চট্টগ্রামে স্বামীর নিথর মরদেহ ছুঁয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন সীমা


ইত্তেহাদ নিউজ,চট্টগ্রাম : সরকারি চাকরিতে কোটাসংস্কার আন্দোলন ঘিরে চট্টগ্রামে মোট ছয়জন নিহত এবং দুই শতাধিক আহত হয়েছেন। নিহত ছয়জনের চারজন শিক্ষার্থী, একজন মুদি দোকানের কিশোর কর্মচারী। আরেকজন ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী। মুদি দোকানের কর্মচারীর নাম সাইমন (১৪)। ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী নাম ওমর ফারুক (৩২)।
গত ১৬ জুলাই বিকেলে নগরের মুরাদপুর এলাকায় অজ্ঞাত বন্দুকধারীর গুলিতে মারা যান ফারুক। তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চান্দিনা থানা এলাকায়। দুই দিন পর ১৮ জুলাই নগরের বহদ্দারহাট এলাকায় সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় ১৪ বছরের কিশোর সাইমন। তার গ্রামের বাড়ি সন্দ্বীপ উপজেলার হারামিয়া ইউনিয়নের শিকদার বাড়ি।
নিহত চার শিক্ষার্থীর মধ্যে সবশেষ গত মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র হৃদয় চন্দ্র তরুয়া (২২)। নিহত তরুয়া পটুয়াখালী সদর রোডের নতুন বাজার এলাকার রতন চন্দ্র তরুয়ার ছেলে। গত ১৮ জুলাই নগরের বহদ্দারহাটে সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হন। একই দিন বিকেলে বহদ্দারহাট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মোহাম্মদ ইমাদ (১৮) নামে এক শিক্ষার্থী। তিনি পটিয়া সরকারি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল। সেদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এর আগে গত ১৬ জুলাই নগরের মুরাদপুর এলাকায় ছুরিকাঘাতে মারা যান চট্টগ্রাম কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র এবং চট্টগ্রাম কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক কক্সবাজার পেকুয়া উপজেলার মেহেরনামা গ্রামের শফিউল আলমের ছেলে ওয়াসিম আকরাম (২৩), একই দিন ২ নম্বর গেট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান নগরের ওমরগণি এমইএস কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র ফয়সাল আহমেদ শান্ত (২৪)। শান্তর বাড়ি বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নের মহীষাদী গ্রামে। তার বাবার নাম জাকির হোসেন।
নগরের মুরাদপুরে অজ্ঞাত বন্দুকধারীর গুলিতে মারা যাওয়া ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী মো. ওমর ফারুক কুমিল্লা জেলার চান্দিনা থানার হাশিমপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. দুলালের ছেলে। ঘটনার দিন তিনি মুরাদপুর উড়ালসড়কের কাছে একটি হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে বাসায় ফিরছিলেন। তিনি পরিবার নিয়ে থাকতেন নগরের লালখানবাজার টাংকির পাহাড় এলাকায়। তার এক স্ত্রী ও দুই সন্তান আছে।
জানা গেছে, গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত সাইমন বহদ্দারহাট থেকে ১৮ জুলাই দুপুরে নিখোঁজ হয়। টানা তিন দিন ওই এলাকায় সাইমনকে খোঁজাখুঁজি করেন তার খালা নাইমা বেগম। ২০ জুলাই সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে সাইমনের লাশ শনাক্ত করেন নাইমা। নাইমা সংবাদ মাধ্যমকে জানান, দেড় বছর ধরে সে বহদ্দারহাটের একটি মুদি দোকানে কাজ করছিল। সাইমনসহ নগরের বন্দর থানা এলাকায় দোকানমালিকের বাসায় ভাড়ায় থাকতেন তিনি। ঘটনার দিন দোকান মালিকের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে খালার বাসার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল সে। কিন্তু গুলিবিদ্ধ হয়ে পথেই মারা গেল সাইমন।
নাইমা সাংবাদিকদের জানান, সাইমনের মা রহিমা তার আপন বোন। রহিমার দুই ছেলের মধ্যে সাইমন ছিল ছোট। তার বড় ভাইয়ের নাম তুশিন। ২০১২ সালে মারা যান সাইমনের বাবা আমিন রসুল। তখন সাইমনের বয়স ছিল দুই বছর। তুশিন জন্মের পর থেকেই কিছুটা সাদাসিধে স্বভাবের। সাইমন পরিবারের ঘানি টানতে কিশোর বয়সেই নগরের বহদ্দারহাটে মুদি দোকানে কাজ নিয়েছিল। কিছুদিন আগে পিঠাপুলি নিয়ে সাইমনের সঙ্গে দেখা করতে সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রাম শহরে বোনের বাসায় যান রহিমা। সেদিন সাইমনের সঙ্গে তার মায়ের দেখাও হয়েছিল।
গত ১৬ জুলাই মুরাদপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার পর ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী ওমর ফারুকের তার পরিবারে এখনো চলছে শোকের মাতম।
ওই দোকানের মালিক তাজুল ইসলাম জানান, একটি মাত্র বুলেট পুরো পরিবারকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। স্বামীর শোক সইতে পারছেন না স্ত্রী। ছেলের শোকে এখনো স্তব্ধ ফারুকের বাবা দুলাল হোসেন। ঘটনার দিন বিকেলে মুরাদপুরে স্বামী গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) ছুটে গিয়েছিলেন সীমা আক্তার। কিন্তু হাসপাতালে নেওয়ার আগেই না ফেরার দেশে চলে যান ফারুক। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে স্বামীর নিথর মরদেহ ছুঁয়ে সেদিন অঝোর কাঁদতে দেখা গিয়েছিল সীমাকে।
ফারুকের স্ত্রী সীমা আক্তার শুধুই বলছিলেন, ‘আপনি তো রাত দশটায় বাসায় আসার কথা ছিল। এখন কে আসবে? আমার দুই ছেলে মেয়ে কারে বাপ ডাকবে?
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়