অনুসন্ধানী সংবাদ

বাংলাদেশের ‘নিখোঁজ বিলিওনিয়ার’ ও সম্পদশালীদের গোলকধাঁধা

missing 2406111346
print news

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্কজমকালো অভিজাত গুলশান ক্লাবের অদূর দিয়ে বয়ে গেছে শান্ত গুলশান লেক। পাশেই একটি ১৪ তলা ভবনের নির্মাণ কাজ প্রায় শেষের পথে। কমলা রঙের হেলমেট এবং নিরাপত্তা সুরক্ষা সামগ্রী পরিহিত নির্মাণ শ্রমিকরা ভবনটির বাইরের দেয়াল ও কাঁচে শেষবারের মতো ছোঁয়া লাগাচ্ছেন।

নামকরা রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান বিটিআই নির্মিত ভবনটি দেশটির সবচেয়ে ব্যয়বহুল আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট ভবন হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। এটির ১২টি অ্যাপার্টমেন্টের প্রতিটি ৭ হাজার বর্গমিটারের, যাতে রয়েছে অত্যাধুনিক সব সুযোগ সুবিধা। বায়োমেট্রিক নিরাপত্তা পদ্ধতি এবং এলিভেটর ছাড়াও আলোক বাতিগুলো কৃত্রিম বা এআই এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে।

নির্মাণ শুরুর আগেই ২০২১ সালে ২০ কোটি টাকা (আড়াই মিলিয়ন ডলার) দামে সবগুলো অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি হয়ে যায়। বিটিআই চেয়ারম্যান ফয়জুর রহমান নিজেও একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করেন। ভবনটির অ্যাপার্টমেন্ট কেনার জন্য ৫০ জনেরও বেশি ব্যবসায়ীর আবেদন জমা পড়ে। সেখান থেকে সতর্কতার সঙ্গে যাচাই বাছাই শেষে মালিকানা হস্তান্তর করা হয়।

বাংলাদেশে বাড়তে থাকা জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনকারীর সংখ্যা কত, তা অজানা। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ শপিংমল যমুনা ফিউচার পার্কের মতো জমজমাট শপিংমলগুলোর সামনে ঝলমলে বিলবোর্ডে প্যাকেটজাত খাবার থেকে শুরু করে গাড়ি ও মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপন যেন তারই প্রমাণ।

কিন্তু বিটিআই নির্মিত ভবনটি যেন এর সবকিছুকেই ছাড়িয়ে গিয়েছে। ১৮ কোটি মানুষের দেশটিতে এই ভবনটি হাতেগোনা কিছু বিত্তশালীর কথা বলে দিচ্ছে।বোস্টন কনসালটিং গ্রুপের (বিসিজি) গবেষণা বলছে, বাংলাদেশে মধ্য আয় এবং বিত্ত শ্রেণির ভোক্তার সংখ্যা খুব দ্রুত বাড়ছে এবং ২০২৫ সাল নাগাদ তা মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। ফলে দেশটিতে সম্পদের বৈষম্য আরও গভীরতর হচ্ছে। এটি আমেরিকার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের সেই তলাবিহীন ঝুড়ির বাংলাদেশ থেকে ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির দেশে রূপান্তরের লক্ষণ হিসেবে দেখা গেলেও ধনী-দরিদ্রদের বিভাজন খুবই সুস্পষ্ট।

সরকারি তথ্যানুযায়ী, মাত্র ১০ শতাংশ সম্পদশালীর হাতে দেশটির মোট আয়ের ৪১ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ, যা মোটেই সমানুপাতিক নয়। বিপরীতে নিম্ন আয়ের ১০ শতাংশ মানুষের ক্ষেত্রে এটির পরিমাণ মাত্র ১.৩১ শতাংশ।

মিলিওনেয়ারদের উত্থান:

নিউইয়র্ক ভিত্তিক রিসার্চ ফার্ম ‘ওয়েলথ-এক্স’ ২০১০ থেকে ২০১৯ সালে সম্পদের বৃদ্ধির দিক থেকে বাংলাদেশকে গ্লোবাল লিডার হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করেছে। গবেষণায় বলা হয়, বছরে ৫ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৬০ কোটি টাকা আয় বৃদ্ধি পাওয়া (বর্তমান ডলার মূল্য ১৮.১টাকা দর হিসেবে) ব্যক্তি পর্যায়ে সম্পদশালীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে ১৪.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যেটি ১৩.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ভিয়েতনামকেও ছাড়িয়ে গেছে।

ওয়েলথ-এক্স এর আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির শীর্ষ ৫টি দেশের অংশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ, যেখানে ব্যক্তি পর্যায়ে উচ্চ সম্পদশালীর সংখ্যা আগামী পাঁচ বছরে ১১ দশমকি ৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের শেষে প্রাইভেট ব্যাংকগুলোতে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৮টি অ্যাকাউন্টে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় ১ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ১৯৭১ সালে দেশটির স্বাধীনতা লাভের পর যা ১৬ গুণ বেড়েছে। ২০০০ সালে উৎপাদন ও রপ্তানি দ্রুত বাড়তে থাকার বছরে ৩ হাজার ৪৪২টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়, যা অনেকগুলো অ্যাকাউন্টকে শক্তিশালী হয়ে উঠতে সহায়তা করে।

মোট ব্যাংক অ্যাকাউন্টের এক শতাংশেরও কম এই গোষ্ঠীকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় কোটিপতি। অথচ, ক্ষুদ্র এই গোষ্ঠীটির হাতেই ৪৩ দশমকি ৩৫ শতাংশ সঞ্চয়। এই বৈষম্য কোনভাবেই এড়ানো সম্ভব নয়। মাত্র তিন কিলোমিটারেরও কম ব্যবধানে সেই গুলশান লেকের পাশেই ঢাকার সবচেয়ে বড় কড়াইল বস্তির অবস্থান।

প্রায় ৪০টি ফুটবল মাঠের সমান এই বস্তিটির পাশেই ধনাঢ্যদের বসবাস যেন একেবারেই ভিন্ন এক চিত্র। কড়াইল বস্তিতে মাত্র ১০০ বর্গফুট খুপরি ঘরে একটি পরিবারের ৪-৫ সদস্যকে একসঙ্গে গাদাগাদি করে থাকতে হয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশেষ করে করোনা মহামারির লকডাউন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং পরবর্তীতে অর্থনীতির শ্লথ গতি বাংলাদেশের জনগণকে আরও দারিদ্র্যের মুখে ঠেলে দেয়।

বিভিন্ন সংস্থার ধারাবাহিক জরিপ প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, দরিদ্র এবং হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) কোভিড-১৯ পরবর্তী এক জরিপে দেখা গেছে, করোনা মহামারির কারণে ঢাকার প্রায় ৫১ শতাংশ মানুষ দরিদ্র থেকে চরম দারিদ্র্যের মুখে নিপতিত হয়েছেন।

এমনকি, বাংলাদেশের অষ্টম পঞ্চ-বার্ষিক পরিকল্পনায় ব্যর্থ নীতির কারণে অবিরাম বৈষম্য এবং সম্পদের সুষম বণ্টনের অভাবের বিষয়টি স্বীকার করা হয়েছে। দেশটির অর্থনীতিবিদ এমএম আকাশ এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ হিসেবে কর আদায় থেকে জিডিপি অনুপাত ৯ শতাংশকে উল্লেখ করে বলেন, এটি একটি উন্নয়নশীল দেশের ১৫ শতাংশ গড়ের অনেক নীচে।

তিনি বলেন, দরিদ্র মানুষের ওপর সরাসরি নানা করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হলেও ধনীদের বেলায় ব্যাপকভাবে কর ছাড় সুবিধা প্রদান করা হয়েছে।তিনি আরও বলেন, ধনীদের সম্পদের বড় একটি অংশ করের আওতার বাইরে থাকে।

ঢাকা ভিত্তিক থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ধারাবাহিকভাবে সরকারের করপোরেট ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং ধনীদের ওপর করারোপের পরিবর্তে কর ছাড় দেওয়ার সমালোচনা করেন।

তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্য হলো, শ্রমিকরা যখন ন্যায্য মজুরির দাবি তোলেন, তখন তারা দমন-পীড়নের শিকার হন। বিপরীতে অতি ধনাঢ্যরা ভালো সুবিধা লাভের পরও কর রেয়াত সুবিধা পান।’

অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিস্ময়করভাবে বাংলাদেশের মোট আয়ের ৪৫-৬৫ শতাংশ করের আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এর মূল কারণ, অতি ধনাঢ্যরা তাদের সম্পদের মূল্য বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কম দেখিয়ে কর ফাঁকি দেন।

বাংলাদেশের বিলিওনিয়ারের গোলকধাঁধা:

প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ফোর্বসের তালিকায় স্থান করে নেওয়া বাংলাদেশের সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজিজ খান বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি ব্যবসার মাধ্যমে তার ভাগ্য গড়েছেন।

বিশ্বে ৭৬টি দেশ রয়েছে যার প্রতিটিতে অন্তত একজন বিলিওনিয়ার রয়েছে। এসব দেশের মধ্যে ৪০টির অর্থনীতিই বাংলাদেশের তুলনায় ছোট। উদাহরণ হিসেবে, চিলির অর্থনীতির কথা ধরা যাক। দেশটির অর্থনীতি বাংলাদেশের অর্থনীতির আকারের প্রায় ৭৮ শতাংশ, কিন্তু বিলিওনিয়ারের সংখ্যা মাত্র ৭ জন। একইভাবে সাইপ্রাসের অর্থনীতি বাংলাদেশের ১৫ ভাগের এক ভাগ হলেও রয়েছে ৪ জন বিলিওনিয়ার।

বাংলাদেশি সাংবাদিক রাফি আহমেদ যিনি ‘নিখোঁজ বিলিওনিয়াররা’ নামে একটি প্রতিবেদন করেন। যেখানে তিনি দাবি করেছেন, বাংলাদেশে অনেক বিলিওনিয়ার আছেন, কিন্তু তারা তাদের সম্পদকে বিদেশে পাচার কিংবা রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে গোপন করছেন।

এক্ষেত্রে তিনি প্যান্ডোরা পেপার্সে ১১ বাংলাদেশির নাম প্রকাশের বিষয়টি তুলে ধরেন। রাফির বিশ্বাস, বিদেশে অর্থ পাচার এবং কর ফাঁকি দেওয়ার কারণে সম্পদশালীদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় সম্ভব হচ্ছে না।তিনি বলেন, ‘সম্ভবত একারণেই, বাংলাদেশি বিলিওনিয়াররা আন্তর্জাতিক তালিকায় দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত।’

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) নাজনীন আহমেদ উদ্বেগজনক হারে বিদেশে অর্থ পাচার এবং আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে পণ্যের দাম কম দেখানোর বিষয়টাকে তুলে ধরেন।

বাংলাদেশ থেকে বিপুল সম্পদ বিদেশে পাচারের বিষয়টি বেশ আলোচিত। ২০১৭ সালে গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদনে ‘অবৈধভাবে বিদেশে অর্থ পাচারে’র কারণে স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম শীর্ষে উঠে আসে।

নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘আমার ধারণা, বাংলাদেশে গোপনে অনেক বিলিওনিয়ার রয়েছেন, কিন্তু তারা তাদের অর্থ এদেশে রাখছেন না।’

মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরায় ‘Bangladesh’s ‘missing billionaires’: A wealth boom and stark inequality’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে অনুবাদ করেছেন মোহসিন কবির।

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *