ার আশঙ্কা করছেন কেডিএ কর্মকর্তারা।কেসিসির আধুনিক বর্জ্য পরিশোধন কেন্দ্র এবং কুয়েট অ্যাপ্রোচ রোডের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ২৬ জানুয়ারি। পরিশোধন কেন্দ্রের কাজ হয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ। কুয়েট অ্যাপ্রোচ রোডের ড্রেন নির্মাণের কাজই শেষ হয়নি। আর সড়ক তো শুরুই হয়নি। ভাঙাচোরা সড়ক নিয়ে প্রতিনিয়ত দুর্ভোগে ভুগছেন ওই এলাকার মানুষ।খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ভবন নির্মাণের কাজও শেষ হওয়ার কথা চলতি এপ্রিলে। তবে এখনও ৪ তলা ভবনের ফাউন্ডেশনই শেষ হয়নি।সড়ক বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন শেরেবাংলা সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল ২০২০ সালের এপ্রিলে। ২০২১ সালের এপ্রিলে এই কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। এর প্রায় দুই বছর পর সম্প্রতি সড়কের কাজ শেষ হয়।একই অবস্থা জিরোপয়েন্ট মোড় উন্নয়নেরও। কাগজকলমে প্রকল্পের কাজ শেষ দেখানো হয়েছে গত ৩১ ডিসেম্বর। কিন্তু দুটি সড়কেরই ড্রেন ও ফুটপাতের বেশ কিছু কাজ এখনও বাকি।
যেভাবে এত কাজ পেল মাহাবুব ব্রাদার্স
এক সময়ে খুলনার স্বনামধন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছিল মাহাবুব ব্রাদার্স। এর চেয়ারম্যান ছিলেন কেসিসির ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর শেখ মজনু। সৎ ব্যবসায়ী ও দানশীল হিসেবে তাঁর সুনাম ছিল। আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে অংশ নিলেও তিনি কোনো পদে ছিলেন না। দলের একজন বড় দাতা হিসেবে বরাবরই আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। ২০২০ সালের ১৯ জুলাই করোনা আক্রান্ত হয়ে শেখ মজনু মারা যান। এরপর তাঁর ছেলে মাহাবুবুর রহমান প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিযুক্ত হন।শেখ মজনুর অকাল মৃত্যুর পর মাহাবুবের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন খুলনার আওয়ামী লীগ নেতারা। এ কারণে একের পর এক বড় ঠিকাদারি কাজ পায় মাহাবুব ব্রাদার্স।সরকারের ৪টি দপ্তরের দরপত্রের নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা করেই প্রতিটি কাজ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে দৃশ্যমান কোনো অনিয়ম দেখা যায়নি। তবে দরপত্রে প্রতিযোগিতা করার জন্য ব্যয় প্রাক্কলন তৈরিতে তিনি প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সহযোগিতা পেতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পূর্ব কাজের অভিজ্ঞতা ভালো এবং সক্ষমতা থাকায় ওই সময় দপ্তর প্রধানরাও নির্ভার ছিলেন। তবে ভুল ভাঙতে বেশি সময় লাগেনি।
কর্মকর্তারা অসহায়
বিভিন্ন দপ্তরের প্রকৌশলীরা জানান, একসঙ্গে অনেক কাজ পাওয়া এবং আর্থিক সংকটে কোনো কাজই সময়মতো শেষ করতে পারছে না ঠিকাদার। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করাও যাচ্ছে না।কর্মকর্তারা জানান, মাহাবুবও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেন। বিশেষ করে খুলনা সিটি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক, খুলনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য এসএম কামাল হোসেনসহ শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে প্রায়ই তাঁকে দেখা যায়। এ কারণে ঠিকাদারকে কোনো নির্দেশনা দিলে তারা তোয়াক্কা করেন না। অনেক সময় প্রকল্পের প্রকৌশলী কোনো ব্যবস্থা নিতে গেলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তা বন্ধ করে দেন। চাকরি ঝুঁকিতে পড়ার ভয়ে কেউই এ বিষয়ে নাম প্রকাশ করে কথা বলতে চাননি।সূত্রটি জানায়, গণপূর্ত সচিব নিজে কয়েক দফা খুলনায় এসেও শিপইয়ার্ড সড়কের গতি বাড়াতে পারেননি। ওয়াসার কারণে মূল সড়কের কাজ কিছুদিন বন্ধ রাখতে হয়েছে। এই সময়ে ড্রেনের স্লাব, ব্রিজ ও স্লুইসগেটের কাজ করতে বললেও তারা শুনছেন না। প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে একই ঘটনা ঘটছে।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
চলমান কাজ নিয়ে প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীরা কেউই বিস্তারিত কথা বলতে রাজি হননি। তবে কাজ নিয়ে সবার চোখেমুখে অসন্তোষ দেখা গেছে।কেসিসির প্রধান প্রকৌশলী মশিউজ্জামান খান বলেন, বর্তমানে কাজের গতি কিছুটা বেড়েছে। ৩০ জুনের মধ্যে কাজ শেষ না করলে তাদের কালো তালিকাভুক্ত করতে মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়েছে।কেডিএর দুই প্রকল্পের পরিচালক জিএম মাসুদুর রহমান ও আরমান হোসেন বলেন, ঠিকাদারকে দ্রুত কাজ শেষ করতে বলা হয়েছে।খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ড. মো. হাসানুজ্জামান বলেন, ২০২৪ সালে তাদের কাজ শেষ করার কথা। এখনও ফাউন্ডেশনই শেষ হয়নি।সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আনিসুজ্জামান মাসুদ বলেন, কিছুটা দেরি হলেও সড়কের মূল কাজ এখন শেষ। বাকি কাজ এ মাসেই শেষ হবে।
মাহাবুব ব্রাদার্সের ভাষ্য
ঠিকাদারি কাজ নিয়ে মাহাবুব ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে অফিসে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তিনি খুব কম সময় অফিসে থাকেন। গত কয়েক দিন ধরে অসংখ্যবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোন ধরেননি।প্রতিষ্ঠানের প্রধান প্রকৌশলী মো. হেদায়েতুল্লাহ সমকালকে বলেন, প্রতিটি কাজ নিয়ে আমরা নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি। বাস্তব কারণে কাজে দেরি হয়েছে। চুক্তির অনেক পরে শিপইয়ার্ড সড়কের জমি বুঝে পেয়েছি। ড্রেন নির্মাণের পরে দেখা গেছে, জমি অন্যের। সেই ড্রেন ভাঙতে হয়েছে। সড়কের সাববেজের কাজ শেষ। ওয়াসা সড়ক খুঁড়ে পাইপ বসাবে এ জন্য কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। ব্রিজের কাজ চলছে।তিনি বলেন, বিপণিবিতানের ওইখানে জায়গা খুব কম। এত পাইল তৈরি করে রাখার জায়গা নেই। তারপরও কাজ চলছে।
তিনি বলেন, কুয়েট অ্যাপ্রোচ রোডের স্থানে মানুষ ড্রেনের ওপর ঘর, সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করেছে। এখন ড্রেন নির্মাণ করতে গেলে সেগুলো ভেঙে পড়ছে। কুয়েটও কিছু জায়গায় কাজে বাধা দিয়েছে। এসব কারণে গতি কম ছিল। তবে ৩০ জুনের মধ্যে এই কাজ শেষ হবে।প্রকৌশলী হেদায়েতুল্লাহ বলেন, সড়ক বিভাগের শেরেবাংলা সড়কের জমি বুঝে পেতে দেরি হয়েছে। কাজ শুরুর পর দেখা গেছে, নকশায় সমস্যা। এর জন্য ৮ মাস কাজ বন্ধ ছিল। এখন কাজ শেষ হয়েছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসির কাজও দ্রুত শেষ হবে।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়