মতামত

রাজনীতিতে আর কত আনার আছে!

রায়হান
print news

আলম রায়হান : নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার। এটি দুর্ভাগ্যের। তবে নামের বিবেচনায় তিনি ভাগ্যবান। কারণ এমন ফলের নামে তার নাম রাখা হয়েছে, যা খুবই সুস্বাদু ও উপকারী। এ ফলের মাহাত্ম্য তার মৎস্যজীবী পরিবার সে সময়ই বুঝতে পেরেছিলেন, যখন এ ফলটির প্রচলন আমাদের দেশে ছিল না। সে সময় এ প্রজাতির ফলের নিম্ন ধাপের ডালিমই ছিল অনেক সমাদরের। আমদানি হতো না, বাণিজ্যিকভাবে চাষও হতো না। শুধু কোনো কোনো সচ্ছল পরিবারের ঘরের আঙিনায় দু-একটি ডালিম গাছ দেখা যেত। আর এ গাছটি অধিক প্রচার পেয়েছে পল্লীকবি জসীমউদদীনের কবর কবিতার কারণে। অমর এ কবিতার পঙক্তি—‘এই খানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে, তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।’

ডালিম-বেদানা-আনার, এক প্রজাতির ফল, শুধু রয়েছে প্রকারভেদ। এদের বৈজ্ঞানিক নামও এক। সুস্বাদু এ ফল আয়ুর্বেদিক ও ইউনানি চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। গাছ-ফল-ফলের খোসা-পাতা থেকে শুরু করে শিকড় পর্যন্ত কোনো কিছুই ফেলনা নয়, বরং মহামূল্যবান, মহা উপকারী। এদিকে সবারই জানা, একসময় ডামিল-আঙুর ছিল খুবই দুর্লভ, সাধারণের নাগালের বাইরে। আলোচিত বেনজীর আহমেদের ভাষায় এ ছিল ‘মৃত্যু ফল’। তার বিবেচনায়, এ ধরনের ফল মানুষ সাধারণত মৃত্যুর সময় খেতে চাইত, অথবা স্বজনরা নিয়ে আসত। বছর কয়েক আগে বরিশালে বেনজীর আহমেদের এ বক্তব্য শুনেছি। তখন তিনি পুলিশের মাইটি আইজি ছিলেন। অভিযোগ আছে, পুলিশপ্রধান থাকাকালে তিনি অনেককে দৌড়ের ওপর রেখেছেন। এখন তিনি নিজেই দৌড়ের ওপর আছেন। সম্ভবত একেই বলে ভবিতব্য। অথবা প্রকৃতির বিচার। অবশ্য এ বিচারের ধারা কোথায় গিয়ে থামবে তা এখনই বলা কঠিন। যেমন বলা কঠিন, তিনি কারও প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন কি না। এ প্রসঙ্গ থাক, আসা যাক মূল বিষয়ে।

কলকাতায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ঝিনাইদহের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম ওরফে আনার। বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় চলছে। লাশ না পেলে এ হত্যা মামলা আঁতুরঘরেই থেকে যেতে পারে। যদিও বিষয়টি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, তার লাশের সন্ধানে আমাদের গোয়েন্দা দলও সীমান্ত পেরিয়ে গেছেন। এর আগে আনার ফলের অসংখ্য দানার মতো এমপি আনারের মাংসের টুকরোর সন্ধানে ২০ কিলোমিটার খালে অভিযান চালিয়েছে ভারতের গোয়েন্দারা। কিন্তু কিছুই পাওয়া যায়নি। তবে বাংলাদেশে আলোচিত গোয়েন্দা হারুন অর রশীদ এ বিষয়ে আশাবাদ প্রকাশ করেছেন বলে কোনো কোনো গণমাধ্যম বলছে। আবার তার হতাশার কথাও জানানো হয়েছে একশ্রেণির গণমাধ্যমে।

আনোয়ারুল আজিম আনার খেলাধুলার মাধ্যমে কালীগঞ্জে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ও সীমান্ত চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। তিনি নিজেই তার নির্বাচনী হলফনামায় ২১টি মামলার তথ্য দিয়েছেন। যার মধ্যে হত্যা ও চোরাচালানের মামলাও রয়েছে। এরশাদের জাতীয় পার্টির মাধ্যমে রাজনীতি শুরু করে বিএনপি হয়ে আওয়ামী লীগে এসে সংসদ সদস্য হতে সক্ষম হয়েছেন তিনি এবং সরকারি দল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন পরপর তিনবার। অর্থাৎ তিনি তিনবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য। যার বিরুদ্ধে বেশ কিছু হত্যা ও চোরাচালানের ঘটনায় করা মামলায় নাম ছিল। এর বেশিরভাগ মামলাই হয়েছিল ২০০১ সালের সরকারের সময়ে। এর আগে ১৯৯১ সালের নির্বাচনের আগে আনোয়ারুল আজিম আনার আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তার শক্ত অবস্থান তৈরি হতে শুরু করে। এমনকি ঝিনাইদহ অঞ্চলে চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে সরকারের অভিযানে আনারের জোরালো ভূমিকা ছিল। পরে বিএনপি ক্ষমতায় এলে এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে যান এবং ওই অবস্থাতেই ২০০৪ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সে সময়ে পুরোনো আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেককেই নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়, যা পরে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তুলে নেওয়া হয়। পরে ধীরে ধীরে অন্যান্য মামলা থেকেও অব্যাহতি লাভ করেন আনোয়ারুল আজিম আনার।

আনার কাহন এখানেই থেমে থাকেনি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত যে নির্বাচনে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন, তাতে বিএনপি-জামায়াতের বর্জনের কারণে ক্ষমতাসীনরা চাইলে কলাগাছও পাস করিয়ে সংসদে আনার বাস্তবতা বিরাজমান ছিল। চাইলে নির্বাচনী রাজনীতিতে পাটগাছও বটগাছে রূপান্তর করা যেত। কিন্তু আগাছাকে কেন রাজনীতির বিষবৃক্ষ বানানো হলো? কেনইবা নিয়ে আসা হলো সংসদে! এবং এ ধরনের বিষবৃক্ষ সংসদ এবং রাজনীতিতে কত আছে—এ প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার ক্ষমতাহীন ‘বিশাল রাজনীতিক’ ও আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী থাকাকালে ধনকুবের বনে যাওয়া ১৪-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক সাম্যবাদী দলের চিরকালীন সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেছেন, ‘শুধু এমপি আনার নন, বর্তমানে নির্বাচিত ৮০ ভাগ এমপিই চোরাকারবারে জড়িত।’

এক দলের এক নেতা দিলীপ বড়ুয়া সঠিক বলেছেন, নাকি বঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভ থেকে প্রলাপ বকেছেন, তা নিয়ে আলোচনা-সংশয়-সন্দেহ থাকতেই পারে। তবে এ ব্যাপারে প্রায় কারোরই সংশয় নেই, যৌবনেই পা দেওয়ার আগেই অপরাধ জগতে শামিল হয়েছেন অনোয়ারুল আজিম আনার। এবং নির্বাচনী রাজনীতিতে তার সূচনা কাউন্সিলর দিয়ে, তখন বলা হতো ওয়ার্ড কমিশনার। গালভরা আওয়াজ দেওয়া যায়, একেবারে তৃণমূল থেকে বেড়ে উঠেছেন জনপ্রতিনিধি আনার। স্মরণ করা যেতে পারে, মিজানুর রহমান চৌধুরীর নির্বাচনী রাজনীতি শুরু হয়েছিল একেবারে তৃণমূল থেকে। এ ধারায় তিনি হয়েছেন সংসদ সদস্য, ছিলেন বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার সদস্য, হয়েছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। অবশ্য তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এরশাদ সরকারের আমলে। তারা ছিলেন অপরাধ থেকে অনেক দূরে। এদিকে প্রকাশিত খবর অনুসারে, নির্বাচনে আসার আগে আনার হেঁটেছেন অপরাধের নানান পথে। আর সেই সময় মোক্ষম ঢাল হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন রাজনীতি ও নির্বাচন। বিরাজমান বাস্তবতার তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন, রাজনীতির সমান্তরালে জনপ্রতিনিধি হতে পারলে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় না। আর এ ক্ষেত্রে তিনি এরশাদ শিকদারের মতো বনসাই হয়ে থাকার মতো ভুলটি করেননি। স্থানীয় পরিষদ থেকে একেবারে জাতীয় পরিষদে স্থান করে নিয়েছেন। একই ধারায় আমাদের দেশে হয়তো অনেক অপরাধী তৃণমূলের রাজনীতি থেকে মহান জাতীয় সংসদে স্থান পেয়েছেন। যে দ্বার খুলেছিলেন সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান। আর জেনারেল এরশাদ তো খুলেছিলেন একেবারে আলিবাবা চল্লিশ চোরের গুহাদ্বার। যে ধারা কোনো আমলেই একেবারে বন্ধ হয়েছে বলে মনে করার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। এ ধারায় অনেকেই স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতি প্রভাবশালী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। একই ধারায় প্রতিষ্ঠিত আনোয়ারুল আজিম আনার। একসময় ইন্টারপোলের তালিকাভুক্ত হয়ে অন্তত চার বছর আত্মগোপনে কিংবা ভারতে ছিলেন, ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ও তার আগে। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ওই তালিকা থেকে নাম সরাতে সক্ষম হন তিনি। মানে তিনি কামেল ব্যক্তি এবং কোনো সরকারই তাকে দূরে রাখেনি। হয়তো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মূলায়নে আনারের জনপ্রিয়তাই এর কারণ। তিনি বলেছেন, ‘আজিম কী ছিলেন তা বড় কথা নয়, জনপ্রিয়তা দেখে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল।’ প্রশ্ন হচ্ছে, তৃণমূল থেকে সংসদ পর্যন্ত আনোয়ারুল আজিমের মতো আর কতজন ‘জনপ্রিয়’ জনপ্রতিনিধি আছেন? এ প্রশ্নে আমজনতা বেশ শঙ্কিত, তাদের বেশ ভাবাচ্ছে। অবশ্য আমজনতার শঙ্কা আর ভাবনায় তেমন কিছু আসে-যায় বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না!

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *