এমপি আনার হত্যা : কন্যা ডরিন’র দৌড়ঝাঁপ, নিরব স্ত্রী


ইত্তেহাদ নিউজ,ঢাকা : কন্যা ডরিন পিতার খুনের ঘটনায় দৌড়ঝাঁপ করলেও স্বামী হত্যা কিংবা নিখোঁজ সংক্রান্ত বিষয়ে একেবারেই নিরব ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের স্ত্রী। এই নিরবতাকে অনেকেই রহস্যজনক মনে করছেন। এই রহস্যের নেপথ্যে কি অন্য কোনো কিছু লুকিয়ে রয়েছে? কেউ কেউ বলছেন, স্বামীর স্বভাব চরিত্র নিয়ে নেতিবাচক ধারণার ক্ষোভ থেকেই স্ত্রী নিরবতা পালন করছেন।
আনোয়ারুল আজিম আনার প্রেম করে প্রতিবেশি তরুণীকেই বিয়ে করেছিলেন। তার খুনের পর কন্যা ডরিনই কথা বলছেন সবার সামনে। আনার কলকাতায় নিখোঁজের পর বাবার সন্ধান পেতে প্রথমে ঢাকার ডিবি কার্যলয়ে আসেন তার কন্যা। ডিবির পরামর্শে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলাও করেন তিনি। আনার হত্যার বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে নিজ এলাকায় প্রতিবাদ সমাবেশ মানবন্ধন হলে কন্যা ডরিন আগুনঝরা বক্তৃতা দিলেও সেখানেও দেখা যায়নি আনারের স্ত্রীকে। পরিবারের পক্ষ থেকে আনার হত্যার মূল কারণ কিংবা সম্ভাব্য ঘাতক কারা এ প্রসঙ্গে কোনো ধারণা দিতে পারেননি। তারা চেয়ে আছেন কলকাতা-বাংলাদেশ পুলিশের তদন্তের দিকে। ডরিন ছাড়াও আনারের আরো একজন কন্যা রয়েছেন। যার নাম অরিন। তিনি চিকিৎসক।

অনেকেই বলেছেন, স্বামীর বিষয়ে একজন স্ত্রীর যতটা স্পষ্ট ধারণা থাকে তা অন্য কারো থাকার কথা নয়। এছাড়া স্ত্রী হিসেবে স্বামীর সব কিছুই অবহিত থাকে একজন স্ত্রীর। তবে আনারের ক্ষেত্রে তার স্ত্রী এখনো কোনো কিছু জানাতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে।
সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত কলকাতার ফ্ল্যাটে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য খুনের ঘটনা। গত ১৩ মে চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটনে মাঠে নামে কলকাতা ও ঢাকার পুলিশ। ঢাকার শেরেবাংলানগর থানায় আনারের নিখোঁজ সংক্রান্ত মামলা হলেও কলকাতায় হয় আনার খুনের মামলা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, সংসদ সদস্য হত্যা হয়েছেন ভারতে। সেজন্য সেখানেই হত্যা মামলাটি হয়েছে। কাজেই হত্যাকাণ্ডের মূল মামলার তদন্ত করবে ভারত। তারা আমাদেরকে এ মামলায় সম্পৃক্ত করলে তবে আমরা সেখানে গিয়ে তদন্ত করব। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আসামি বিনিময় চুক্তি রয়েছে। আমাদের দেশে হলে আমরা আসামিকে দেশে আনার ব্যবস্থা করতাম। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত একজন পালিয়ে নেপাল গেছেন। তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য যত ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, আমরা গ্রহণ করছি। আমরা এখনও সুনিশ্চিত বলতে পারছি না যে, এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড শাহিন কোথায় আছেন!
এদিকে আনার হত্যার তদন্তে নেপালে গিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের নেতৃত্বে তিনজন ডিবি দলের সদস্য এবং একজন এনসিবির (ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো) সদস্যসহ মোট ৪ জনের একটি প্রতিনিধি দল। সেখানে আনার হত্যাকান্ডের মাস্টারমাইন্ড শাহিনের অন্যতম সহযোগী এবং খুনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত সিয়াম আটক হয়েছেন। কলকাতা সিআইডির একটি টিমও সেখানে গেছেন বলে জানা গেছে।
শনিবার নেপালের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ার আগে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হারুন বলেন, এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের মধ্যে অনেকে নেপালে রয়েছে বলেও ধারণা করছি। ইদানিং বাংলাদেশের অনেক সন্ত্রাসী নেপালের কাঠমান্ডুর মাটিকে পালানোর রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। এরমধ্যে আনার হত্যার মূল মাস্টারমাইন্ড শাহীন কাঠমান্ডুর মাটি ব্যবহার করে অন্য দেশে চলে গেছেন। আরো অনেক আসামি এখানে আত্মগোপনে থাকতে পারে বলে আমাদের কাছে খবর আছে। এই হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার চার আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলো ক্রসচেক করতে নেপাল যাচ্ছি। সিয়ামসহ বেশ কয়েকজনের বিষয়ে আমরা ইন্টারপোলকে চিঠি দিয়েছি। কাঠমান্ডু পুলিশকেও জানিয়েছি। যেসব আসামি নেপালে থাকবে তদের আটক করার জন্য আমরা তাদের অনুরোধ জানিয়েছি। এরই ধারাবাহিকতায় মামলার তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নেপাল পুলিশের সঙ্গে কথা বলবো। এর আগে গত ২৬ মে খুনের ঘটনা তদন্তে ঢাকা থেকে কলকাতায় যায় ডিবির তদন্ত দল।
এদিকে শনিবার পর্যন্ত আনার কন্যা ডরিন কিংবা তার পরিবারের সদস্যরা কলকাতায় যেতে পারেননি। সেখানে উদ্ধার হওয়া গোশতের টুকরোর ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ডরিনের সেখানে যাবার কথা রয়েছে। ভিসা জটিলতায় সেখানে যেতে বিলম্ব হচ্ছে বলে যাচ্ছে।
কে এই আনার?
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার নিশ্চিন্তপুর মধুগঞ্জ বাজারের মৃত ইয়াকুব বিশ্বাসের ছেলে আনোয়ারুল আজীম আনার। ১৯৬৮ মালের ৩ মে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারে চার ভাই ও ছয় বোন। আনার ছিলেন চার ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট। পেশায় ছিলেন ব্যবসায়ী।
ফুটবল খেলোয়াড় থেকে এমপি
আনার ছিলেন তুখোড় ফুটবল খেলোয়াড়। এলাকায় বেশ সুনাম ছিল। ভালো ফুলবল খেলায় সবার কাছে জনপ্রিয় ছিলেন। সেই জনপ্রিয়তা থেকে ১৯৯৩ সালে এলাকাবাসীর অনুরোধে প্রার্থী হয়ে কালীগঞ্জ পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হন। ২০০৯ সালে কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ থেকে এমপি নির্বাচিত হন। পাশাপাশি কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি হয়েছেন।
এলাকায় আছে সুনাম
জনপ্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন জনপ্রিয়। উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও সামাজিক কাজের জন্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এমপি হলেও প্রটোকল নিয়ে এলাকায় চলাফেরা করতেন না। তিন দশকের বেশি সময় ধরে মানুষের সেবা করেছেন। একাই মোটরসাইকেলে চড়ে কখনও একজনকে নিয়ে এলাকার মানুষের খোঁজ নিতেন। অ্যাম্বুলেন্সের চালক না থাকায় নিজেই অসুস্থ রোগীর অ্যাম্বুলেন্স চালিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে দিতেন। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নির্বাচনি এলাকার গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষের সঙ্গে দেখা করেছেন, সমস্যার কথা শুনেছেন এবং সমাধান করেছেন। সবচেয়ে আলোচিত বিষয় এলাকায় যেকোনো ব্যক্তি মারা গেলে তার বাড়িতে যেতেন এবং শোকাহত পরিবারকে সান্ত্বনা দিতেন। এমনও হয়েছে একদিনে একাধিক মৃত ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে স্বজনদের সান্ত্বনা দিয়েছেন।
স্থানীয় নেতাকর্মীদের অনেকে মনে করছেন, পুরোনো ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব কিংবা চোরাকারবারের কোনও বিষয় নিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এর সঙ্গে তার পূর্বপরিচিত কেউ জড়িত থাকতে পারে।
উল্লেখ্য, ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম গত ১২ মে দর্শনা সীমান্ত হয়ে কলকাতায় যান।
পরদিন কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনসের একটি ফ্ল্যাটে তিনি খুন হন। ২২ মে তাঁর খুন হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে দুই দেশের পুলিশ। এ ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী শাহীন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। তিনি খুনের পর নেপালের কাঠমান্ডু হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান বলে পুলিশ বলছে। আরেক অভিযুক্ত সিয়াম নেপালে আটক হয়েছেন।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়