অনুসন্ধানী সংবাদ

বন কর্মকর্তার সম্পদের পাহাড়

কর্মকর্তা
print news

ইত্তেহাদ নিউজ,নোয়াখালী : নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার বন কর্মকর্তা এ এস এম সামছুদ্দিন আহমেদ। ঘুরেফিরে নিজ জেলায় চাকরি করছেন ৩৫ বছর ধরে। উপজেলা বন কর্মকর্তা হয়ে কিনেছেন কয়েক কোটি টাকার জমি ও প্লট, তুলছেন ভবন, করেছেন সরকারি খাল দখল। নিজের নানা অপকর্ম চাপা রাখতে সামাজিক বনায়নের কমিটিতে রেখেছেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, ব্যবসায়ীসহ সমাজের সচ্ছল ব্যক্তিদের। বনায়নের উপকারভোগীদের অর্থ বিতরণের ক্ষেত্রেও করেন নয়-ছয়। নিজের মানসিক প্রতিবন্ধী ভাইকে উপজেলা বন অফিসের নৌকাচালক হিসেবে চাকরি দিয়ে বেতন তুলছেন নিজেই। এ ছাড়া নিজ এলাকার সংখালঘু সম্প্রদায়ের জমি জোর করে রেজিস্ট্রি করে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার কালিকাপুর বাজার এলাকায় পৈতৃক ভিটা সামছুদ্দিনের। এলাকায় তাকে সবাই চেনে ‘বন সামছু’ নামেই। ১৯৯০ সাল থেকে কর্মরত আছেন নোয়াখালীর বিভিন্ন উপজেলার বন কর্মকর্তা হিসেবে। বর্তমানে তিনি বেগমগঞ্জ উপজেলার বন কর্মকর্তার পাশাপাশি ভারপ্রাপ্ত হিসেবে রয়েছেন সোনাইমুড়ী ও সেনবাগের বন কর্মকর্তার দায়িত্বে। দীর্ঘ চাকরি জীবনে কখনো সোনাইমুড়ী, কখনো সেনবাগ, কখনো বেগমগঞ্জ উপজেলার বন কর্মকর্তা হিসেবে সময় পার করেছেন। সাধারণত সরকারি কর্মকর্তাদের নিজ জেলায় চাকরির সুযোগ না থাকলেও সামছুদ্দিনের বেলায় যেন ভিন্ন নিয়ম।

অনুসন্ধানে জানা যায়, একজন উপজেলা বন কর্মকর্তার মাসিক বেতন ৩০ হাজার টাকা। অন্যান্য ভাতা মিলিয়ে তা দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ৩৭ হাজার। এই বেতনেই সামছুদ্দিন নিজ এলাকা কালিকাপুরে কিনেছেন ২২ ডিসিম জমি। বগাদিয়া-কালিকাপুর বাজার-সংলগ্ন সড়কের পাশে কিনেছেন প্রায় ৩০ ডিসিম জমি, যার বর্তমান মূল্য কয়েক কোটি টাকা। সেই জমির রাস্তা তৈরি করতে করেছেন সরকারি খাল দখল। কালিকাপুরের পৈতৃক জমিতে তুলছেন আলিশান দ্বিতল ভবন। বসবাস করছেন মাইজদী শহরের দীঘিরপাড় আবাসিক এলাকার বিলাসবহুল আপন নিবাস নামে একটি ফ্ল্যাটে। আর সেই ফ্ল্যাটের পাশেই কিনেছেন কয়েক কোটি টাকা মূল্যের প্লট। তবে ওই জমিতে ব্যবহার করেছেন নিজের শ্বশুরের নামে ব্যানার।

উপজেলার বন কর্মকর্তা এ এস এম সামছুদ্দিন আহমেদের একটি মানসিক প্রতিবন্ধী ভাই রয়েছে যার নাম মো. মহিন উদ্দিন। তিনি গত ২০ বছর থেকে কাগজে-কলমে বেগমগঞ্জ উপজেলা বন অফিসের নৌকাচালক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তবে তাকে কখনো অফিসে আসতে দেখেননি ওই উপজেলা বন অফিসের অন্য কর্মচারীরা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মানসিক প্রতিবন্ধী বড় ভাই মহিন উদ্দিন অধিকাংশ সময় সামছুদ্দিন আহমেদের বেগমগঞ্জের ভাড়া বাসাতেই থাকেন। আর প্রতি মাসে তার বেতন তোলেন সামছুদ্দিন নিজেই।

সামছুদ্দিনের বিরুদ্ধে দায়িত্ব অবহেলা, নিয়ম-বহির্ভূতভাবে সামাজিক বনায়নের গাছ বিক্রির অর্থ আত্মসাৎ, মামলার ভয় দেখিয়ে উৎকোচ আদায়ের অভিযোগও রয়েছে।

জানা যায়, গত বছরের মে মাসে সোনাইমুড়ীর বজরা ইউনিয়নের ছনগাঁও এলাকার আব্দুল মতিনের ছেলে নূর নবী শিপন ও আব্দুল গফুরের ছেলে শাহ আলম সামাজিক বনায়নের প্রায় ২০টি গাছ কেটে ফেলেন। অবৈধভাবে গাছ কাটার বিষয়টি বনপ্রহরী সাইফুল ইসলাম ও শরিফকে জানায় ওই এলাকার সামাজিক বনায়নের সভাপতি আবুল কাশেম। ঘটনাটি জানার পর সোনাইমুড়ীর ভারপ্রাপ্ত বন কর্মকর্তা এ এস এম সামছুদ্দিন আহমেদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি অবৈধভাবে গাছ কর্তনকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে টাকার বিনিময়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দেন।

এ ঘটনার বিষয়ে বনপ্রহরী লিপন বলেন, যে দিন গাছ কাটে ওই দিন সন্ধ্যায় সামাজিক বনায়নের সভাপতি কাশেমের মাধ্যমে তথ্য পেয়ে ঘটনাস্থলে যাই। ওখানে প্রায় ২০টি গাছ কাটা হয়। তবে ঘটনাস্থলে ছিল মাত্র দুই-তিনটি গাছের অংশ ও কিছু ডালপালা। পরের দিন সামছুদ্দিন স্যার আমাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে শিপনকে বকাবকি করেন, মামলার ভয় দেন। পরে বদলকোটের বাহারসহ (নোয়াখালী-২ আসনের এমপি মোরশেদ আলমের শালা) অন্য নেতাদের ধরে সবকিছু ধামাচাপা দেওয়া হয়। স্যার প্রথমে মামলার ভয় দেয় পরে ম্যানেজ হয়ে যান।

জানা যায়, গত বছরের আগস্ট মাসে সেনবাগের কাদরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন ভূঁইয়ার নির্দেশে হিজলী গ্রামের সামাজিক বনায়নের প্রায় ৫০টি গাছ কেটে ফেলেন ইউপি মেম্বার পলাশ। বিষয়টি জানতে পেরে সেনবাগ উপজেলার ভারপ্রাপ্ত বন কর্মকর্তা এ এস এম সামছুদ্দিন আহমেদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেও গাছ কর্তনকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা না নিয়ে অভিযুক্তদের জিম্মায় গাছ দিয়ে এসেছেন।

এ ঘটনা স্বীকার করেছেন সেনবাগ উপজেলার বনপ্রহরী মো. আব্দুল কুদ্দুস। তিনি বলেন, ‘উনি অফিসে আসেন মাসে একবার। কখনো দুই মাসে একবার আসেন। দুষ্কৃতকারীরা ৫০টি গাছ কেছে ফেলেছিল। সামসুদ্দিন স্যার এসে গাছ জব্দ করেন। পরে মামলা না দিয়ে যে গাছ কেটেছে তার জিম্মায় গাছ দিয়ে এসেছেন।’

এ ছাড়া সোনাইমুড়ী সতের মাইল এলাকায় গত দুই বছরে সামাজিক বনায়নের প্রায় ১৫টি গাছ উধাও হয়ে গেছে। পৌরসভার বর্জ্যের আগুনে জীবন্ত গাছগুলি পুড়িয়ে মারা হয়েছে। তবে সেসবে বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বন কর্মকর্তা সামসুদ্দিন।

উপজেলার বন কর্মকর্তা এ এস এম সামছুদ্দিন আহমেদের দায়িত্বে থাকা সোনাইমুড়ী-সেনবাগ-বেগমগঞ্জ উপজেলার সামাজিক বনায়নের উপকারভোগীদের তালিকা তৈরিতেও ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। লভ্যাংশ বণ্টনেও ঘটেছে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের অর্থনৈতিক, বাস্তুসংস্থানিক ও সামাজিক সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার সামাজিক বনায়নের কর্মসূচি হাতে নিলেও সেই সুফল পাচ্ছে না এই তিন উপজেলার অসহায় মানুষ।

এ বিষয়ে বেগমগঞ্জ উপজেলা বন কর্মকর্তা এ এস এম সামছুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে কথা হলে তিনি নিজ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় দীর্ঘদিন থেকে দায়িত্বপালনের বিষয়টি স্বীকার করেন। প্রতিবন্ধী ভাই বন বিভাগে কর্মরত এবং তিনি যে ডিউটি করেন না সে বিষয়টিও স্বীকার করেন সামছুদ্দিন। অন্যান্য অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, তার বিরুদ্ধে অনেক শত্রু রয়েছে। শত্রুরা প্রতিবেদককে ভুল তথ্য দিচ্ছে।

এ বিষয়ে নোয়াখালী উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ এস এম সামছুদ্দিন আহমেদের দীর্ঘদিন নোয়াখালী জেলায় চাকরির বিষয়টি তিনি স্বীকার করেছেন। তবে সামছুদ্দিনের ভাই মহিন উদ্দিন নৌকাচালক পদে যে চাকরি করছেন, সে তথ্য জানা নেই বিভাগীয় বন কর্মকর্তার। এ ছাড়া সামাজিক বনায়নে উপকারভোগীর কমিটি গঠনে অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিবেন বলেও জানান তিনি।

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *