ইত্তেহাদ এক্সক্লুসিভ

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার হাতছাড়া : এজেন্সির দ্বারে দ্বারে ধরনা শত শত কর্মীর

8 20240602000113
print news

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্কস্বপ্নের দেশে পাড়ি দিতে জীবনের শেষ সহায়সম্বল বিক্রি করেও হাজার হাজার বাংলাদেশি কর্মীর ভাগ্যে যুটেনি মালয়েশিয়ার ফ্লাইট। দীর্ঘ দিন রিক্রুটিং এজেন্সির দ্বারে দ্বারে ঘুরে এবং ২/৩ দিন হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অনাহার অনিদ্রায় দিন কাটিয়েও মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সুযোগ হয়নি। মালয়েশিয়া সরকারের কর্মী নিয়োগের অ্যাপ্রুভাল এবং ই-ভিসা ও বিএমইটির বহির্গমন ছাড়পত্র সবই ছিল এসব নিরীহ কর্মীদের। ৩১ মে’ মধ্যে দেশটিতে প্রবেশের সর্বশেষ সময় বেধে দেয় দেশটির কর্তৃপক্ষ। এ সুযোগে টিকিট সিন্ডিকেট চক্র ৩০ হাজার টাকার ওয়ানওয়ে টিকিট ১ লাখ টাকা থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছে। এতে অভিবাসন ব্যয় অনেকের ৫ লাখ টাকা থেকে ৬ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। মালয়েশিয়া বিমান বন্দরে হাজার হাজার অভিবাসী কর্মীদের সেবা দিতে হিমসিম খাচ্ছে।

সিন্ডিকেট যুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর অনেকেই ৩১ মে’র পর সময় বাড়াবে এবং টিকিটের দাম কমবে এমন আশায় শত শত কর্মীর বিমানের টিকিট কাটেনি। টিকিট আজ দেয়া হবে কাল দেয়া হবে এবং এয়ারপোর্টে দেয়া হবে এমন মিথ্যা আশ্বাস দিয়েও মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু শত শত কর্মীর সাথে প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হয়েছে। গ্রামের বাড়ি থেকে বিদেশে যাওয়ার জন্য মিলাদ দোয়ার ব্যবস্থা করে  বিভিন্ন হোটেলে সপ্তাহের পর সপ্তাহ অপেক্ষা করেও মালয়েশিয়ায় যাওয়া হয়নি অনেকেরই।

প্রতারণার শিকার এসব কর্মীদের অনেকেই ঋণের তাগিদে গ্রামের বাড়িতেও যেতে পারেনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফকিরাপুলের একটি রিক্রুটিং এজেন্সির সামনে বসে থাকা এক কর্মী এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ই-ভিসা, ম্যানপাওয়ার সবই ছিল কিন্তু সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সির চরম গাফলতি ও উদাসিনতার দরুন তাদের ভাগ্যে মালয়েশিয়া যাওয়া হয়নি। তিনি বলেন, আল্লাহ আমাদের ভাগ্যে কি রেখেছেন তা’ আল্লাহই জানেন। কত টাকা দিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়েছি। এসব কথা বলতেও নিষেধ করা আছে। এখন আমাদের টাকা ফেরত দিলে গ্রামের ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারবো। না হয় বাড়িতে না গিয়ে পালিয়ে পালিয়ে দিন কাটাতে হবে।

শুক্রবার রাতের মধ্যে দেশটি প্রবেশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত ঢাকা বিমান বন্দর ও রাজধানীর বিভিন্ন হোটেল থেকে কর্মীরা নিরাশ মনে বাড়ি ফিরেছেন। শত শত কর্মী তাদের ভাগ্যে কি হবে এবং পাওনা টাকা ফেরত প্রদানের দাবিতে  রাজধানীর বনানী, নয়া পল্টন, ফকিরাপুলসহ বিভিন্ন স্থানের রিক্রুটিং এজেন্সির অফিসে ধরনা দিয়ে হয়রানির শিকার হন। একাধিক ভুক্তভোগি কর্মী কান্না জড়িত কণ্ঠে এসব তথ্য জানান।

অপরদিকে, গত কয়েক দিনে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের দু’টি বিমান বন্দরে হাজার হাজার অভিবাসী আটকা পড়ে। অভিবাসী কর্মীদের সেবা দিতে দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগকে হিমসিম খেতে হচ্ছে। এসব অভিবাসী কর্মীদের সংশ্লিষ্ট কোম্পানির লোকজন বিমান বন্দরে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে সিরিয়াল অনুযায়ী রিসিভ করছে। বিমান বন্দর ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ এসব অপেক্ষমাণ কর্মীদের নিয়মিত খাবার পানীয় সরবরাহ করছে। তারা অতিরিক্ত একাধিক কাউন্টার খুলেও অভিবাসী কর্মীদের সেবা দিচ্ছে। কুয়ালালামপুর থেকে একাধিক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। এদিকে, মালয়েশিয়ায় পারমিটহীন অভিবাসী কর্মীদের গ্রেফতার অভিযান চালাচ্ছে দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগ। গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার জহুর বারু ইমিগ্রেশন বিভাগ রাজ্যের তাংকাক ও ইস্কান্দার পুতেরিতে অভিযান চালিয়ে ৩৬ জন বাংলাদেশিসহ ৯৯ জন অভিবাসীকে গ্রেফতার করেছে। এদের বিরুদ্ধে অভিবাসন আইন লঙ্ঘনের দায়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইমিগ্রেশন ডিরেক্টর (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ ফয়জল শামসুদ্দিন এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছেন। মালয়েশিয়া প্রবাসী ব্যবসায়ী ড. ওয়ালী উল্লাহ জাহিদ গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ রাত-দিন পরিশ্রম করে বিমানবন্দরে অবস্থান নেয়া হাজার হাজার অভিবাসীকে সেবা দিয়ে কোম্পানির কাছে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। বিমান বন্দরে অবস্থান নেয়া কর্মীদের সিরিয়াল অনুযায়ী মালিক পক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে। দেশটিতে যাওয়া এসব অভিবাসী কর্মীদের সেবা প্রদানে দেশটির সরকারের আন্তরিকতার শেষ নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেসব বাংলাদেশি কর্মীর দেশটির অ্যাপ্রুভাল, ই-ভিসা আছে তাদের দেশটি প্রবেশের জন্য আরো ১৫ দিন সময় বাড়ানোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। সকল দিন বিবেচনা করে মালয়েশিয়া সরকার অভিবাসী কর্মী প্রবেশের সময় বাড়াতে পারে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

শুক্রবার দুপুরে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এয়ালাইন্স অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন এক নোটিশে জানায়, ৩১ মে রাত ১২টার মধ্যে ফ্লাইট ছাড়লে ১ জুন মালয়েশিয়া পৌঁছালেও সেই কর্মীদের প্রবেশ করতে দেবে দেশটি। তবে তারিখ অনুযায়ী, ১ জুন অর্থাৎ শুক্রবার রাত ১২টা পার হয়ে গেলে, সেই ছেড়ে যাওয়া ফ্লাইটের কর্মীদের গ্রহণ করবে না মালয়েশিয়া সরকার। হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক জানায়, শেষ মুহূর্তে কর্মীদের মালয়েশিয়া পাঠাতে শুক্রবার পরিচালনা করা হয়েছে ১২টি ফ্লাইট। এসব ফ্লাইটে অন্তত ২ হাজার কর্মী সে দেশে গেছেন।

ভুয়া টিকিটের কারণে মালয়েশিয়া যেতে পারেনি অনেক কর্মী। শুক্রবার বিমানবন্দরে বিভিন্ন এজেন্সির ইস্যু করা ভুয়া টিকিট নিয়ে হাজির হয়েছেন অনেক কর্মী। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মালয়েশিয়া যেতে এজেন্সিকে ৫-৬ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে অন্তত ৬-৭ মাস আগে। এতদিনেও এজেন্সি ফ্লাইটের ব্যবস্থা করতে পারেনি। শেষ মুহূর্তে ভুয়া টিকিট ইস্যু করে তাদেরকে বিমানবন্দরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে সেখানে গিয়ে তারা জানতে পারে টিকিটগুলো ভুয়া। বিমানবন্দরে অবস্থানরত এক কর্মী জানান, আমার কাছ থেকে ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়েছে এজেন্সি। এরপর গত পাঁচ দিন ধরে ভোগান্তিতে পড়েছি এয়ারপোর্টে এসে।

জানা গেছে, নিজের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে ৬ লাখ টাকা জোগাড় করেছিলেন নোয়াখালীর ইউসুফ। অন্তত পাঁচ মাস আগে রিক্রুটিং এজেন্সিকে পুরো টাকা শোধ করলেও শেষ পর্যন্ত যেতে পারেননি মালয়েশিয়ায়। গত দুই দিন ধরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অপেক্ষা করে শেষমেষ কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছেন। এই টাকা কীভাবে উদ্ধার করবেন, তা নিয়ে এখন তিনি দুশ্চিন্তায় পার করছেন দিন। কত হাজার বাংলাদেশি দেশটিতে যেতে পারেনি তার সংখ্যা বায়রা নেতৃবৃন্দ জানাতে পারেননি। বায়রার যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম বলেন, ১শ’ সিন্ডিকেট চক্র মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠিয়েছে। অথচ আড়াই হাজার বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি দেশটিতে কর্মী প্রেরণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। গত শুক্রবার পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার কর্মী মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। প্রতারণার শিকার এসব কর্মীদের দায় সিন্ডিকেট চক্র এড়াতে পারে না। এসব বঞ্চিত কর্মীদের টাকা ফেরত দিতে হবে।

বিএমইটি তথ্য বলছে, গত ২১ মে পর্যন্ত প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ৫ লাখ ২৩ হাজার ৮৩৪ জন কর্মীকে মালয়েশিয়া যাওয়ার অনুমোদন দেয়। ২১ মে’র পর আর অনুমোদন দেয়ার কথা না থাকলেও, মন্ত্রণালয় আরও ১ হাজার ১১২ জনকে অনুমোদন দিয়েছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৫ লাখ ২৪ হাজার ৯৪৬ জন বাংলাদেশি মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় গেছেন ৪ লাখ ৯১ হাজার ৭৪৫ জন। বিএমইটি’র তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার বাংলাদেশ থেকে মাত্র ১ হাজার ৫০০ জন ১২টি ফ্লাইটে মালয়েশিয়ায় চলে যাওয়ার কথা। ওপরের হিসাব অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, ৩১ হাজার ৭০১ জনের মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ হচ্ছে না। তবে প্রকৃতপক্ষে কতজন কর্মী মালয়েশিয়া যেতে পারেনি, তার সঠিক হিসাবও কেউ জানেন না।

টাকা দেয়ার পরও কর্মীরা কেন মালয়েশিয়া যেতে পারেনি তা তদন্ত করে দেখবে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। শনিবার দুপুরে সাংবাদিকদের একথা জানান প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী। এ সময় তিনি রিক্রুটিং এজেন্সির গাফিলতির কারণ উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘মালয়েশিয়া সরকারের অনুমোদিত কোটা অনুযায়ী, কর্মী পাঠাতে আমরা বায়রার সঙ্গে বৈঠক করেছি। তাদের সঙ্গে বারবার বসে আমরা আলোচনা করে কর্মীর তালিকা চেয়েছি। মে মাসের ১৫ তারিখে আমি মিটিং করে তাদেরকে বলেছি ফাইনাল লিস্ট করার জন্য। ভিসা পাওয়ার পর কতজন যাওয়া বাকি, কত জনের ভিসা আসা বাকি, এগুলো আমরা ফাইনাল তালিকা দিতে বলেছি। কিন্তু তারা সেগুলো তৈরি করেনি এবং আমাদেরকে দেয়নি। তারা শেষ সময়ে আমাদের জানায় কর্মীরা রেডি আছে। কিন্তু ফ্লাইট পাওয়া যাচ্ছে না। আমি তখন বিমানমন্ত্রী, বিমানের এমডি, সিভিল এভিয়েশনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। এরপর ২২-২৩ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর বাইরে শিডিউল ফ্লাইট তো আছেই।’ প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘এত ফ্লাইট দেয়ার পরও কর্মী যাওয়া শেষ হয়নি। এই ভোগান্তির সৃষ্টি যাদের কারণে হয়েছে, আমরা তদন্ত কমিটি করবো। তদন্তে যারা দোষী প্রমাণিত হবে, তাদের আইনানুগ শাস্তির আওতায় আনা হবে। যারা টাকা দিয়েছেন, কিন্তু যেতে পারেনি, তারা আমাদের কাছে অভিযোগ জানালে, দায়ীদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেবো।

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *