ইত্তেহাদ এক্সক্লুসিভ

নরসিংদী কারাগার থেকে পালানো ২৬১ জন কয়েদির আত্মসমর্পণ

print news

ইত্তেহাদ নিউজ,ঢাকা : নরসিংদী জেলা কারাগারে দুর্বৃত্তরা হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে অস্ত্রলুটের সময় ৮২৬ কয়েদি পালিয়ে গেছেন। এর মধ্যে বুধবার (২৪ জুলাই) বিকাল পর্যন্ত ২৬১ জন আত্মসমর্পণ করেছেন। তারা নরসিংদী জেলা দায়রা জজ আদালতের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করছেন বলে জানা গেছে।

জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি কাজী নাজমুল ইসলাম এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এর মধ্যে মঙ্গলবার ১৩৮ ও বুধবার ১২৩ জন আত্মসমর্পণ করেন। পালিয়ে যাওয়া কয়েদিদের আত্মসমর্পণ করার জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শহরের বিভিন্ন স্থান মাইকিং করা হচ্ছে। এদিকে  বুধবার (২৪ জুলাই) দুপুর দেড়টায় নরসিংদী জেলা কারাগার পরিদর্শন করেন সেনাবাহিনী প্রধান ওয়াকার উজ-জামান।

জানা গেছে, নরসিংদী জেলা কারাগারটি শহরের ভেলানগরের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশেই অবস্থিত। এই ভেলানগর ও জেলখানা মোড়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা কয়েকদিনই লাগাতার বিক্ষোভ-সমাবেশ করছিলেন। শুক্রবারও সেখানে একই রকমভাবে কয়েক হাজার মানুষ বিক্ষোভ করছিলেন। তবে সেদিন সেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের খুব একটা দেখা যায়নি। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে হঠাৎ করেই হাজারো জনতা কারাগারের দিকে এগোতে থাকে। তারা গিয়ে সেখানে প্রথমে ইট-পাটকেল, পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে। হামলাকারীদের প্রায় সবার হাতে লাঠিসোঁটা, দেশীয় অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। এ সময় প্রাথমিকভাবে কারারক্ষীরা তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে তাদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

কিন্তু এক পর্যায়ে কারারক্ষীরা পিছু হটে। তখন হামলাকারীরা কারাগারের দুই দিকের ফটক অনেকটা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় হামলায় চার কারারক্ষী গুরুতর আহত হয়। পরে কারারক্ষীরা নিরুপায় হয়ে জেলখানার ভেতরে ঢুকে নিজেদের রক্ষা করেন। জেল কোড অনুযায়ী, গুলি করার নিয়ম থাকলেও তা করা হয়নি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলাকারীরা মূল কারাগারের ভেতরে ঢুকে সেলগুলো শাবল ও লোহার জিনিসপত্র দিয়ে ভেঙে কয়েদিদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। কিছু কারারক্ষীর কাছ থেকে চাবি নিয়েও সেলের তালা খোলা হয়।

হামলা ও অগ্নিসংসোগে কারাগার যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। অফিস কক্ষ, কনডেমড সেল, রান্নাঘর, খোলা চত্বর সব জায়গায় তাণ্ডবের চিহ্ন। দরজা-জানালাগুলো ভেঙে গেছে, দেয়ালে দেয়ালে ছিল পোড়া চিহ্ন।

উল্লেখ্য, হামলাকারীরা কারাগার থেকে ৮৫টি অস্ত্র ও ৮ হাজারের বেশি গুলি ছিনিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে ৭ হাজার রাইফেলের এবং শটগানের গুলি রয়েছে ১ হাজার ৫০টি।
তবে মঙ্গলবার জেলা পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এখন পর্যন্ত মোট ৯৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ছয় জন কয়েদি। তাদেরকে কারাগারের আশপাশ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে ৩৩টি, এক হাজার গুলি এবং অসংখ্য হাতকড়া উদ্ধার করা হয়েছে।

কারাগারে হামলার ঘটনায় গত রোববার দুপুরে জেলার কামরুল ইসলাম বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে নরসিংদী মডেল থানায় মামলা করেন। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, হামলায় অংশ নিয়েছেন ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার ব্যক্তি। তবে ভেতরে ঢুকে তাণ্ডব চালিয়েছেন অন্তত এক হাজার লোক।

 

যেভাবে পালিয়ে যায় ৮২৬ বন্দী:

ইয়াকুব মিয়া (৪৫), আপন মিয়া (৩০), বোরহান উদ্দিন (৩৫) ও মো. জাকির হোসেন- কেউ সাজাপ্রাপ্ত আসামি, কেউবা বিচারাধীন মামলায় কারাগারে ছিলেন। সবাই নরসিংদী জেলা কারাগারের বন্দী। গত শুক্রবার বিকেলে কারাগারে হামলার পর পালিয়ে যাওয়া ৮২৬ বন্দীর মধ্যে তাঁরাও ছিলেন। মঙ্গলবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে তাঁরা কারাগারের সামনে আত্মসমর্পণ করতে আসেন। কিন্তু তাঁদের আদালতে বা থানায় যাওয়ার পরামর্শ দেয় কারা কর্তৃপক্ষ। চার বন্দীর মধ্যে মাদক মামলার আসামি আপন মিয়া ২ মাস, বোরহান উদ্দিন ১৫ দিন ও মো. জাকির হোসেন ৬ মাস ধরে কারাগারে ছিলেন। তাঁরা জামিনের অপেক্ষায় আছেন। স্বজনদের পরামর্শে তাঁরা ফিরে এসেছেন।

হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ইয়াকুব মিয়া জানান, হত্যা মামলায় ২০১৫ সালে তার ফাঁসির রায় হয়েছিল। পরে উচ্চ আদালত তাঁর সাজা কমিয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন। ৮ বছরের সাজা খাটা শেষ হয়েছে। ঘটনার দিন পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। এখন আত্মসমর্পণ করতে চান।

তাদের মতো নরসিংদী কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া ৮২৬ বন্দীর মধ্যে ১৩১ জন আত্মসমর্পণ করেছেন। এর মধ্যে ৫ জন থানায় ও ১২৬ জন আদালতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। এ ছাড়া পুলিশের অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছেন চারজন। মঙ্গলবার বিকেলে নরসিংদীর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান এসব তথ্য জানান।

পুলিশ সুপার বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় পুলিশের অভিযানে কারাগার থেকে লুট হওয়া ১৮টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছেন ৩১ জন। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত ৩৩টি অস্ত্র উদ্ধার ও ৯৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি অস্ত্র উদ্ধার ও জড়িত আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে একাধিক কারারক্ষী ও এলাকাবাসী জানান, শুক্রবার বিকেল সোয়া চারটার দিকে হামলাকারীরা মুহুর্মুহু ইটপাটকেল ছুড়তে ছুড়তে কারাগারের দুই দিকের ফটক ভেঙে ভেতরে ঢোকেন। এ সময় পেট্রলবোমা মারা হয়। কারাগারের ভেতরে নানা জায়গায় আগুন ধরে যায়। হামলাকারীরা কারারক্ষীদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া চাবি দিয়ে বন্দীদের অনেকগুলো কক্ষের তালা খুলে দেন। কিছু কক্ষের তালা ভেঙে ফেলা হয়। চারপাশ ধোঁয়ায় ছেয়ে যায়। এ সময় হামলাকারীরা আসামি ছিনিয়ে নেন। এরপর একে একে ৮২৬ বন্দী পালিয়ে যান। এ সময় অস্ত্রাগার ও কারারক্ষীদের থেকে ৮৫টি অস্ত্র ও ৮ হাজার ১৫০টি গুলি লুট করা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, কারাগারে যাঁরা হামলা করেন, তাঁদের হাতে লাঠিসোঁটা, দেশি অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। তাঁদের হামলা প্রতিহত করার চেষ্টা করেন কারারক্ষীরা। তবে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কারারক্ষীরা নিরাপদ অবস্থানে চলে যান।

কারাগার যেন ধ্বংসস্তূপ:

কারাগারে বন্দীদের থাকার জায়গা, রান্নাঘর, কনডেমড সেল ও অফিস এখন আর আলাদা করে চেনার উপায় নেই। সবখানে পোড়া চিহ্ন, লন্ডভন্ড অবস্থা। দেখে মনে হয়, যুদ্ধক্ষেত্রের কোনো ধ্বংসস্তূপ। গত শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কারাগারে ঢুকে এমন চিত্র চোখে পড়ে।

কারাগারে গিয়ে দেখা যায়, কারাগারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সাদাপোশাকে আছেন। কারাগারের অফিস, রান্নাঘর, বন্দীদের থাকার জায়গা, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের থাকার কনডেমড সেলসহ পুরো এলাকায় আগুনে পোড়ার দাগ। আশপাশের উৎসাহী লোকজন কারাগারের ভেতরে ঢুকে ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। কেউ কেউ কারাগারের বাগানের ফুল-ফল ছিঁড়ে বাড়ি নিয়ে গেছেন।

বন্দীদের কারাগার থেকে চলে যাওয়ার সময়কার কথা উল্লেখ করে এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, বের হয়ে যাওয়ার সময় বন্দীদের অনেকে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। এক বন্দী তাঁকে বলেছেন, তাঁর ২৪ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। তিনি ১০ বছর সাজা খেটেছেন। তিনি এখন সুযোগ পেয়ে বের হয়ে যাচ্ছেন।

মঙ্গলবার বেলা দুইটার দিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া কারাগার পরিদর্শনে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এ সময় তাঁর সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মশিউর রহমান, জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম, আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এফ এম আনিসুল হক, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি নুরুল ইসলাম, জেলা প্রশাসক বদিউল আলম, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

কারাগার ঘুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘৯ জন জঙ্গিসহ ৮২৬ জন বন্দীকে কারাগার থেকে মুক্ত করে নিয়ে যায়। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। অস্ত্রাগার থেকে ৮৫টি অস্ত্র ও হাজার হাজার গুলি লুট করা হয়। যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা দেশের শত্রু। তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। তারা দেশকে বিপর্যস্ত অবস্থায় নিয়ে যেতে চায়। দেশ এগিয়ে যাক, তা চায় না। তাদের গ্রেপ্তারে পুলিশের চিরুনি অভিযান চলছে।’

দুটি তদন্ত কমিটি:

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘কেন এ ঘটনা ঘটল, কারও গাফিলতি আছে কি না, কেউ এখানে সহযোগিতা করেছে কি না—এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানতে ইতিমধ্যে দুটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তিন সদস্যের কমিটি করেছেন আইজি প্রিজন। আর ছয় সদস্যের কমিটি করেছে সুরক্ষা সেবা বিভাগ। যদি কারও গাফিলতি থাকে, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।’

মন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা বাধ্য হয়ে কারফিউ জারি করেছি। আপনাদের হয়তো একটু কষ্ট হচ্ছে। আপনারা দু-এক দিন ধৈর্য ধারণ করুন। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা শত্রুদের শনাক্তের পর গ্রেপ্তার করে শান্তির পরিবেশ তৈরি হলেই আবার সবকিছু স্বাভাবিক করে দেব।’

কারাগারে হামলা ও কারাবন্দীদের পালানোর ঘটনায় নরসিংদী কারাগারের জেলসুপার আবুল কালাম আজাদ ও জেলার কামরুল ইসলামকে মঙ্গলবার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। নরসিংদীর জেলা প্রশাসক বদিউল আলম বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *