ইত্তেহাদ এক্সক্লুসিভ অনুসন্ধানী সংবাদ

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম,ভিসির স্বেচ্ছাচারিতা

pabi
print news

বরিশাল অফিসপটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (পবিপ্রবি) প্রশাসন স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে ভাষা ও যোগাযোগ বিভাগের অধ্যাপক মো. মেহেদী হাসানকে ১৩ মাস ধরে সাময়িক বরখাস্ত করে রেখেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানিয়েছেন, লাগামহীন দুর্নীতি-অনিয়মকে ধামাচাপা দিতে অধ্যাপককে শায়েস্তার মাধ্যমে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের হুঁশিয়ারি দিতে চাচ্ছে প্রশাসন। এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে উপাচার্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে পবিপ্রবি শিক্ষক সমিতি। জানা গেছে, ২০১৮ সালে দেবাশীষ মণ্ডল নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেধাবী শিক্ষার্থী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় সর্বোচ্চ অবস্থানে থেকেও নিয়োগ না পেয়ে ‘আত্মহত্যা’ করেন। গত বছর এ নিয়ে একটি অডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেখানে ১৫ লাখ টাকা ঘুষের মাধ্যমে দেবাশীষকে বাদ দিয়ে রফিক উদ্দিন নামে আরেকজনকে চাকরি দেওয়ার বিষয়টি উঠে আসে। এ ঘটনায় নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জড়িতদের বিচার দাবি করে ছবিসহ পোস্টারিং করে অজ্ঞাতরা। আর এতে ক্ষিপ্ত হন ঐ নিয়োগ প্রক্রিয়ার সময় রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালনকারী বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর স্বদেশ সামন্ত। এ ঘটনায় শিক্ষক মেহেদী হাসানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

একাধিক শিক্ষক জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে কে বা কারা পোস্টারিং করেছে তা সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না করে ভাষা ও যোগাযোগ বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মেহেদী হাসানকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে রাখা হয়েছে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে। পোস্টারিংয়ের ঘটনায় অনুমাননির্ভর হয়ে জিডি দায়েরের পর শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের ঠিক আগের দিন ২০২৩ সালের ২৮ মে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরের দিন ২৯ মে নির্বাচনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ‘জেহাদ মুন্না’ প্যানেল থেকে বিপুল ভোটে সদস্য নির্বাচিত হন মেহেদী হাসান। বরখাস্তের প্রায় ১৭ দিন পর দু’টি অভিযোগ উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে অভিযোগনামা দায়ের করা হয়। অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে আপত্তিকর পোস্টার ছাপানো/বিতরণ এবং অধ্যাপক পদে পর্যায়োন্নয়নের শর্ত পূরণ না করেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে আপত্তিকর ও উসকানিমূলক মন্তব্যের জন্য তাকে দায়ী করা হয়।

pabi

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রথম অভিযোগের বিষয়ে অধ্যাপক মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে স্থানীয় দুমকি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। দুমকি থানা সাধারণ ডায়েরি তদন্তের জন্য পটুয়াখালীর বিচারিক আদালতে আবেদন করলে আদালত প্রাথমিক সত্যতা না থাকায় তদন্ত নামঞ্জুর করেন। পরবর্তীকালে পবিপ্রবি প্রশাসন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে দায়রা জজ আদালতে রিভিশন মামলা করলেও জজ আদালত ২০২৩ সালের ২৩ অক্টোবর পূর্বের আদেশ বহাল রেখে অভিযোগকারীর প্রতিকূলে মামলাটি নিষ্পত্তি করেন। আদালত থেকে ব্যর্থ হয়ে এরপর পবিপ্রবি প্রশাসন অধ্যাপক মেহেদী হাসানকে হেনস্তা করতে চরম স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নেয়। এর মধ্যে ফরমায়েশী তদন্ত কমিটি গঠন ও তার প্রতিবেদন অন্যতম। কেননা অধ্যাপক মেহেদী তদন্ত কমিটি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে প্রথম অভিযোগের বিষয়ে দুই আদালতের রায় উপস্থাপন করলেও সেগুলোর কোনো তোয়াক্কা না করে ফরমায়েশি একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে তাকে চাকরিচ্যুতির পাঁয়তারা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ধার্য করা অধ্যাপক পদে পর্যায়োন্নয়নের সমস্ত শর্ত পূরণ করলেও কর্তৃপক্ষ তার ওপর নতুন শর্ত আরোপ করে। সেই শর্তানুযায়ী শিক্ষানবিশ সময়ে অর্থাৎ যোগদানের পর থেকে পরবর্তী ২ বছরের মধ্যে এমফিল অথবা পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হতে হবে এবং কমপক্ষে ২টি একাডেমিক আর্টিকেল প্রকাশ করতে হবে। তিনি ২০২২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক পদে যোগদান করায় ২০২৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক পদে শিক্ষানবিশ সময়ের ২ বছর পূর্ণ হওয়ার কথা। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের ৯ মাস আগেই ২০২৩ সালের ২৮ মে তাকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে অভিযুক্ত করে বলা হয় যে, আপনি শর্ত পূরণ করেননি। এভাবে সাময়িক বরখাস্ত করে একজন নির্বাচিত শিক্ষক প্রতিনিধিকে চরমভাবে হয়রানির পথ বেছে নেয় পবিপ্রবি প্রশাসন।

শুধু তা-ই নয়, এ ঘটনায় সাময়িক বরখাস্তের দুই মাস পর ২০২৩ সালের ৭ আগস্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তাদের ১৭ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হলেও দীর্ঘ ৭ মাস পরে অধ্যাপক মেহেদী হাসানের সাক্ষাৎকার নেয় কমিটি। এরপর দীর্ঘ ৯ মাস পরে তদন্ত কমিটিকে দিয়ে বিলম্বিত রিপোর্ট প্রদান করে তাকে অভিযুক্ত করা হয়। তবে শিক্ষক সমিতি এ তদন্ত রিপোর্ট মেনে নেয়নি এবং যথাযথ প্রক্রিয়ায় না হওয়ায় মেহেদী হাসানের সাময়িক বরখাস্ত আদেশ অনতিবিলম্বে প্রত্যাহারের জন্য বিবৃতি প্রদান করে। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর জেহাদ পারভেজ বলেন, ‘উপাচার্যের কোনো একপেশে সিদ্ধান্তের কারণে মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলে শিক্ষক সমিতি ঐ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে।

pabi 2

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, অধ্যাপক মেহেদীর ক্ষেত্রে বিচারিক আদালতের আদেশ অভিযোগকারীর প্রতিকূলে নিষ্পত্তি হওয়া সত্ত্বেও গত ২৯ মে তাকে কেন অনতিবিলম্বে চাকরি থেকে অপসারণ করা হবে না মর্মে জবাব দাখিলের নির্দেশ প্রদান করে কর্তৃপক্ষ। সে অনুযায়ী বিষয়টি চলতি মাসের ২৯ তারিখ রিজেন্ট বোর্ডের সভায় সিদ্ধান্তের জন্য উপস্থাপিত হতে যাচ্ছে। এই অন্যায়টি সুচারুভাবে সম্পন্ন করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত বিধির পরিবর্তন করে নতুন একটি পরিপত্র গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর জারি করা হয়েছে। যেখানে ‘বিচারিক আদালতের কার্যধারা নিষ্পত্তি হওয়ার আগে কোনো দণ্ড দেওয়া যাবে না’ ধারাটি বাদ দেওয়া হয়েছে।

এসব বিষয়ে আলাপকালে অধ্যাপক মেহেদী হাসান তার দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরে বলেন, একজন শিক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম হতে প্রায় ১৩ মাস ধরে বিচ্ছিন্ন থাকায় মানসিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। তাছাড়া এ সময়কালে পূর্ণ বেতনভাতা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছি। মানসিক ও আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস থেকে এডুকেশনের ওপর পিএইচডি করার অফারটি হাতছাড়া হয়ে গেছে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার দুর্নীতি-অনিয়মের বিষয়ে জিরো টলারেন্স দেখাচ্ছে, অথচ অপরাধীদের নয়; বরং প্রতিবাদকারীদের চাকরিচ্যুতির হুমকি দেওয়া হচ্ছে। দেবাশীষের আত্মহত্যা, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অন্যায়ে জড়িতরা পুরস্কৃত হচ্ছে, আর অন্যায়ের প্রতিবাদকারীরা চাকরি হারাচ্ছে—এটাই এখন পবিপ্রবি’র বাস্তবতা।

এ বিষয়ে জানতে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর স্বদেশ সামন্তকে ফোন করা হলে তিনি তা কেটে দেন। পরে এসএমএস পাঠিয়ে ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার সন্তোষ কুমার বসুকে ফোন করা হলে তিনি  বলেন, উপাচার্য স্যারের বক্তব্য তার কাছ থেকে নিতে হবে। রেজিস্ট্রার বলেন, অধ্যাপক মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটি অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে, সে জন্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ে পটুয়াখালী ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা জজ আদালতের রায়ের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আদালত শুধু তদন্তের কোনো অনুমতি দেয়নি।’ আর রিভিশন মামলা (নং ২০৬/২০২৩) প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এখানে তো কোনো মামলাই হয়নি, এখানে তো কোনো মামলার বিষয়ই নেই।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিমালা পরিবর্তনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই’।

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *