রিমালের তাণ্ডবে ছয় জেলায় ৩৭ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত


ইত্তেহাদ নিউজ,ঢাকা : দক্ষিণ উপকূলীয় ছয় জেলা ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয়েছে। সব মিলিয়ে ১৯ জেলার ৩৭ লাখের বেশি মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত রবিবার সন্ধ্যার পর শুরু হয়ে রিমালের তাণ্ডব চলে পরদিন সোমবার (২৭ মে) সকাল পর্যন্ত। ফলে সোমবারও ঝড়ের প্রভাবে প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বাড়িঘর বিধ্বস্তসহ ভেসে গেছে মাছের ঘের। ফসলেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। খাগড়াছড়িতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ও ঝালকাঠিতে গাছচাপায় একজন নিহত হয়েছেন। দুই দিন ধরে বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্ন বাগেরহাট ও ঝালকাঠি জেলা।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের রাজস্ব আয় দৈনিক ২১৫ কোটি টাকা। পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দর চালু থাকলে দৈনিক ২০০ কোটি টাকা করে রাজস্ব আয় হতো সরকারের। ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণের গত রবি ও সোমবার কোনো ধরনের কার্যক্রম চালাতে পারেনি কাস্টম হাউস ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কৃষি ও মৎস্য খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে হিসাবে দুই দিনে চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টম হাউসসহ সরকারের ক্ষতি প্রায় এক হাজার কোটি টাকা, যা সরাসরি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আয়ের ওপর প্রভাব ফেলবে।
এদিকে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে দিনে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়। কিন্তু গত দুই দিনে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ব্যবসায় স্থবিরতা নেমে এসেছে। খাতুনগঞ্জে পণ্যবাহী ট্রাক প্রবেশ করেনি। বের হয়েও যায়নি। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে চট্টগ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। নগরের জলবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। দোকানদার থেকে শুরু করে সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্যে নেমে এসেছে স্থবিরতা। এতে ব্যবসায়ীদের কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলায় ১৬ হাজার ৫৮০ হেক্টরের কৃষিজমিতে সবজি চাষাবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ৩২০ হেক্টর জমিতে আবাদ করা সবজির ক্ষতি হয়েছে বলে চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুস ছোবহান নিশ্চিত করেছেন। চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র দাস জানান, জেলায় ৮৫টি পুকুর ভেসে গেছে। এতে ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস সূত্রমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭৭ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। সে হিসাবে প্রতি মাসে সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা আদায় হয়। প্রতিদিন আদায় হয় ২১৫ কোটি টাকা। কাস্টম হাউস দুই দিনের প্রায় ৫০০ কোটি টাকা পায়নি। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জনে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দুই দিনের রিমালের তাণ্ডবে বন্দরের ক্ষতি হয়েছে ৫০০ কোটি টাকার মতো।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘বন্দরের কার্যক্রম না চললেও রাজস্ব যে পাবে না তা নয়। যে রাজস্ব আজকে পায়নি সেটি দুই দিন পরে পাবে। আসলে যেকোনো ধরনের দুর্যোগ এলেই সেটি প্রথমে বন্দরের ওপর প্রভাব ফেলে। আমাদের সব ধরনের কার্যক্রম শাটডাউন করতে হয়।’
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার মুশফিকুর রহমান বলেন, চট্টগ্রাম কাস্টস হাউসে দৈনিক পাঁচ থেকে সাত হাজার বিল অব এন্ট্রি হয়ে থাকে। কিন্তু গত দুই দিনে তা হয়নি। কারণ ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব। বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় পূর্বের থাকা কিছু পণ্যের অ্যাসেসমেন্ট হয়েছে।
চট্টগ্রাম চেম্বার প্রেসিডেন্ট ওমর হাজ্জাজ বলেন, ‘চট্টগ্রাম হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের কারণে গত দুই দিনে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে। চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত চট্টগ্রামের মৎস্য, কৃষি ও বন্দর-কাস্টম। এতে সরকারের কোটি টাকা রাজস্ব হানি হয়েছে।
খাগড়াছড়িতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীর মৃত্যু
খাগড়াছড়িতে সড়কের ওপর ভেঙে পড়া গাছ সরাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী। গতকাল সোমবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে খাগড়াছড়ি-মাটিরাঙ্গা সড়কের আলুটিলা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীর নাম মো. রাসেল হোসেন (২১)। গত বছরই ফায়ারফাইটার হিসেবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সে যোগদান করেন রাসেল। তিনি ঢাকার ধামরাই উপজেলার বাসনা গ্রামের বাসিন্দা আবদুর রাজ্জাকের ছেলে।
খাগড়াছড়ি ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার রাজেশ বড়ুয়া জানান, রাতে ঝড়ে আলুটিলার বিভিন্ন স্থানে সড়কে গাছ ভেঙে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় বৈদ্যুতিক লাইন। ভেঙে পড়া গাছ সরানোর সময় হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে আসায় ৩৩ হাজার কেভি তারে স্পৃষ্ট হন রাসেল। তাৎক্ষণিক সহকর্মীরা তাকে উদ্ধার করে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে নেওয়ার পর রাত সাড়ে ১২টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. রাকিব উদ্দিন তাকে মৃত ঘোষণা করেন। খাগড়াছড়ি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তানভীর হাসান জানান, ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
বরিশালে কৃষিতে শতকোটি টাকার ক্ষতি
বরিশাল: বরিশালে জেলার কৃষি খাতে ১১০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জেলা কৃষি দপ্তর জানিয়েছে। এ ছাড়া জেলা ও মহানগর এলাকায় তিনজনের মৃত্যুসহ ১ লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত পুরোপুরি ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
বরিশাল জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মুরাদুল হাসান জানান, ১০ উপজেলায় ৯৪৫ হেক্টর জমির আউশ ধান, ৮৯৬ হেক্টর জমির পান, ২০০ হেক্টর জমির সবজি, ৩০ হেক্টর জমির কলা ও ২০ হেক্টর জমির পেঁপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার আর্থিক মূল্য ১১০ কোটি ২৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা।
গোপালগঞ্জে মৎস্য খাতে ক্ষতি হয়েছে ১৭ কোটি টাকা
গোপালগঞ্জ জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড়ে গোপালগঞ্জ জেলা সদর, টুঙ্গিপাড়া ও কোটালীপাড়া উপজেলার মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৭৩ হেক্টর জমির ৩৪২টি পুকুর, ৫২৯ হেক্টর ১ হাজার ১৫৫টি ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ৬৬৬ মেট্রিক টন মাছ ভেসে গেছে। এর মধ্যে চিংড়ি ৬৮ দশমিক ৫১ মেট্রিক টন, পোনা ২৯ লাখ পিস ও চিংড়ি পিএল ৬ দশমিক ৩১ লাখ পিস ভেসে গেছে। এতে চাষিদের অন্তত ১৭ কোটি ১৭ লাখ টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে।
টুঙ্গিপাড়া উপজেলার তারাইল গ্রামে শতাধিক ঘের তলিয়ে গেছে। এতে ভেসে যায় সাদা মাছ, চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। অনেকেই ঘেরে নেট দিয়ে বাঁধ দিয়েও মাছ ভেসে যাওয়া ঠেকাতে পারেননি। গোপালগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিজন কুমার নন্দী বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে গোপালগঞ্জ জেলার সদর, টুঙ্গিপাড়া ও কোটালীপাড়া উপজেলার মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৩৪২টি পুকুর ও ১ হাজার ১৫৫টি ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে চাষিদের অন্তত ১৭ কোটি ১৭ লাখ টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্যচাষিদের তালিকা তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্ন বাগেরহাট, মাছের ঘেরে ৭৩ কোটি টাকার ক্ষতি
বাগেরহাটে ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত হয়েছে জেলার ৪৫ হাজার ঘরবাড়ি। এর মধ্যে আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে ৩৫ হাজার ও পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে ১০ হাজার বাড়িঘর। উপড়ে পড়েছে কয়েক হাজার গাছপালা। বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়ায় বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে পুরো জেলা। এ ছাড়া জেলার শতাধিক গ্রাম ৬-৮ ফুট জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অর্ধলাখ পরিবার। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে মাছের ঘেরে।
জেলার মোংলা, রামপাল, শরণখোলা, মোড়েলগঞ্জ ও বাগেরহাট সদর উপজেলায় সাড়ে ৩ হাজার চিংড়ি ঘের ও পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এতে ৭৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া ১ হাজার ৫৮১ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলার মোড়েলগঞ্জ ও শরণখোলায় প্রায় দুই কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে সাতটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক খালিদ হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে জেলার শরণখোলা, মোড়েলগঞ্জ ও মোংলা উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এসব উপজেলার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পেয়েছি। আবহাওয়া পুরোপুরি স্বাভাবিক হলে ক্ষয়ক্ষতির সঠিক তথ্য জানা যাবে। এখন পর্যন্ত জেলায় প্রাণহানির কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
ঝালকাঠিতে গাছচাপায় নিহত ১, ৬ শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত
ঝালকাঠি: ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে ঝালকাঠিতে ছয় শতাধিক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার ঘরবাড়ি। সোমবার রাতে কাঁঠালিয়া উপজেলার শৌলজালিয়া ইউনিয়নের বলতলা গ্রামে গাছচাপা পড়ে জাকির হোসেন (৫৫) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।
ঘূর্ণিঝড়ে জেলার ৬ হাজার ১৯০ হেক্টর জমির ফসল ও বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করে সাড়ে ৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২ হাজার ৭০টি পুকুর ও ১৫৯টি মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া বিদ্যুতের খুঁটির ওপর গাছ পড়ে রবিবার রাত থেকে টানা দুই দিন ধরে পুরো জেলা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন। এদিকে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও গুদামে পানি প্রবেশ করায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্যবসায়ীরা। গ্রামীণফোনসহ বেশ কয়েকটি মোবাইল ফোন অপারেটরের নেটওয়ার্ক বন্ধ থাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়