বরিশালকে গিলে খাচ্ছে অবৈধ স্থাপনা, উচ্ছেদে নেই অভিযান


মামুনুর রশীদ নোমানী,বরিশাল : প্র্যাচ্যের ভেনিস খ্যাত বরিশাল। প্রতিনিয়ত অবৈধ স্থাপনায় ছেয়ে যাচ্ছে। ফলে সৌন্দর্য্য হারাচ্ছে নগরী।পরিনত হচ্ছে বস্তির শহরে। বাড়ছে যানজট।দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে পথচারীসহ নগরবাসীদের।তবে অবৈধ এসব স্থাপনা বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় স্থানীয় জনমনে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।
সরেজমিনে দেখা গেছে,বরিশালের সরকারি জমি দখল করে অবৈধ স্থাপনার হিড়িক লেগেছে।দেখার যেন কেউ নেই। দখলের হাত থেকে বাদ যায়নি বরিশাল সিটি কর্পোরেশন,জেলা প্রশাসন,সড়ক ও জনপথ বিভাগ,গনপূর্ত বিভাগ,জেলা পরিষদ,বিআইডব্লিউটিএ’র জায়গা।
বরিশাল নগরীর ত্রিশ গোডাউন এলাকা,বঙ্গবন্ধু উদ্যান, হাতেম আলী কলেজ চৌমাথা,নগর ভবন এলাকা,কালেক্টরেক্ট পুকুর এলাকা,বিবির পুকুর পাড়,নথুল্লাবাদ ও রুপাতলী বাস টার্মিনাল এলাকা,হাজি মহসিন মার্কেট (ডিসি মার্কেট) এলাকা,বান্দ রোড,শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় স্থায়ী,অস্থায়ী ও ভাসমান দোকান পাটসহ অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠছে।জমি সরকারি হলেও এসব এলাকার প্রভাবশালীরা জমি দখল করে কেউ জমি ভাড়া দেয় এবং কেউ কেউ স্থাপনা নির্মান করে ভাড়া দেয়।
বরিশাল নগরীর সৌন্দর্য্য রক্ষায় কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসছেনা।প্রশাসনের চোখের সামনে একের পরে এক অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠলেও নিরব ভুমিকায়। আইন অনুযায়ী অবৈধ স্থাপনা বন্ধের নির্দেশ থাকলেও প্রতিনিয়ত গড়ে তুলছে স্থাপনা নির্মান কাজ। প্রভাবশালীদের আধিপত্যে প্রশাসনও যেন নীরব ভূমিকায়। পরিবেশবাদীদের দাবি এমন চলতে থাকলে বরিশাল হবে বস্তির নগরী ।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী ও উন্নয়ন সংস্থা রীচ টু আন রীচড (রান) এর নির্বাহী পরিচালক রফিকুল আলম বলেন,অবৈধ দোকাট পাটে ছেয়ে গেছে বরিশাল নগরী।এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য সিটি কর্পোরেশন রয়েছে। আমরা আশা করবো অতি শিঘ্রই সিটি কর্পোরেশন নগরী থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করবে।ফুটপাত দখল মুক্ত করতে হবে।মানুষ ফুটপাত এমনকি রাস্তা দিয়েও হাটতে পারছেনা। অবৈধ দখলদারদের স্থাপনার কারনে। সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছে ।তারা যেকোন সময় যেকোন মুহুর্তে মানুষের চলাচলের পথ থেকে অবৈধ দোকান পাট উচ্ছেদ করতে পারে। দায়ীদের জরিমানা করা প্রয়োজন, নচেৎ তারা আবার ঐ একই কাজ করবে। তিনি সিটি কর্পোরেশনের হস্তক্ষেপও কামনা করেন,যেন অতি দ্রুত অবৈধ দোকাট পাট উচ্ছেদ করা হয়।
পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি( বেলা) এর বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী লিংকন বায়েন বলেন,বরিশাল নগরীতে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ ও উচ্ছেদে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে আন্তরিক হতে হবে। প্রকাশ্যে এসব অবৈধ স্থাপনা নির্মিত হচ্ছে। এসব বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।তিনি বলেন,ফুটপাত বেদখল হওয়ায় মানুষ স্বস্তিতে হাটতে পারছেনা।ফুটপাত ও সড়ক জুড়ে যত্রতত্র অবৈধ দোকাটপাটের কারনে মানুষের চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে।মানুষের চলাচলের পথ সুগম রাখার দ্বায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। সুতারং সিটি কর্পোরেশনের উচিৎ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হলে পরিবেশ উন্নত হয়।
এ ব্যাপারে বরিশাল নদী-খাল বাঁচাও আন্দোলনের সদস্য সচিব ও উন্নয়ন সংগঠক এনায়েত হোসেন শিপলু বলেন,বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান পরিষদকে মানুষ ভোট দিয়েছে পরিবর্তনের জন্য। আগের মত অবস্থা থাকলে মানুষের মাঝে ক্ষোভ বাড়বে,বাড়বে হতাশাও। তিনি বলেন, সিটি নির্বাচনে মেয়রের প্রতিশ্রুতি ছিল বরিশাল নগরীর সৌন্দর্য্য বর্ধনের জন্য। এখন দখলদারিত্বে যদি আগের চেয়ে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হয় তার দায় সিটি কর্পোরেশন এড়াতে পারেনা। তিনি বলেন, নগর ভবনের কতিপয় অসাধু লোক ও বহিরাগত দখলদারদের বদনাম কেন সিটি কর্পোরেশন নিবে। এ প্রশ্ন রেখে শিপলু বলেন, অবৈধ স্থাপনা জরুরী ভিত্তিতে উচ্ছেদ করে মানুষের প্রত্যাশা পুরন করা হোক। প্রত্যাশা পুরন না হলে মানুষ বিক্ষুব্দ হবে।তিনি সিটি মেয়রের দৃষ্টি আকর্ষন করে বলেন,নগরবাসী যেন ফুটপাত ও সড়ক দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে হাটতে পারে সে ব্যবস্থা করুন। তিনি বলেন, নগর ভবনের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করে একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে এসব করছে।একদিনে এসব অবৈধ স্থাপনা নির্মিত হয়নি। সিটি কর্পোরেশন আজ পর্যন্ত একটি স্থাপনার কাজও বন্ধ রাখতে পারেনি। এটা দুঃখজনক।
এসব অভিযোগের সত্যতা মিলেছে বঙ্গবন্ধু উদ্যানে সরেজমিনে ঘুরে,গত ১৭ ও ১৮ জুন ঘুরে বঙ্গবন্ধু উদ্যানে অবৈধভাবে প্রকাশ্যে অসংখ্য স্থাপনা দেখা গেছে। উদ্যানের উত্তর দিকে দু সারিতে অর্ধশতাধিক অবৈধ দোকান গড়ে উঠেছে।উদ্যানে যাওযা লোকজনদের ভোগান্তির অভাব নেই। না পারছে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে হাটতে, না পারছে তাদের যানবাহন রাখতে ।এ সব অবৈধ দোকানের আবার ভাড়া নিচ্ছে স্থানীয় একটি প্রভাবশালীমহল।এখানের পরিবেশ এখন বিপর্যস্ত।অবৈধ দোকানের ফলে বরিশাল সরকারি মডেল স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থীদেরও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এসব অবৈধ দোকান গড়ে ওঠার জন্য রয়েছে একটি সিন্ডিকেট। যে সিন্ডিকেটটি সর্বস্তরের প্রশাসন ম্যানেজ করছে বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে।ফলে সরকারি এ জায়গায় স্থায়ীভাবে গড়ে উঠছে একের পর এক অবৈধ স্থাপনা।
বঙ্গবন্ধু উদ্যানের মত নগরীর ত্রিশ গোডাউন এলাকায় সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ চৌমাথা লেকের তিন দিক ঘিরে শতাধিক অবৈধ দোকান , হাজি মহসিন মার্কেট বর্তমান ডিসি মার্কেটের রোড দখল করে প্রায় বিশটি অবৈধ দোকান, নগর ভবনের সামনে ত্রিশটি অবৈধ ভ্রাম্যমান দোকান,কালেক্টরেক্ট পুকুর ঘিরে ভ্যান দোকান,বিবির পুকুরের তিন দিকে শতাধিক অবৈধ দোকান গড়ে উঠলেও সিটি কর্পোরেশন বা জেলা প্রশাসন নিরব রয়েছে উচ্ছেদের ব্যাপারে।
রুপাতলী ও নথুল্লাবাদে সড়ক ও জনপথ বিভাগের জমি দখল করে স্থায়ী ও অস্থায়ী ভাবে বিভিন্ন ধরনের শতাধিক দোকানপাট নির্মিত হলেও সড়ক ও জনপথ বিভাগ নিরব রয়েছে উচ্ছেদের ব্যাপারে। তবে একবার সড়ক বিভাগ উচ্ছেদ করলেও সড়কের একটি অসৎ কর্মকর্তাদের যোগসাজসে স্থানীয় একটি প্রভাবশালীমহল আবার স্থাপনা নির্মান করার অনুমতি দিয়ে তারা পজেশন ব্রিক্রি করছে বলে জানা গেছে।
শতাধিক পথ খাবারের দোকানের কারণে প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যায়ে বরিশাল মহানগরীর সৌন্দর্য বর্ধনকৃত ‘নবগ্রাম রোড-চৌমাথা লেক’টি ইতোমধ্যে নগরবাসীর গলার কাটা হয়ে উঠেছে। লেকটির পশ্চিম-দক্ষিণ পাড়ে মার্কাজ মসজিদ ও স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য নির্মিত প্রায় ৭৫ ফুট প্রশস্ত ঘাটলাটির প্রবেশ পথেও অবৈধ দোকান রয়েছে।লেকটির উত্তর প্রান্তে সড়ক বিভাগের জমি দখল করে জাতীয় মহাসড়কের ওপর অবৈধভাবে নির্মিত কথিত শিশু পার্কটিও ইতোমধ্যে নগরীর অন্যতম দূর্ঘটনাস্থলে পরিনত হয়েছে।
অবৈধ দোকান উচ্ছেদ নিয়ে কথা বলতে রাজী নন সিটি কর্পোরেশনের উচ্ছেদ শাখার কর্মকর্তারা। স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ এবং অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার দাবী করেছে সাধারন মানুষ ও পরিবেশবাদীরা।
এ ব্যাপারে নগরীর বাসিন্দা মজিবুর রহমান জানান,কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমোদন ছাড়া কোন স্থাপনা নির্মান অবৈধ। আর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কোন নোটিশের প্রয়োজন নেই।জনসাধারনের ভোগান্তি দুরীকরনের জন্য অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ একান্ত জরুরী।
সচেতন ব্যক্তিরা জানান, , বরিশাল নগরীকে উন্নত আধুনিক ও পরিকল্পিত শহর গড়ার লক্ষে ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর মহাপরিকল্পনা (মাস্টারপ্ল্যান) হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু এরপর এক যুগ অতিবাহিত হলেও ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। একই সঙ্গে বরিশাল উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বউক) আইন ২০২২-এর খসড়া তৈরি হলেও এই আইন চূড়ান্ত হয়নি।
বরিশাল নগরীতে প্রকাশ্যে স্থাপনা তৈরি হওয়ার পেছনে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দায়িত্ব অবহেলা ও সমন্বয়হীনতা রয়েছে। সরকারি জমি রক্ষায় অবশ্যই দেশের প্রচলিত আইন ও বিধি মানতে হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করেন এ্যাভভোকেট মোঃ হুমায়ুন কবির।
এ ব্যাপারে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আহসান উদ্দিন রোমেল জানান,অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হবে কিনা সে সিদ্ধান্ত আমি জানিনা। তবে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে সিটি কর্পোরেশন আন্তরিক।
এ ব্যাপারে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ ইসরাইল হোসেন বলেন,বরিশাল নগরীতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে।আমাদের একজন নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট রয়েছে। নগরীতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেন করা রুটিন কাজ।শিঘ্রই উচ্ছেদ কার্য্যক্রম জোড়দার করা হবে।
বরিশাল জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম জানান, সরকারি যে কোনো প্রতিষ্ঠান বা বিভাগের জমি অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে উদ্ধারে জেলা প্রশাসন সব সহযোগিতা করবে। তবে যাদের জমি উদ্ধার করে দেওয়া হয় তাদেরকেও পরবর্তী করণীয়গুলো করতে হবে যাতে পুনরায় জমি অবৈধ দখলে না যায়।
এ বিষয়ে বরিশাল সড়ক বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. মাসুদ খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘বরিশালের ১৬ শ কিলোমিটার সড়ক একা আমাদের পক্ষে তদারকি সম্ভব নয়। এর জন্য সবার সহায়তা দরকার। তবে উচ্ছেদের পর আবার দখলের নেপথ্যে সড়ক বিভাগের কেউ জড়িত আছে প্রমাণ হলে কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়