মতামত

চোরমুক্ত হোক সামাজিক খাত

Capture 1906151244 2005061601
print news

মোস্তফা কামাল: অর্থনীতির এক বিশেষ পরিস্থিতিতে আসছে নতুন বাজেট। অর্থনীতির সংকট আরও ঘনীভূত। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা উন্নতির বদলে আরও অবনতির দিকে। দীর্ঘদিন ধরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ ক্রমাগত কমছে। প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, রপ্তানি, প্রবাসী আয়সহ অর্থনীতির সূচকগুলো আশাব্যঞ্জক নয়। দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট। মূল্যস্ফীতিসহ অন্যান্য কারণে নিম্ন আয়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বয়স্ক, বিধবা নারী, বিশেষ চাহিদাসম্পন্নরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তা সামাজিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষাকে শুধু টোকা নয়, খুঁচিয়ে ফুটো করতে বসেছে।

চুরি-চামারি, জোচ্চুরি আর সাফল্যের রসায়নে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি। এ নিয়ে অনেক কথা আছে। ভাতা খাওয়ার উপযুক্ত অনেকে ভাতা পাচ্ছেন না। আবার ভাতার দরকার নেই এমন অনেকে ভাতা নিচ্ছেন। স্থানীয় পর্যায়ে বয়স্ক ও বিধবা ভাতা কার্ড করতে গিয়ে উপকারভোগীদের ঘুষ দিতে হয়। ঘুষের দাতা উপকার ভোগীরা। গ্রহীতা ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বার এবং প্রান্তিক পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তা একটি চেইনের মতো। উপকারের এ দাতা-গ্রহীতার মধ্যে বেশ বোঝাপড়া। আরও নানান অনিয়ম-অনাচারের মধ্যেও দেশে দারিদ্র্য কমার

পেছনে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বেশ ভূমিকা রেখে চলছে। দারিদ্র্য কমার পাশাপাশি অর্থনৈতিক বৈষম্যও বেড়েছে। এটি ব্যাপক আকার ধারণ করলে সামাজিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হতে পারে। এজন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর পরিধি ও ভাতার পরিমাণ বাড়ানো সময়ের দাবি।

চলতি অর্থবছরে ৫৮ লাখ ১ হাজার প্রবীণ প্রতি মাসে ৬০০ টাকা করে পাচ্ছেন। এ ভাতা বর্তমান সুবিধাভোগীর প্রয়োজন বিবেচনায় দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা করতে অতিরিক্ত ৪ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। শুনতে অঙ্কটা বিশাল। কিন্তু কর ফাঁকি ও কর অস্বচ্ছতার মাধ্যমে ৫৫ হাজার কোটির চেয়েও বেশি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এর দশ ভাগের এক ভাগও লাগছে না সত্যিকারের দুস্থ, অভাবী অনাথদের মাসে হাজার তিনেক করে টাকা দিতে। পাচার হওয়া টাকার কথা তো বাদই থাকল।

চলতি অর্থবছরে ‘বয়স্ক ভাতা’ কর্মসূচিতে বরাদ্দ ৪ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। বার্ষিক গড় আয় ১০ হাজার টাকার কম—এমন ৬৫ বছরের বেশি বয়সী পুরুষ ও ৬২ বছরের বেশি বয়সী নারীকে বয়স্ক ভাতা দেওয়া হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে বিধবা, পরিত্যক্ত বা দুস্থ নারীদের জন্য ১ হাজার ৭১১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রায় ২৫ লাখ ৭৫ হাজার নারী এতে সুবিধা পাচ্ছে। সরকারি হিসাবে চলতি অর্থবছরে বয়স্ক ভাতাভোগীর সংখ্যা ৫৮ লাখ ১ হাজার। বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতাভোগী ২৫ লাখ ৭৫ হাজার। এ ছাড়া প্রতিবন্ধী ভাতাভোগী ২৯ লাখ, হিজড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভাতার আওতায় ৬ হাজার ৮৮০ জন। এ ছাড়া মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির উপকারভোগীর সংখ্যা ১৩ লাখ ৪ হাজার। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় ৪৭টি কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল, যা মোট বাজেটের ১৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং জিডিপির (৫০ লাখ ৬ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা) ২ দশমিক ৫২ শতাংশ। আরেক হিসাবে জানা গেছে, দেশে ৩৩ লাখ বয়স্ক ও ২৫ লাখ বিধবার যোগ্যতা থাকা

সত্ত্বেও ভাতা পাচ্ছেন না। অন্যদিকে প্রায় ৩০ শতাংশ বয়স্ক ও ৩৩ শতাংশ বিধবা ভাতা পাওয়ার অনুপযোগী হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন। প্রকৃত উপযোগীরা এ ভাতার আওতাভুক্ত হলে, ভাতা তুলতে গিয়ে খরচপাতির নামে ঘুষ লেনদেন না ঘটলে কর্মসূচিটিতে দেশের চেহারা পাল্টে যেতে পারত।

রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অভাব-অনটনের মধ্যেও এবারের বাজেটেও মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা কিছুটা বাড়ানো হবে। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির চাপে হিমশিম খাওয়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সহায়তা দিতে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা অন্তত সাড়ে পাঁচ লাখ বাড়ানোর একটি আভাস আছে। বর্তমানে মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির আওতায় ১৩ লাখ ৪ জন ৮০০ টাকা করে ভাতা পাচ্ছেন। আগামী বাজেটে এ খাতে নতুন করে ১ লাখ ৩০ হাজার উপকারভোগী অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে। একই সঙ্গে ভাতা বাড়িয়ে ১ হাজার টাকা করার আলোচনা চললেও তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ৮০ বছর বা এর বেশি বয়সী প্রবীণ নাগরিকদের ভাতা প্রতি মাসে ৬০০ থেকে বাড়িয়ে ৯০০ টাকা করার প্রস্তাব এসেছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে।

কয়েক বছর ধরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নিম্ন আয়ের মানুষ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে কম দামে খাদ্য সহায়তা, বয়স্ক, দুস্থ মা, বিধবা নারী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন জনগোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ায় সামাজিক নিরাপত্তা বলয় তৈরি হয়েছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় ১১৫টি কর্মসূচিতে মোট ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ বরাদ্দ মোট বাজেটের ১৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং জিডিপির ২ দশমিক ৫২ শতাংশ। বলার অপেক্ষা রাখে না, নতুন বাজেট হবে কিছুটা সংকোচনমূলক। এ অবস্থায় উপকারভোগী এবং ভাতা বাড়ানোর বিষয়টি অনেকটাই নির্ভর করছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর উদারতার ওপর। এর বিপরীতে মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় এবার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সংকুচিত হওয়ার কিছু ওড়া খবরে নানা প্রতিক্রিয়া ঘুরছে। এগুলো মিথ্যা হোক। অর্থনীতি চাপে থাকলেও যেভাবেই হোক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে। মূল্যস্ফীতিসহ অন্যান্য কারণে নিম্ন আয়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বয়স্ক, বিধবা নারী, বিশেষ চাহিদাসম্পন্নরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সংকুচিত হলে এ বিরাট জনগোষ্ঠীর সমস্যা বাড়বে।

২০২৩ সালের বাংলাদেশ জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১। এর মধ্যে প্রতিবন্ধী প্রায় ৪৬ লাখ, যা মোট জনগোষ্ঠীর ২ দশমিক ৮ শতাংশ। বর্তমানে মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির আওতায় রয়েছে ১৩ লাখ ৪ হাজার মানুষ, যা আগামী বাজেটে হতে পারে সাড়ে ১৪ লাখ থেকে ১৫ লাখ। আর্থিকভাবে অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্য থেকে চলতি বাজেটে ২৯ লাখ মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় রাখা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতের একটি কর্মসূচি বিধবা ও স্বামী নিগৃহীত মহিলা সহায়তা ভাতা। এ কর্মসূচির আওতায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৫ লাখ ৭৫ হাজার জনের জন্য জনপ্রতি মাসিক ৫৫০ টাকা হারে মোট ১ হাজার ৭১১ দশমিক ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। দেশের ৬৫ বছরে বেশি বয়সী পুরুষ ও ৬২ বছরের ঊর্ধ্বের নারী, যারা অসচ্ছল-অসহায় এবং যাদের বার্ষিক আয় ১০ হাজার টাকার নিচে, তারা বয়স্ক ভাতা পাওয়ার আবেদন করতে পারেন। সমাজসেবা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫৮ লাখ ১ হাজার বয়স্ক ব্যক্তিকে জনপ্রতি মাসিক ৬০০ টাকা হারে মোট ৪ হাজার ২০৫ দশমিক ৯৬ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেশি ঝুঁকিতে বয়স্ক বা প্রবীণরা। জনশুমারির তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জনগণের ৬ দশমিক ১৪ শতাংশের বয়স ৬৫ বছরের বেশি। অর্থাৎ বয়স্ক জনগোষ্ঠী ১ কোটি ১০ লাখ ৪১ হাজার ৪৯৫ জন।

পাচার, চুরি-চামারি যদ্দূর সম্ভব কমাতে পারলে, অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের লাগাম টানলে সেই অর্থের কিছু অংশ সামাজিক নিরাপত্তা খাতে দেওয়া কোনো বিষয়ই নয়। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে দেওয়া বরাদ্দ বণ্টনে মনিটর জোরদার করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। সাধারণত প্রতি বছরই নির্দিষ্ট হারে বাজেটের আকার বাড়ে। কিন্তু দেশে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, মূল্যস্ফীতি, প্রয়োজনীয় রাজস্ব আদায় করতে না পারাসহ বিভিন্ন কারণে সম্প্রসারণমুখী বাজেটের পরিবর্তে সংকোচনমুখী বাজেটের দিকে যেতে হচ্ছে। এর প্রভাব পড়তে যাচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে। এ অবস্থায় আগামী অর্থবছরে বাজেটের আকার বড় করার সুযোগ নেই। আবার এও সত্য যে, দেশে ৯ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্নআয়ের মানুষসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সমস্যায় আছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নিম্ন আয়ের মানুষ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে কম দামে খাদ্য সহায়তা, বয়স্ক, দুস্থ মা, বিধবা নারী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন জনগোষ্ঠীর সুবিধায় হেরফের হলে সামাজিক নিরাপত্তা জাল ছিঁড়ে বড় রকমের গণ্ডগোল পাকতে পারে।

প্রধানমন্ত্রীর ধারেকাছের সূত্রগুলোর আভাস বেশ সুখকর। এবার বয়স্ক ভাতার সুবিধাভোগীর সংখ্যা দুই লাখের মতো বাড়ানো হতে পারে বলে আভাস তাদের। দুস্থ ও বিধবা ভাতার আওতায় আরও দুই লাখ এবং মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচিতেও আরও দেড় লাখ নাগরিককে যুক্ত করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। প্রতিবন্ধী সহায়তা কর্মসূচিতে আরও কিছু ব্যক্তিকে যুক্ত করার পরিকল্পনার কথাও শোনা যাচ্ছে। কঠিন এ সময়ে নানান মন্দের মধ্যে এমন কিছু সময়োপযোগী সুখবর শুনতে কার না ভালো লাগে? এ খাতে হাত চালানো চোরগুলোকে বধ করার খবর পেলে শুনতে আরও ভালো লাগবে।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *