দৌলতপুর কলেজের অধ্যক্ষের সম্পদের পাহাড়


ইত্তেহাদ নিউজ,কুষ্টিয়া: কুষ্টিয়ার দৌলতপুর কলেজের অধ্যক্ষ মো. ছাদিকুজ্জামান খান সুমনের বিরুদ্ধে অবৈধ নিয়োগ ও বেতন বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। কলেজে নিয়োগ পাওয়া অনার্স শাখার শিক্ষকদের তৃতীয় ও দ্বিতীয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ দেখিয়ে অবৈধ পন্থায় বেতন শিট করে হাতিয়ে নিয়েছেন ৫ কোটি টাকারও বেশি। এ ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স শাখার শিক্ষক এবং কর্মচারী নিয়োগ, কলেজ সরকারি করার নামে শিক্ষকদের কাছ থেকে জোরপূর্বক অর্থ আদায়, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় সহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি করে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অধ্যক্ষ সুমন দৌলতপুর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হওয়ার সুবাদে এবং সাবেক এমপি সরওয়ার জাহান বাদশাহ’র আস্থাভাজন হওয়ায় অবাধে এই বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। কলেজের কোনো শিক্ষক এমন অনিয়মের প্রতিবাদ করলে তার কপালে নেমে আসে খড়্গ। দৌলতপুর কলেজের ভূগোল বিভাগের প্রদর্শক মো. জহুরুল আলম অধ্যক্ষ সুমনের অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্য ও তার দুর্নীতির তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরলে তা ভাইরাল হয়ে যায়।
প্রদর্শক জহুরুল আলম জানান, দৌলতপুর কলেজের বিভিন্ন বিভাগে অনার্স শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ নেয়া ১২ জন ও জাল নিবন্ধন সনদে তৃতীয় পর্যায়ে শিক্ষক হিসেবে মোট ১৩ জনকে প্যাটার্ন বহির্ভূতভাবে ডিগ্রি পর্যায়ে তৃতীয় ও দ্বিতীয় পর্যায়ে শিক্ষক হিসেবে ভুয়া নিয়োগ দেখিয়ে ২০২৩ সালে প্রায় আড়াই কোটি টাকার নিয়োগ ও বেতন বাণিজ্য করেছেন অধ্যক্ষ মো. সুমন। অনার্স শাখায় নিয়োগ পাওয়া ওসব শিক্ষকদের তথ্য গোপন করে অবসরে যাওয়া দৌলতপুর কলেজের অধ্যক্ষের স্বাক্ষর জাল ও স্ক্যান করে অনলাইনে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ভুয়া তথ্য প্রেরণ করে তাদের ডিগ্রি পর্যায়ে তৃতীয় ও দ্বিতীয় শিক্ষকের বেতন করানো হয়। সরজমিন তদন্ত করলে এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ওইসব শিক্ষকদের অনার্স শাখার তালিকা দেখলেই আসল রহস্য উদ্ঘাটিত হবে। এ ছাড়াও চলতি বছরের এপ্রিল-মে মাসে বিভিন্ন বিভাগে শূন্য হওয়া তৃতীয় শিক্ষক পদে অনার্স শাখায় নিয়োগ পাওয়া আরও ৭ শিক্ষককে তৃতীয় পর্যায়ে শিক্ষক হিসেবে অবৈধ নিয়োগ দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে জনপ্রতি ২০-২৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন অধ্যক্ষ। অনার্স শাখার ওই ৭ শিক্ষকের কাছ থেকে তৃতীয় পর্যায়ে শিক্ষক হিসেবে বেতন বাবদ ১ কোটি ৪৪ লাখ টাকার নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন তিনি।
কলেজে তৃতীয় গ্রেডের শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালা ও শর্তাবলী না মেনে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে ম্যানেজ করে কলেজ ছুটি থাকাকালীন সময়ে তিনি এসব অবৈধ নিয়োগ ও অর্থ বাণিজ্য করেছেন। অনার্স শাখায় নিয়োগ পাওয়া যেসব শিক্ষককে অবৈধ ও জাল স্বাক্ষরে ভুয়া নিয়োগ দেখিয়ে ৪ কোটি টাকারও বেশি নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন ইতিহাস বিভাগের কবিরুল ইসলাম। ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জাকির হোসেনের মৃত্যুর পর তার স্থলে স্থলাভিষিক্ত করে অবৈধ পন্থায় প্রায় ৩০ লাখ টাকা নিয়ে কবিরুল ইসলামের বেতন তুলে নিয়েছেন অধ্যক্ষ সুমন। এ ছাড়াও হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের আবুল কালাম আজাদ ও তরুণ হোসেন লাল্টু, ইসলামের ইতিহাস সংস্কৃতি বিষয়ে মির্জা আসলাম, মমিনুল ইসলাম, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের কে এইচ এম ইকবাল (হাবিব), জীব বিজ্ঞান বিভাগের মিজানুর রহমান জুয়েল, ভূগোল বিভাগের শাহাজুল ইসলাম, গণিত বিভাগের আরিফুর রহমান, অর্থনীতি বিভাগের সাহেব আলী, সহকারী লাইব্রেরিয়ান মোমেনুর রহমান মোহন, বাংলা বিভাগের ফারজানা ববি লিনা এবং ইংরেজি বিভাগে জাল নিবন্ধন সনদে তৃতীয় গ্রেডের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ নেয়া হয় রাশেদুজ্জামান রাসেলকে। এ ছাড়াও সদ্য অবৈধ নিয়োগ ও বেতন বাণিজ্যের তালিকায় যাদের নাম তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন, অর্থনীতি বিভাগের গোলাম মোর্শেদ, ব্যবস্থাপনা বিভাগের রঞ্জু আহমেদ, বাংলা বিভাগের হালিমা খাতুন, রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের মনিরা খাতুন, ইংরেজি বিভাগের কামরুন্নাহার কেমি, ইসলামের ইতিহাস বিভাগের রাবেয়া খাতুন, গণিত বিভাগের অচেনা শিক্ষক সহ বিভিন্ন বিভাগের ৭ জন শিক্ষক। শুধু তাই নয়, কলেজে প্রতি বিভাগে একজন করে পিয়ন ও অফিস সহকারী নিয়োগ দিয়ে তাদের কাছ থেকেও প্রায় এক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন অধ্যক্ষ। এ ছাড়াও তিনি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দিয়ে বাংলা, ইংরেজি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ভূগোল, হিসাব বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস সহ বিভিন্ন বিভাগের অনার্স ও মাস্টার্স শাখায় ব্যাকডেটে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে জনপ্রতি ৫-৭ লাখ টাকা নিয়ে এক কোটি টাকারও বেশি নিয়োগ বাণিজ্য করেছেন অধ্যক্ষ সুমন। দৌলতপুর কলেজের কারিগরি (বিএম) শাখা এমপিও হলে ওই শাখার শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকেও অর্ধকোটি টাকা নিয়ে তাদের বেতন কার্যক্রম সম্পাদনে সহায়তা করেছেন। একইভাবে নিবন্ধনধারী শিক্ষকদের দৌলতপুর কলেজে পদায়ন করা হলে তাদের বেতন বিলে স্বাক্ষর করতেও মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে থাকেন তিনি।
দৌলতপুর কলেজকে সরকারি করা হবে বলে কলেজের সকল শিক্ষক ও কর্মচারীদের কাছ থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকা জোরপূর্বক আদায় করে সমুদয় অর্থ আত্মসাৎ করেছেন অধ্যক্ষ সুমন এমন অভিযোগ কলেজের শিক্ষকদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে। আর কলেজ থেকে হাতিয়ে নেয়া কোটি কোটি টাকা দিয়ে দৌলতপুর মাস্টারপাড়ায় লিপ্টযুক্ত বিলাসবহুল দু’টি ৭ তলা ভবন, কলেজ সংলগ্ন মাঠে খামারসহ প্রায় ২০ বিঘা জমি, কুষ্টিয়ায় পরিমল টাওয়ার সংলগ্ন বাটা ভবনসহ কুষ্টিয়া শহরে দু’টি বাড়ি। এ ছাড়াও তিনি কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে খলিসাকুণ্ডি ডিগ্রি কলেজের পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও গোয়াল গ্রাম ডিগ্রি কলেজের সভাপতি হয়ে ওইসব প্রতিষ্ঠানেও একই কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছেন। তবে অধ্যক্ষ ছাদিকুজ্জামান খান সুমন তার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এসব তথ্য মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আমার বিরুদ্ধে জহুরুলরা অপপ্রচার চালাচ্ছে, ’১৮ সালের পর থেকে কলেজে কোনো শিক্ষক নিয়োগ নাই, নতুন শিক্ষক নিয়োগে ডিজির ও বোর্ডের প্রতিনিধি লাগে, সেখানে আমি একা শিক্ষক নিয়োগ দেবো কীভাবে।
দৌলতপুর কলেজের অধ্যক্ষের অনিয়ম ও দুর্নীতের বিষয়ে দৌলতপুর কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি এড. হাসানুল আসকার হাসু বলেন, আমি কোনো অবৈধ টাকা পয়সা খাই না, কলেজে কোনো নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে কিনা এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। এবিষয়ে দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ওবায়দুল্লাহ বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই, আমি খোঁজ নিয়ে দেখবো।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়