ভারতীয় চিনিতে সয়লাব বাজার


ইত্তেহাদ নিউজ,ঢাকা :সীমান্তবর্তী শত শত পয়েন্ট দিয়ে ভারত থেকে নিম্নমানের চিনি আসছে বিপুল পরিমাণে। এই চোরাচালান রোধে বিজিবি, পুলিশ তৎপর হওয়া সত্ত্বেও ব্যাপকতা কমছে না। ভারতীয় চিনি দেশি চিনির বস্তায় ভরে বিক্রি করা হচ্ছে। প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় ও মদতে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে খবরের কাগজের প্রতিনিধিরা জানান।
পাহাড় থেকে নেমে আসা একটি ছড়ার পাশে জনাপঞ্চাশেক লোক। মাথায় বস্তা। সারিবদ্ধভাবে নেমে আসছেন তারা। ছড়ার ওপারে মাথার বস্তাগুলো ফেলে চলে যাচ্ছেন। এরপর সেখান থেকে অন্য পন্থায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ দৃশ্য একটি ভিডিওর। প্রায় এক মিনিটের ওই ভিডিও চিত্রে বস্তায় বয়ে নিয়ে যাওয়া পণ্য হচ্ছে চিনি। সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার সীমান্ত এলাকার এ দৃশ্য এখন জেলার সীমান্তবর্তী অন্য উপজেলাগুলোতেও দেখা যাচ্ছে।
কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, জকিগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার এলাকার সীমান্তে চোরাচালান বলতেই এখন যে পণ্য, সেটা হচ্ছে চিনি। গত প্রায় দুই বছর ধরে চিনির চোরাচালানের জেরে এখন কোনটা ভারতীয়, আর কোনটা দেশি চিনি- সেটা চেনা দায়। সিলেটের পাইকারি বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারতীয় চিনি ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার থেকে ৬ হাজার ১০০ টাকায়। দেশি চিনির দাম ৬ হাজার ৭০০ থেকে ৬ হাজার ৮৫০ টাকা। দামের তারতম্য থাকায় চিনির চোরাচালান থামছে না।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে চোরাই চিনি ধরপাকড়ে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এতে গোয়েন্দা পুলিশও সক্রিয়। কিন্তু এ অভিযানেও সুফল মিলছে না। বস্তার পর বস্তা চিনি ধরা পড়লেও থামছে না চোরাই চিনির কারবার।
এসএমপির অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিডিয়া) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, চোরাচালান প্রতিরোধে আগেকার যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন অধিকতর তৎপর পুলিশ। অবৈধ পথে আসা বিপুল পরিমাণ মালামাল জব্দ হচ্ছে। বাহকেরাও ধরা পড়ছে।
ভারতীয় চিনি চোরাচালানের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে সুনামগঞ্জ। অভিযোগ আছে জেলা ছাত্রলীগ নেতাদের নেতৃত্বে প্রতি রাতে পাচার হয়ে আসছে ২-৩ কোটি টাকার চিনি। রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে সীমান্তের ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্য থেকে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে চোরাইপথে আসছে এসব চিনির চালান। পরে বিশ্বম্ভরপুর-সুনামগঞ্জ সড়ককে নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করে পাচার করা হচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। অভিযোগ আছে পুলিশ সদস্যদের ম্যানেজ করেই চলছে এই নৈরাজ্য। তবে পুলিশের কেউ জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেন পুলিশ সুপার।
সুনামগঞ্জ থেকে সড়কপথে ট্রাকগুলো নিরাপদে চলে যাওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের সম্পৃক্ততা আছে এমন অভিযোগের বিষয়ে সুনামগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ এহসান শাহ বলেন, শহরে পুলিশের নির্দিষ্ট এলাকা ভাগ করে দেওয়া আছে। এসব এলাকায় রাতে তারা নিয়মিত টহল পরিচালনা করেন। পুলিশের কাজ অবৈধ মাদক, চোরাকারবারিদের নিয়ন্ত্রণ করা। এসব কাজের সঙ্গে জড়িত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ রকম কোনো তথ্যও নেই আমার কাছে। যদি পুলিশের বিরুদ্ধে স্পষ্ট কোনো অভিযোগ থাকে, তা হলে তদন্ত করে তার যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সুনামগঞ্জের সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান বিষয়ে সুনামগঞ্জের সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পুলিশের আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, সীমান্তসহ যেকোনো ধরনের চোরাচালান পুলিশ শক্ত হাতে দমন করছে। জনগণের পাশে পুলিশ সব সময় ছিল, জনগণের জন্যই পুলিশ কাজ করে। তাই এই ধরনের কাজে কোনো পুলিশ জড়িত থাকলে এবং তা প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ভারত-বাংলাদেশের ১০২ কিলোমিটার ফেনীর সীমান্ত দিয়ে প্রতিনিয়ত অবৈধপথে আসছে ভারতীয় চিনি। এসব অবৈধ ও নিম্নমানের চিনি আনার নিরাপদ রুট হিসেবে ফেনী সীমান্তকে ব্যবহার করছে চোরাকারবারিরা। গত এক মাসে ৩৭ হাজার ৭৫০ কেজি ভারতীয় চিনি জব্দ করেছে বিজিবি।
গত ২৫ মে ছাগলনাইয়া উপজেলার মহামায়া ইউনিয়নের দেবপুর এলাকার ইউপি সদস্য ওবায়দুর রহমানের বাগানবাড়ি থেকে ১৯৮ বস্তায় ১০ হাজার কেজি ভারতীয় চিনি আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ছাগলনাইয়া থানায় মামলা দায়ের করে বলে জানিয়েছেন থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. হাসান ইমাম।
ফেনী-৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল শেখ মো.বদরুদ্দোজা জানান, ফেনীর ১০২ কিমি সীমান্তে গত মে মাসে ৩৭ হাজার ৭৫০ কেজি ভারতীয় চিনি জব্দ করা হয়েছে। এ ছাড়া দিন-রাত চোরাচালান চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো স্থান থেকে চোরাচালান চক্রের সদস্যদের ভারতীয় বিভিন্ন মালামালসহ আটক করা হচ্ছে।
কলমাকান্দা সীমান্তে থামছে না চোরাইপথে ভারতীয় চিনি পাচার। সাময়িকভাবে বন্ধ থাকার পর আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে এই চোরাই চক্রটি। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন বলছে এদের বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে, মালামাল জব্দ করা হচ্ছে, চোরাকারবারিদের আটক করা হচ্ছে। তারপরও এ চোরাই চক্রটি বেপরোয়া হয়ে ওঠায় উদ্বিগ্ন এলাকার সাধারণ মানুষ।
কলমাকান্দার লেঙ্গুরা বিজিবি ক্যাম্পের কমান্ডার সেলিম মিয়া জানান, সীমান্তে চোরাচালান প্রতিরোধে বিজিবি চোরাই পণ্য আটক করছে, মালামাল জব্দ করছে। এ ব্যাপারে বিজিবির সদস্যরা দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন। তবে সীমান্তে বন্দর বা এলসি স্থাপন করা হলে জেলার কলমাকান্দা সীমান্তে দুই দেশের চোরাচালান কমে যাবে।
জেলার সীমান্তবর্তী কলমাকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. লুৎফুল হক বলেন, কলমাকান্দায় ভারতীয় চোরাচালান বন্ধ করার লক্ষ্যে তৎপর ও সোচ্চার স্থানীয় পুলিশ। নিয়মিত চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে, মালামাল জব্দ করা হচ্ছে ও জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
কলমাকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আমি কলমাকান্দায় আসার পর বেশ কয়েকটি অভিযান চালানো হয়েছে। তবে চোরাচালান প্রতিরোধে বড় দায়িত্ব বর্ডার গার্ডের। উপজেলা প্রশাসনের বিভিন্ন সভায় চোরাচালান নিরসনে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।
পাইকারি বাজারে মোড়ক পাল্টিয়ে ভারতীয় চিনি বিক্রি হচ্ছে দেদার। বড় বাজার, কাচারি বাজার, পুরান থানা বাজারসহ জেলার অন্যান্য বাজার ও উপজেলার বিভিন্ন পাইকারি দোকানগুলোতে এসব ভারতীয় চিনি বিক্রি করা হচ্ছে। পাইকারি দোকানদাররা বাংলাদেশের বিভিন্ন কোম্পানির প্যাকেট দেখিয়ে বিক্রি করছেন ভারতীয় চিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বড় বাজারের একাধিক ব্যক্তির অভিযোগ, যারা চিনি সিন্ডিকেট ব্যবসায় জড়িত, তাদের কারণে কোম্পানির চিনিগুলোর চাহিদা কম। স্বল্পমূল্যে চোরাইপথে ভারতীয় চিনি কিনে আনলেও একই দামে বিক্রি করছেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। গোপনে এসব ভারতীয় চিনি শহরের বিভিন্ন শেড বা গোডাউনে রাখা হয়। রাত ১০টা ১১টার পর চিনিগুলো বড় ট্রাকে করে শহরের ভেতর ঢোকে। কেউ কেউ বলছে সবকিছু ম্যানেজ করেই কিশোরগঞ্জ শহরে ভারতীয় চিনি আনা হচ্ছে চোরাইপথে।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়