বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়:ছাত্রলীগের কমিটি না থাকলেও আধিপত্য বিস্তারে সংঘর্ষ


বরিশাল অফিস : ঘটনা ২০২৪ সালের ২৮ মে। ওইদিন বেলা সাড়ে ৩টার সময়ে ভোলা রোডে ডেকে নিয়ে মারধর করা হয় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) লোকপ্রশাসন বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী প্রসেনজিৎ ও আবির হাসান লিটনকে। প্রসেনজিৎ রক্তিম গ্রুপের অনুসারী ও ছাত্রলীগ কর্মী।
এ ঘটনায় জড়িত থাকার বা ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগ ওঠে রিদম-আরাফাত ও আল সামাদ শান্তর বিরুদ্ধে। তারা মারধরে সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও জড়িত থাকার অভিযোগ তোলেন ভুক্তভোগী প্রসেনজিৎ।
এদিকে আরাফাত গ্রুপের অনুসারীরা উল্টো অভিযোগ তোলে প্রসেনজিৎ এর বিরুদ্ধে। ফোনে চার্জ দেওয়াকে কেন্দ্র করে প্রসেনজিৎ তার এক সিনিয়রের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় লিপ্ত হয়। পরে সেখানে তিনি ধ্বস্তাধ্বস্তি করেন বলে অভিযোগ তোলা হয়। এমনকি আইন বিভাগের শিক্ষার্থী অমিত হাসান রক্তিম দীর্ঘদিন ধরে হলের ৪০২১ নম্বর কক্ষ অবৈধভাবে দখল করে থাকতেন বলেও অভিযোগ তাদের। সেখানেই থাকতেন প্রসেনজিৎ ও আবির হাসান লিটন।
এদিকে ভুক্তভোগী আবির হাসান বলছেন, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী পাভেলের নেতৃত্বে তাকে মারধর করা হয়। এ ঘটনাসহ ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ছয় বছরে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একাধিক দল ও উপদলের মধ্যে সংঘর্ষ এবং মারামারির ঘটনা ঘটেছে অন্তত ২০ বার। তদন্ত কমিটি হয়েছে ১৫ বার। তার মধ্যে বিচার হয়েছে একটি। এ ছাড়াও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন ঘটনাও ঘটিয়েছে একাধিক ছাত্রলীগের গ্রুপ। সব ঘটনার পেছনে ছিল তাদের আধিপত্যের দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় ২০১১ সালে। একযুগের বেশি সময় পার করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র-রাজনীতি অর্থাৎ ববি ছাত্রলীগের কোনো কমিটি হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। কমিটি না থাকলেও রয়েছে ছাত্রলীগের একাধিক গ্রুপ বা ছাত্রলীগের উপদল। গ্রুপগুলো বিভিন্ন সময়ে আধিপত্য বিস্তারে জড়িয়ে পড়েছে সংঘর্ষে।
একের পর এক নানা ঘটনার জন্ম দেওয়া ও সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করা বিভিন্ন নেতাকর্মীরা। হল দখল, চাঁদাবাজি ও মারধর করা থেকে শুরু করে নানা অপকর্মে জড়িত বলছে বিভিন্ন সূত্র। এসব ঘটনায়ও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা। ঘুরে ফিরে এসব অপরাধের নেতৃত্ব দানকারী ১২ থেকে ১৫ জনের নাম আসে। অনেকে একাধিক মামলায় জেলও খেটেছেন।
২০২৩ সালের ২৪ জানুয়ারি ভোর সাড়ে ৫টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরেবাংলা হলের ৪০১৮ নম্বর কক্ষে হেলমেট পরে একদল যুবক মহিউদ্দিন আহমেদ সিফাতের ওপর হামলা চালায়। এ হামলায় জড়িত থাকার সন্দেহে আলীম সালেহী, রিয়াজ উদ্দিন মোল্লা, শামীম সিকদার ও শেখ রেফাত মাহমুদকে আটক করে বন্দর থানা পুলিশ। একই সালের ২ এপ্রিলেও হামলার ঘটনা ঘটে। তাতেও আহত হয় ছাত্রলীগ কর্মীরা। ১৯ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এখানেও তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর পর রাত ৩টা পর্যন্ত কয়েক দফায় এ সংঘর্ষ চলে। আবিদ-রিদম গ্রুপ ও নাভিদ-রাফি গ্রুপ ছিল তখন বেশ সক্রিয়।
২০২৩ সালের ৫ আগস্ট আনুমানিক রাত ১১টার দিকে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে উভয়পক্ষের ১২ শিক্ষার্থী আহত হয়। তখন একটি গ্রুপের নেতৃত্বে ছিল রক্তিম-বাকি, অপরটিতে ছিল শরিফ-মঞ্জু-রাফি গ্রুপ। ২০২৩ সালের ১২ অক্টোবর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের একটি কক্ষে আটকে ইংরেজি বিভাগের ছাত্র মুকুল আহমেদকে রাতভর নির্যাতন এবং পিটিয়ে হাত ভেঙে দেওয়া হয়। তবে এটি ছিল সাধারণ শিক্ষার্থীর একটি মেসেজকে কেন্দ্র করে।
২০২২ সালের ৫ জুলাই সিফাত-রুম্মান ও রক্তিম-বাকি গ্রুপের সঙ্গেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। একই সালের ১৪ আগস্টে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা করা হয়। ২০২১ সালের ৫ জুলাই রাতে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে ক্যাম্পাসে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনায় সাতজন আহত হয়েছিল। ২০১৯ সালের শেষ দিকে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের দুই দফায় সংঘর্ষে দুজনকে কুপিয়ে জখম করা হয়। ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ২০টি হামলা-পাল্টা হামলা বা সংঘর্ষের মতো ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ক্ষুদ্র কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাও ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সূত্র ও গণমাধ্যম সূত্রে এসব তথ্য ওঠে এসেছে।
আধিপত্য বিস্তার ও সংঘর্ষ নিয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগ নেতা অমিত হাসান রক্তিম বলেন, আমরা মেধাভিত্তিক ও শিক্ষাবৃত্তি রাজনৈতিক চর্চা করি। আধিপত্য বিস্তারে রাজনীতিতে বিশ্বাসী না। সংঘর্ষের বিষয়ে তিনি বলেন, যারা আধিপত্যের রাজনীতি করে তারাই সংঘর্ষে জড়ানোর চেষ্টা করে। আর এসবের পেছনে ঘুরেফিরে ১২ জনের নাম আসে যারা এই হামলার কাজে জড়িত। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও রয়েছে। তবে ছাত্রলীগের দল বা উপদল সৃষ্টির পেছনে তিনি সাংগঠনিক কাঠামো না থাকার কথা উল্লেখ করেছেন। বর্তমানে ছাত্রলীগের কমিটির প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করছেন তিনি।
ছাত্রলীগ নেতা মোবাশ্বির রিদম জানান, মোবাইলকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি একটি ঘটনা ঘটেছে, যেখানে আমি সমাধান করার চেষ্টা করেছিলাম মাত্র। কিন্তু অরাজনৈতিক একটি ঘটনাকে প্রতিপক্ষরা প্রতিহিংসায় আমার নাম জড়িয়েছে। আমি কোনো মারামারি বা সংঘর্ষে কখনো লিপ্ত ছিলাম না। আর ছাত্রলীগের কমিটি না থাকায় অনেক বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। যাদের ছাত্রত্ব নেই, যারা আধিপত্যের রাজনীতি করে তারাই মূলত এসব ঘটনা ঘটায়। তিনি বলেন, অপ্রীতিকর ঘটনা শক্ত হাতে দমন করতে ছাত্রলীগের কমিটি এখন খুবই দরকার।
আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে কলম বন্ধ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণমাধ্যমকর্মীদের ওপরেও হামলা চালানো হয় কয়েকবার। ২০২২ সালের ১৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে ববি ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেওয়া হয়। তাদের উত্তেজনা পরিস্থিতিতে ভিডিও ধারণ করতে যান এক সংবাদকর্মী। এক পর্যায়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়া হয় এবং মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। পরে ফোন ফেরত চাইতে গেলে আল সামাদ শান্তসহ বেশ কয়েকজন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস ক্লাবের দুই সংবাদকর্মীকে মারধর করে আহত করে। ২০২৪ সালের ৯ মে ববি সাংবাদিক সমিতির এক সংবাদকর্মী মোহাম্মদ এনামুল হোসেনকেও লাঞ্ছিত করার অভিযোগ ওঠে আইন বিভাগের তমালের অনুসারীরদের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে সংবাদকর্মীরা সংবাদ পরিবেশন করায় তাদের হেনস্তা ও ফোন দিয়ে হুমকি দিয়েছে ছাত্রলীগ কর্মীরা।
এভাবেই বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগের উপদলের সৃষ্টি হয়ে আধিপত্য জানান দিতে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে ও মারামারিতে জড়িয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে অন্তত ১৫টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তদন্ত কমিটি গঠন হলেও অদৃশ্য কারণে এসব ঘটনার বিচার করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে ২০১৯ সালের একটি ঘটনার বিচার করা হয়েছিল। সুধীজন ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিচারহীনতার কারণে বারবার সংঘর্ষে বা আধিপত্য বিস্তারে জানান দিতে হামলা ও পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটেছে। সৃষ্টি হয়েছে ছাত্রলীগের বিভিন্ন উপদলের। ক্ষতি হয়েছে বুঝে উঠতে না পারা অনেক নবাগত স্বঘোষিত ছাত্রলীগ কর্মীর।
ক্যাম্পাসে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গ্রুপের একচ্ছত্র নেতৃত্বে দিতে দেখা গেলেও সেটি ছিল ক্ষণস্থায়ী। ছাত্রলীগের কোনো দল বা উপদল একাধিপত্য অধিক সময় নিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। অনেকে হামলা-মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এমনকি অনেকের অভিযোগ হামলায় বা সংঘর্ষে জড়িত না থাকলেও মামলায় নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মো. আব্দুল কাইউম জানান, আমি দায়িত্ব পেয়েছি ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। দায়িত্বের পর থেকে এখন পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের পাশে সবসময় থাকবে। তাদের সহযোগিতাও আমাদের দরকার। কিন্তু কোনো শিক্ষার্থী ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে অপরাধমূলক কাজ করলে সেটির দায়ভার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নেবে না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তে সত্যতা প্রমাণ পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বিচারহীনতার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো শিক্ষার্থী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করবে। বিশ্ববিদ্যালয় শান্ত পরিবেশ বজায় থাক এটাই সবার চাওয়া।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়