প্রশ্নপত্র ফাঁস: খলিল-শাহাদাত-প্রিয়নাথের অঢেল সম্পদ


ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক : বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) অফিস সহায়ক ডেসপাস রাইডার খলিলুর রহমান। বিভিন্ন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির সময় পিএসসি থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বিপুল সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। তার চলাফেরা বা গ্রামের বাড়ি দেখে কারও বোঝার উপায় ছিল না তার রাজধানীর মিরপুরের ষাটফিট এলাকায় আলিশান বাড়ি, ব্যাংক হিসাবেও কয়েক কোটি টাকা রয়েছে।
খলিলুরের হাত ধরেই ৩৩তম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন ১০ জনের কাছে। এর মধ্যে ৬ জন লিখিত পরীক্ষায় পাস করেন এবং ৩ জন মৌখিক পরীক্ষায় পাস করেছেন। খলিলুরের ফাঁস করা প্রশ্নে বর্তমানে ৩ জন বিসিএস ক্যাডার কর্মরত আছেন। খলিলুর অফিস সহায়ক হলেও তার সম্পর্ক থাকত পিএসসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলে সবুজ বাতির সিগন্যালের অপেক্ষা করতেন তিনি। সিগন্যাল পেলেই চূড়ান্ত লেনদেন করতেন। বৃহস্পতিবার সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্ট এক সূত্র খলিলুরের এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।
গত এক যুগে বিসিএসসহ ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সিআইডি। এর মধ্যে অন্যতম খলিলুর রহমান। তিনি বিপুল পরিমাণ টাকার বিনিময়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন। তবে তার চলাফেরা ছিল খুবই সাধারণ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খলিলের বাড়ি যশোরের কেশবপুরের মঙ্গলকোট ইউনিয়নের পাচরাই ঘাগা গ্রামে। তার বাবা নিজাম গাজীও পিএসসির খুলনা শাখায় অফিস সহকারী হিসেবে চাকরি করতেন। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে খলিলুর বড়। বাবার কোটায় খলিলুর রহমান ও তার ভাই হাফিজুর রহমান চাকরি পান পিএসসিতে। তবে গ্রামের বাড়িতে তেমন যাওয়া-আসা নেই তাদের। তাদের পৈতৃক যে বাড়ি রয়েছে, তাও কুঁড়েঘর। সেখানে থাকেন তার চাচা-চাচি ও চাচাতো ভাইয়েরা।
খলিলের ফাঁস করা প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন অনেকেই। তাদের অনেকে এখন বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরিও করছেন। প্রশ্নপত্র ফাঁস-কা-ের পর তারাও রয়েছেন আতঙ্কে। জবানবন্দিতে খলিলুর রহমান বলেন, ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষায় ১০ জন প্রার্থীর কাছে প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছেন তিনি। এর মধ্যে তিনজন বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরি করছেন। এ ছাড়া সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও রেলের অন্তত কয়েকশ নিয়োগে খলিলুরের হাত ছিল বলেও তিনি আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
২০১২ সালে ৩৩তম বিসিএসের সময় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে খলিলুরের বিরুদ্ধে ঢাকার শাহবাগ থানায় মামলা হয়। ওই সময় তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তারও করে র্যাব। পরে তিনি জামিনে বেরিয়ে আসেন। একই সময় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও হয়। নাম প্রকাশ না করা সূত্রে পিএসসির একজন কর্মকর্তা বলেন, অনেক দৌড়ঝাঁপ করে খলিলুর মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে সফল হন। পরে ২০২২ সালের মার্চে মামলা ও বিভাগীয় মামলায় যথেষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়। টানা ১০ বছর সাময়িক বরখাস্তের সময়ে তিনি বকেয়া বেতনভাতাও ফেরত পান।
সিআইডির তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলেন, খলিলের দেওয়া জবানবন্দির তথ্য তদন্ত করা হচ্ছে। খলিলুরের ফাঁস করা প্রশ্নে সত্যিই তিনজন কর্মকর্তার যদি বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরি করার সত্যতা মেলে তবে তাদের বিষয়েও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাবে সিআইডি। এ ছাড়া রাজধানীর মিরপুরে খলিলের বাসায় গিয়ে তার বিলাসী জীবনযাপন দেখে চমকে যান সিআইডি কর্মকর্তারা।
এদিকে গ্রামে বসবাস করা খলিলুর রহমানের স্বজনরা জানান, খুলনায় খলিলুর রহমানের মায়ের পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমি রয়েছে। সেখানেও টিনের ছাউনির একতলা পাকা বাড়ি। খুলনার রায়ের মহল মোল্যাপাড়া রোডের ওই বাড়িতেই ছোট থেকে বড় হয়েছেন খলিলুর। বিয়ে করেছেন, তবে সন্তান নেই। পড়াশোনা করেছেন দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। তারা বাবা-চাচাদের সর্বমোট জমি রয়েছে ২ বিঘা ৮৪ শতক। এই জমির ভাগও হয়নি।
ঢাকায় রয়েছে ফ্ল্যাট, সিংড়ায় প্রায় কোটি টাকার জমি কিনেছেন নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত : বিসিএসের প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্য শাহাদাত হোসেন নাটোরের সিংড়া উপজেলার তাজপুর ইউনিয়নের কাদিরগাছা গ্রামের বাসিন্দা। তবে শাহাদাত হোসেন এলাকায় ‘শখেন’ নামেই বেশি পরিচিত।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত হোসেন তার গ্রামের ভিটায় দেড় বিঘার ফলের বাগান ও বিলে ৫ বিঘা জমি কিনেছেন। সিংড়া পৌরসভার উপশহরে প্রায় ৫০ লাখ টাকায় কিনেছেন ৮ শতক জায়গা। পৌরসভার সরকারপাড়া মহল্লায় কিনেছেন ৫ শতক জায়গা। এ ছাড়া ঢাকায় ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। তবে গ্রামের বাড়িতে তিনি থাকেন না।
তার জমি ও ফলের বাগান দেখাশোনা করেন খালাতো ভাই হানিফ আলী। তিনি জানান, তার ভাইয়ের দেড় বিঘার ফলের বাগান চাষাবাদ ও বিলের ৫ বিঘা জমিতে ধানের আবাদ করেন। বাগানের জন্য তার ভাইকে কিছু দিতে হয় না। তবে ধানের বর্গার অংশ তার ভাইকে দেন।
হানিফ আরও বলেন, তার ভাই ও তার পরিবার এখানে থাকেন না। মাঝেমধ্যে বেড়াতে আসেন। ঢাকার মিরপুরে নিজস্ব বাড়িতে থাকেন তিনি।
এলাকাবাসী জানান, ২০০২ সালের দিকে এই এলাকার সাবেক সচিব মখলেছুর রহমান শাহাদাতকে চাকরি দিয়েছিলেন। তবে তিনি প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত তা প্রতিবেশীরা জানতেন না। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পরে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার হলে বিষয়টি তারা জানেন।
তার গ্রামের জামাল হোসেন, রেজাউল ও আনিছুর রহমান বলেন, ঈদে বা জলসায় এলাকা আসেন তিনি। সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন। তিনি পাসপোর্ট অফিসে চাকরি করেন এটুকু আমরা জানতাম। প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত এটা জানতাম না। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পরে বিষয়টি আমরা জেনেছি।
সিংড়ার তাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিনহাজ উদ্দিন বলেন, ঢাকায় বাড়ি ও এলাকায় জায়গা-জমি কিনেছেন তিনি। একজন নিরাপত্তা প্রহরীর ১২ হাজার টাকা বেতন দিয়ে এত কিছু করা সম্ভব না।
তিন ভাইকে দিয়েছেন সরকারি চাকরি : প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের আটক ১৭ জনের অন্যতম প্রিয়নাথের বাড়ি ঠাকুরগাঁওয়ে। শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে পল্লী এলাকায় গ্রামের বাড়ি হওয়ায় তার যাতায়াত ছিল গোপনে। এলাকাবাসীর চোখে তেমন একটা না পড়লেও কয়েক বছর আগে সদর উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে নতুন করে জমিও কিনেছেন কয়েক বিঘা। বাড়িঘর কাঁচা হলেও সদ্য তুলেছেন সেমিপাকা বাড়ি। চার রুম বিশিষ্ট সেমিপাকা ঘর তালাবদ্ধ থাকলেও একটি কক্ষে থাকেন তার মা রাজবালা। একটি ঘরে ধানবোঝাই বস্তা, অন্য ঘরে ফ্রিজ ও সোফা সেট থাকলেও তা খাটের ওপর কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এলাকায় তেমন একটা সম্পদ না করলেও শ্বশুরবাড়ি দিনাজপুর ও ঢাকায় রয়েছে অঢেল সম্পদ।
চার ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রিয়নাথ রায়। এসএসসি পরীক্ষার পর বাবা রাইতু বর্মন মারা গেলে অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠেন প্রিয়নাথ। এরপর বন বিভাগে চাকরি নিয়ে সংসারে হাল ধরেন তিনি। ডিগ্রি পাস করে সেনাবাহিনীর অডিটর পদে যোগ দেন প্রিয়নাথ রায়। এরপর জড়িয়ে যান প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সঙ্গে। এরই সুবাদে তার ছোট তিন ভাইকে নিয়ে দিয়েছেন সরকারি চাকরি।
এ ছাড়া ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরে চাকরি দেওয়ার নাম করে অনেকের কাছে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। মামলাও রয়েছে একাধিক।
প্রিয়নাথের মা রাজবালা জানান, বড় ছেলে সরকারি চাকরি পাওয়ার পর স্ত্রী, সন্তান নিয়ে ঢাকায় থাকেন। তবে কিছুদিন থেকে প্রিয়নাথের স্ত্রী বাবার বাড়ি দিনাজপুরে অবস্থান করছেন। প্রিয়নাথ গেল পাঁচ বছর থেকে তার মায়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেন না বলে দাবি করেছেন। তবে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার সঙ্গে তার ছেলে জড়িত নন বলে দাবি করে বলেন, এটি চক্রান্ত। স্থানীয় সংবাদকর্মীরা প্রিয়নাথের খোঁজ নিতে গেলে ছেলেকে বাঁচাতে তার মাকে আকুতি-মিনতি করতেও দেখা গেছে।
ওই গ্রামের বাসিন্দা বিপ্লব কুমার জানান, এলাকার কাঞ্চন ও পাশের গ্রামের প্রকাশের কাছ থেকে একশ শতাংশ জমি কিনেছেন প্রিয়নাথ। এ ছাড়া দুই-তিন বছর আগে তার কাঁচা বাড়ি থেকে পাকা বাড়িও করেছেন। যদিও ঠাকুরগাঁওয়ের বাড়িটি প্রকাশের নানার বাড়ি এলাকা। এখানেই তারা ছোট থেকে বড় হয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, প্রিয়নাথ এলাকায় আসেন, গোপনে। তাকে চোখে পড়ে না। তবে ওপরে হাত থাকায় তার তিন ভাইকে সরকারি চাকরি নিয়ে দিয়েছেন।
সদর থানার ওসি এবিএম ফিরোজ ওয়াহিদ জানান, চাকরি দেওয়ার নামে প্রিয়নাথের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে, রয়েছে ওয়ারেন্টও।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়