অনুসন্ধানী সংবাদ

ইটভাটায় মানবেতর জীবন, সঙ্গে মজুরি বৈষম্য

109051 vata
print news

ইত্তেহাদ নিউজ,ঢাকা : ৮ ঘণ্টার বেশি কায়িক শ্রম, সাপ্তাহিক ছুটি নেই। কম বেতন হওয়া সত্ত্বেও কাজ হারানোর শঙ্কায় কোনও দাবি-দাওয়ার কথা তোলেন না। দশকের পর দশক একই কাজ করে চলা এই শ্রমিকরা নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার কথা জানেন না। কেবল জানেন এই টাকায় পেট চলে না। কুষ্টিয়ার কয়েকটি ইটভাটায় সরেজমিন গিয়ে কথা হয় ইট ভাটার শ্রমিকদের সঙ্গে। তারা বলছেন, তারা দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন। তবু কোনো সংগঠনের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের কথা বলার বিষয়ে তাদের জানা নেই। ইটভাটায় অমানবিক কষ্টের কাজেও এ হাসি-খুশিটাই তাদের জীবনকে সচল রেখেছে।জেলার মিরপুর উপজেলার মশানের শ্রমিক মহিন উদ্দিন। তার বাড়ি মিরপুর উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে। পরিবারের বাবা মা ও স্ত্রী সন্তান নিয়ে একসাথে বসবাস।

আগে ইট মাথায় করে আনা নেওয়ার কাজ করেন কয়েক বছর। এরপর এখন ইটভাটায় ইট তৈরিতে বেশ পারদর্শী তিনি। প্রতি হাজার ইট তৈরি করলে দিনশেষে পারিশ্রমিক পান ৮০০ টাকা। একটু বেশি উপার্জনের আশায় রাত অবধি কাজ করেন। তাতে করে কোনো কোনো দিন এক হাজার টাকা আয় করেন।

বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা যখন ছুটিতে তখন ইটভাটা শ্রমিকরা গ্রীস্মের কাঠফাঁটা রোদের মধ্যে কাজ করে থাকেন। সকাল পেরিয়ে দুপুরের খরতাপে মাথা থেকে কপাল চুইয়ে মুখ গড়িয়ে পড়ছে ঘাম। সারা শরীর ভেজা। জীর্ণ শীর্ণ শরীরটা দেখলেই বোঝা যায় কেমন খাটুনি খাটতে হয় মানুষগুলোকে।

ইটভাটা শ্রমিক মিনারুল ইসলাম বলেন, সকালে কাজ শুরু করি শেষ করার কোনো সময় নেই। সর্দার যতক্ষণ মনে করেন কাজ করান। কিন্তু বেশি কাজ করলেও বেশি টাকা দেয় না। প্রতিবাদ করলেই বাদ দিয়ে দেয়। তাই দিন শেষে মজুরি ওই ৫০০ টাকাই। এ দিয়ে চাল-ডাল, তরি-তরকারি কিনতে গেলে পকেটে আর টাকা থাকে না। এভাবেই দিন যায়, বছর ঘুরে। কিন্তু বাজারে সব কিছুর দাম বাড়লেও মজুরের মজুরি বাড়ে না’।শ্রমিকরা জানান, বছরের নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ইট বানানোর কাজ করতে হয় তাদের। আর এই কাজটি চুক্তি ভিত্তিতে হয়ে থাকে। এ কাজে আসতে হয় মাঝির (সর্দার) মাধ্যমে। পুরো ছয় মাসের জন্য মালিকের হয়ে মাঝিই শ্রমিকের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করেন।

ইট পোড়ানোর জন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করছিলো বেশ কয়েকজন শ্রমিক। তাদের সাথে কথা হয় মানিক আলী নামের এক শ্রমিকের। তার বাড়ী মিরপুর উপজেলা খন্দকবাড়ীয়া এলাকায়।

মজুরি কেমন জানতে চাইলে মানিক আলী বলেন, রোদে শুকানো ইট ভাটার কাছ থেকে ক্লিনের ভেতর আনা এবং সারিবদ্ধ করে কাঁচা ইট সেটিং করা সেই কাজে মজুরি প্রতি হাজার ইটে ১৫০ টাকা। প্রতি চেম্বার ১৫ হাজার ইট দিয়ে সাজানোর জন্য অন্তত ১০-১২ জন শ্রমিক দরকার হয়। দিনশেষে এসব শ্রমিকের আয় হয় ৪৫০-৫৫০ টাকা।

এভাবেই ধাপে ধাপে প্রক্রিয়া শেষ করে সেসব ইট পোড়ানোর পর তা বাজারজাতকরণ করা হয়ে থাকে। ট্রলিতে করে ইটভাটা থেকে এসব ইট বাড়ী পৌছাতে ট্রলি প্রতি হাজারে ৩৫০-৫০০ টাকা নিয়ে থাকেন ট্রলি চালকেরা। প্রতি ট্রলিতে ২ হাজার ইট আনা নেওয়া করা যায়।

মেসার্স এমবিএ ব্রিকস এর মালিক মুকুল বলেন, শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্দারের সঙ্গে চুক্তি করতে হয়। সর্দার প্রয়োজন অনুযায়ী শ্রমিক নিয়োগ করে৷ শ্রমিকদের নিয়োগ, মুজুরি, ছুটি সব সর্দারই দেখেন।’

এবি ব্রিকসের ম্যানেজার আজাদ জানান, গতবারের থেকে এ বছর ইটের দাম কম। গতবছর ১০ হাজার টাকা ইট বিক্রি হলেও এ বছর ৮ হাজার টাকা বিক্রি হয়েছে। ফলে বেশ লোকসানে পড়তে হচ্ছে আমাদের। তিনি বলেন, আগে শ্রমিকদের অল্প টাকা আয় হলেও এখন বেড়েছে।

জাতীয় শ্রমিকলীগ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও শ্রমিকনেতা আমজাদ আলী খান বলেন, অনেক সংগঠন রয়েছে। তবে ইটভাটায় কর্মরত শ্রমিকদের কোন সংগঠন নেই। যদিওবা নির্মাণ শ্রমিক নামের একটা সংগঠন রয়েছে।

তবে ইটভাটার শ্রম সংগঠন না থাকায় তারা নিষ্পেষিত হতে হয় তাদের। যারা ঘাম ঝরিয়ে শ্রম দিয়ে যায় তারাই হলো শ্রমিক। আর এই মূলধারার শ্রমিকদের কোন অংশেই কম নয় এসব ইটভাটার শ্রমিক। আগামীতে তাদের নিয়েও পরিকল্পনা করা হবে। যাতে করে তাদের ন্যয্য অধিকার থেকে যেন বঞ্চিত হতে না হয়।

কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের কনসালটেন্ট ডাঃ এ এস এম মুসা কবির জানান, যারা ইটের ভাটায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করে তাদের অনেক পরিশ্রম করতে হয়। দিনের বেলা রোদ উপেক্ষা করে খোলা আকাশের নিচে কাজ করতে হয় শ্রমিকদের, রয়েছে কয়লা কিংবা কাঠের আগুনে ইট পোড়ার তীব্র তাপ। ইটভাটায় কাজ করা এসব শ্রমিকদের কোনো ভালো আবাসস্থল থাকে না। ইটভাটার পাশেই টিন দিয়ে ছাপড়া ঘর তুলে কোনোমতে তাদের রাত পার করতে হয়। স্বাস্থ্য সচেতনতা না থাকায় তাই তারা বেশ কিছুদিন পর পর অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই তীব্র গরমে আধা ঘন্টা পরপর পানি খাওয়ার পরামর্শ এবং তপ্ত দুপুরে কাজ না করারও পরামর্শ দেন তিনি।

আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর, কুষ্টিয়ার উপ-পরিচালক মোঃ জহিরুল হোসেন বলেন, কুষ্টিয়াতে ইটভাটা শ্রমিক সংগঠন নেই। চাইলে যে কেউই ট্রেড বা শ্রমিক সংগঠন করতে পারে। ইটভাটায় শ্রমিকরা চরমভাবে ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হলেও তবু শ্রমিকরা পেটের দায়ে রোদে পুড়ে এ কাজ করছে। তাদের নেই সাপ্তাহিক ছুটি, নেই কোনো নিয়োগপত্র, কোনো কর্মঘণ্টা, শ্রমিক রেজিস্ট্রার, নেই ছুটির রেজিস্ট্রার, নেই ব্যক্তিগত নিরাপত্তা উপকরণ। সুনির্দিষ্ট শ্রম কাঠামোতে আনা হলে এসব শ্রমিক উপকৃত হবে বলেও জানান তিনি। জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, কুষ্টিয়ার ৬টি উপজেলায় মোট ইটভাটার সংখ্যা ১৯১টি।

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *