বাংলাদেশ বরিশাল

বরিশালে গোয়েন্দা শাখার ওসি আলমগীরের চাকুরী গেছে, দুদকের নজরদারী

InShot 20240630 085927031
print news

আলম রায়হান ও মামুনুর রশিদ নোমানী, বরিশাল অফিস :   বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার ওসি মোঃ আলমগীর হোসেন বেপরোয়া দানবে পরিণত হয়েছিলেন। মহানগরীর ভূমিদস্যু ও মাদকচক্রের রক্ষক হিসেবে তার কর্মকান্ডের বিষয়টি ছিলো অনেকটা ওপেনসিক্রেট। পুরো চাকুরী জীবনে নানান অঘটনের খল নায়ক পুলিশ ইন্সপেক্টর মো: আলমগীর হোসেন এতো দিন নানান বাঁকা পথে হেটে টিকে গেলেও এবার আর শেষ রক্ষা হলো না। গুরুদন্ড হিসেবে তাঁকে ৩০ মে চাকুরী থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। তার চাকুরীর মেয়াদ ছিলো আরো দেড় বছর।

জানাগেছে, ১৮ এপ্রিল বরিশাল সদর উপজেলার এয়ারপোর্ট থানা এলাকার জনৈক ভুক্তভোগীর লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আলমগীর হোসেনের লাগাতার অপকর্মের বিষয়টি বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার জিহাদুল কবিরের বিশেষ নজরে আসে। এরপর থেকেই মোঃ আলমগীর হোসেনের পতনের সূচনা হয়। তার বিদায় পর্ব চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে ৩০ মে ২০২৪। এদিন অপরাহ্নে গুরুদন্ড হিসেবে তাকে চাকরী থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়। এদিকে আলমগীর হোসেন আছেন দুদকের নজরদারীতে।

পুরণো পাপী আলমগীর হোসেন:
দুর্নীতিবাজ পুলিশ ইন্সপেক্টর মো: আলমগীর হোসেন বরিশালে যোগদানের পর কেবল নয়, তিনি বেপরোয়া বহু আগ থেকেই। অনেকটা শুরু থেকেই। পুরো চাকুরী জীবনই অনিয়ম ও দুর্নীতির মধ্য দিয়ে কাটিয়েছেন। সূত্রমতে, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এ পর্যন্ত মো: আলমগীর হোসেন অন্তত পাঁচটি বিভাগীয় মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন বলে জানাগেছে। এরপরও রহস্যজনক কারণে এতোদিন তাঁর চাকুরী টিকেছিলো। যদিও নানান অনিয়মের অভিযোগে মো: আলমগীর হোসেন প্রমোশন পাননি। তার বেইসমেটরা প্রমোশন পেয়ে এডিশনাল এসপি পর্যন্ত হলেও তিনি ইন্সপেক্টর পদেই থেকে গেছেন ৩০ মে চাকুরী যাওয়া পর্যন্ত।
সূত্র বলছে, প্রমোশন বঞ্চিত হওয়ার বিষয়টিকে মো: আলমগীর হোসেন মোটেই ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করতেন না। তার বিবেচনায়, ইন্সপেক্টর থেকে প্রমোশন পেয়ে উপরের দিকে গেলে ‘কাগুজে’ সম্মান বাড়ে। কিন্তু দুইহাতে টাকা কামাই করার সুযোগ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে যায়। এদিকে কেবল বিভাগীয় একাধিক মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া নয়, দুর্নীতিবাজ পুলিশ ইন্সপেক্টর মো: আলমগীর হোসেনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে একাধিক চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশিত হয়েছে। যা রেকর্ড সৃষ্টি করে ২০১৫ সাল থেকে।
মো: আলমগীর হোসেনের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ‘সহিংসতাকে পুঁজি করে ব্যাপক আটক ও গ্রেফতার বাণিজ্যের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে হয়রানির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আলমগীর হোসেনকে আরএমপি থেকে বদলি করা হয়েছে।’ ‘বহুল আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা রাজশাহী নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানার প্রাক্তন ওসি আলমগীর হোসেন গোদাগাড়ী থানায় বদলির আদেশ পাওয়ার আগেই চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী ও দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।’ ‘অভিযোগ রয়েছে, পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার প্রশ্রয়ে আলমগীর বেপরোয়া দুর্নীতি ও অনিয়ম করে চলেছেন। আর এ কারণে শত অভিযোগের পরও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এদিকে জুনের প্রথম সপ্তাহে পবা থানায় যোগদানের পর তার অত্যাচারে থানার এসআই রূহুল আমিন, মেহেদী হাসান, এএসআই উজ্জ্বল ও আমিনুল ইসলামসহ ছয় পুলিশ দরখাস্ত দিয়ে বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন।’

সাইফুল ইসলামের সময় দানব হয়ে ওঠে আলমগীর:
চরম দুর্নীতিবাজ মো: আলমগীর হোসেনকে ডাম্পিং হিসেবে বরিশালে পোস্টিং দেয়া হয়েছিলো। তখন বিএমপির কমিশনার ছিলেন মো: সাহাবুদ্দিন খান। তিনি বিএমপির দায়িত্বে ছিলেন ২০১৯ সালের ১২ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ১৭ মে পর্যন্ত। অতীত বিবেচনায় আলমগীরকে কোন গুরুত্বপূর্ন দায়িত্ব দেয়া হয়নি। বরং অনেকটা ক্লারিক্যাল কাজ করানো হতো। কিন্তু মোঃ সাইফুল ইসলাম ২০২২ সালের ১৪ জুলাই বিএমপির কমিশনার হিসেবে যোগদান করার পর মো: আলমগীর লাইমলাইটে চলে আসেন, ‘মিউ থেকে হয়ে ওঠেন হালুম!’
বিএমপির সাবেক কমিশনার সাইফুল ইসলামের সময় দানব হয়ে ওঠা মো: আলমগীর হোসেন শুরুতেই টের পেয়েছিলেন, সতর্ক কমিশনার জিহাদুল কবিরের সময় সাবেক কমিশনারের মেয়াদের মতো আর সুবিধা হবে না। কিন্তু এরপরও তিনি পুরো প্রবনতা থেকে খুবএকটা উঠে আসতে পারেননি। আর এই ধারায় মাদক চক্রের কাছ থেকে দুই লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে ২৫ মার্চ আদালতে মনগড়া এক প্রতিবেদন দিয়ে বসলেন। আর এটিই হলো তার জন্য মরন ফাঁদ।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, বিএমপির সাবেক কমিশনার সাইফুল ইসলামকে বরিশাল থেকে মেট্রোরেল পুলিশের ডিআইজি হিসেবে পোস্টিং দেয়া হয়। মেট্টোরেলের মেয়াদে তাঁর কাছে ‘মাছিও’ যেতো না বলে শোনা যায়। এখন হয়তো রাঘব বোয়ালরাও যাবে। কারণ, ২৩ জুন তাঁকে চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন পুলিশ কমিশনার হিসেবে পোস্টিং দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন সূত্র বলছে, বিএমপি’র কমিশনার হিসেবে সাইফুল ইসলাম বরিশাল থেকে তেমন সুনাম নিয়ে যেতে পারেননি। যদিও বিএমপি’র কোনকোন কমিশনার বরিশালে উচ্চ মাত্রার সুনাম অর্জন ও বিশেষ দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তাঁদের মধ্যে এস এম রুহুল আমিন পুলিশ প্রধান হবার দোড়গোড়ায় আছেন বলে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে।

আলমগীরের বিবাহ দোষ:
নানান রকম দোষের কথা প্রচলিত আছে। এর মধ্যে অধিক প্রচলিত হচ্ছে, স্বপ্নদোষ ও মুদ্রাদোষ। এই দোষের কোনটি মো: আলমগীর হোসেনের ছিলো কিনা তা নিশ্চিত নয়। তবে নিশ্চিত হওয়া গেছে, তার বিবাহ দোষ ছিলো। তা ছিলো সর্বোচ্চ মাত্রায়। বহু বিয়ের খবর জানাগেছে। আর সরকারী হিসেব মতে তার বিবাহ দোষের খবর মিলেছে ১৯৯২ সালেই। তখন তিনি শিক্ষানবীশ এসআই ছিলেন।
পুলিশের রেকর্ড অনুসারে ১৯৯৩ সালের ২ আগস্ট এসআই হিসেবে মোঃ আলমগীর হোসেনের চাকুরী স্থায়ীকরণ হয়। কিন্তু শিক্ষানবীশ এসআই হিসেবে চাকরিকালীন ১৯৯২ সালের ১৮ ডিসেম্বর তিনি মোঃ নাসিমা খাতুনকে বিয়ে করেন। কাবিননামা ধার্য করা হয় ৫০ হাজার টাকা। এর প্রায় দুই বছরের মাথায় ১৯৯৪ সালের ১ জুলাই তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তার দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম জেসমিন আরা ঝুনু। এদিকে অপর একটি সূত্র বলছে, পুলিশের রেকর্ডের বাইরেও মোঃ আলমগীর হোসেনের একাধিক স্ত্রী রয়েছে। সূত্র আরো জানায়, একাধিক বিয়ে ছাড়াও পরকীয়া দোষ রয়েছে মোঃ আলমগীর হোসেনের। আর ‘অনপেমেন্ট বান্ধবী’ রয়েছে তার অসংখ্য।

আলমগীরের গলা কাটলো পঁচা শামুকে:
পঁচা শামুকে পা কাটা- বলে একটি প্রবচন আছে। মানে তুচ্ছ ঘটনায় বড় ক্ষতি হওয়া। তবে আলগীর হোসেনের বেলায় এই প্রবচন টপকে গেছে। পা নয়, পঁচা শামুকে আলমগীর হোসেনের গলা কেটেছে! মানে, চাকরি গেছে। তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ থাকলেও এমন এক অপরাধে তার চাকুরী গেলো যা সাধারণের দৃষ্টিতে অতি সাধারণ দোষ হিসেবে বিবেচিত হয়। কেউ কেউ আবার কোনো দোষই মনে করেন না। অথচ আইনের দৃষ্টিতে তা এক গুরুতর অপরাধ। যে অপরাধে অতি বিলম্বে হলেও আলমগীর হোসেনের চাকুরি গেছে।

আলমগীরের পতনের সূচনা যেভাবে:
বরিশালে ভূমিদস্যু ও মাদকচক্রের রক্ষক হিসেবে খ্যাত ডিবি ওসি মো: আলমগীর হোসেন ছিলেন বেপরোয়া। এ ধারায় চলতে চলতে বরিশাল সদর উপজেলার ১নং রায়পাশা-কড়াপুর ইউনিয়নের বিলামেরপুল এলাকার মাদক ও ভূমিদস্যু চক্রের এক ছিছকে গডফাদারের কারসাজিতে সাজানো দুটি ফৌজদারী মামলা আদালতে দাখিল করা হয়। এক বাদিনীর করা দুটি সাজানো মামলার একটি মামলা তদন্তের জন্য প্রেরণ করেন পিবিআইতে এবং একটি প্রেরণ করেন ডিবিতে। পিবিআই যথাযথ প্রতিবেদন দাখিল করে। কিন্তু তৎকালীন বিএমপির ডিবি ওসি আলমগীর ২৫ মার্চ বরিশাল আদালতে সম্পূর্ণ বানোয়াট অভিযোগপত্র দাখিল করেন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, মাদকচক্রের দুই লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে বানোয়াট তদন্ত রিপোর্ট আলমগীর নিজেই অগ্রগামী করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, তখন তাঁর নিয়ন্ত্রকারী ডিসি অথবা ইম্মিডিয়েট বস কে ছিলেন?
আলমগীর হোসেন কর্তৃক উল্লেখিত মনগড়া প্রতিবেদন দেবার পরিপ্রেক্ষিতে ভুক্তভোগী ব্যক্তি বিএমপি পুলিশ কমিশনার বরাবরে ১৮ এপ্রিল লিখিত অভিযোগ করেন। এ ব্যাপারে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় বিএমপির এডিসি(উত্তর) মোঃ ফারুক হোসেনকে। এই তদন্ত প্রক্রিয়ায় ভুক্তভোগী মামলার বিবাদী এবং অভিযুক্ত ডিবি ওসি মোঃ আলমগীর হোসেনকে শুনানী ও স্বাক্ষ্য দেবার জন্য ডাকা হয়। শুনানীতে অংশ নিতে গিয়েও মো: আলমগীর হম্ভিতম্ভি করে বারবার বলেছেন, ‘অভিযোগকারীর বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন, কাজেই আমার বিষয়ে কোন তদন্ত হতে পারে না। আমি কনটেম্ট অফ কোর্ট মামলা করবো!’ কিন্তু তার অস্ফালন এবং ‘অন্য ধরনের’ ছুটাছুটি কোন কাজে আসেনি। অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি বরিশাল থেকে সটকে পড়েন। তাকে পোস্টিং দেয়া হয় এপিবিএন-এ। কিন্তু তার আর শেষ রক্ষা হলো না, তাকে ৩০ মে পত্রপাঠ চাকুরি থেকে বিদায় করা হয়েছে ।

দুদকের নজরদারীতে আলমগীর হোসেন:
বিএমপির গোয়েন্দা শাখার সাবেক ওসি সদ্য চাকুরিচ্যূত আলমগীর হোসেন দুদকের নজরদারিতে আছেন। একটি সূত্র এই তথ্য জানিয়েছে। এদিকে নানান সূত্রে জানাগেছে, দুর্নীতির শিরোমনি মো: আলমগীর হোসেনের বিপুল পরিমান সম্পত্তি ও নগদ অর্থ রয়েছে। এই অর্থ-সম্পদ নিজের নামের বাইরেও নানান ব্যক্তির নামে রেখেছেন বলে জানাগেছে। তবে এর সিংহভাগ রয়েছে তার একাধিক স্ত্রীর নামে। সূত্রমতে, তার একাধিক বিয়ে করার নেপথ্যে যত না জৈবিক চাহিদা, তার চেয়ে বেশি কারণ হচ্ছে অবৈধভাবে অর্জিত সম্পত্তি রক্ষার কৌশল।
প্রসঙ্গগত, পুলিশ ইন্সপেক্টর মো: আলমগীর হোসেনের বিপুল সম্পত্তি ও অঢেল টাকা থাকার কথা তিনি প্রায়ই নিজের মুখেই বলে থাকেন। এমন কি বরিশালে তার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রক্রিয়া চলাকালে তিনি এও বলেছেন, রিটার্মেন্টের ৬০/৬৫ লাখ টাকা না পেলে কোন অসুবিধা নেই। আমার একটি ‘খুটি ’ বেচলে দুই কোটি টাকা হবে। শুধু তাই নয়, থানার ওসি থাকাকালে মাসে কোটি টাকা ‘আয়’ করার গল্পও করেছেন মো: আলমগীর হোসেন তার ঊর্ধতন কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের কাছেও।

 

* সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *