পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া ২৭২ জনের মধ্যে ১৩১ জনই গুলিবিদ্ধ


ইত্তেহাদ নিউজ,ঢাকা : কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে পড়ে আহত অনেকের হাত, পা, চোখ, মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারও হাত, পা কেটে ফেলা হয়েছে, কারও আবার চার থেকে আটটি অস্ত্রোপচার করতে হচ্ছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এমন রোগীরা আগামীতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে কিনা তা নিয়ে অনেকে সংশয়ে রয়েছে। গত দুই দিন রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল) ও জাতীয় নিউরো সায়েন্স হাসপাতাল ঘুরে রোগী, স্বজন ও চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাইভেট কারের চালক সজীব খান চিকিৎসা নিচ্ছেন পঙ্গু হাসপাতালে। গত শুক্রবার কাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে তার ডান হাতে গুলি লাগে। শেষ পর্যন্ত তার হাত রাখতে পারবেন কি না তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে চিকিৎসকরা। জানতে চাইলে সজীব বলেন, ‘তিনি ঘটনার দিন ডিউটি শেষ করে বাসায় যাচ্ছিলেন, ওই সময় বাড্ডা নতুন বাজার এলাকায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের তুমুল সংঘর্ষ চলছিল। হঠাৎ পুলিশের একটি গুলি এসে হাতে লাগে। গুলিতে তিনিসহ অনেকেই আহত হন। কথা বলার এক পর্যায়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে সজীব বলেন, ‘আমার হাতে একটা গুলি লেগে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। হাত কেটে ফেলতে হয় কি না, সে চিন্তায় দিন কাটছে।’
হাত ও পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে পঙ্গু হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ডে-১ (পুরুষ) এর জি-৪৭ নম্বর বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে ৯ বছরের শিশু রিফাতকে। তার বাম পায়ে ও বাম হাতে গুলি লাগে। হাঁটুর ওপরে একটি গুলি, যা পা ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। সঙ্গে থাকা বাবা-ফুপুর কোনো সন্তানই শিশুটিকে শান্ত করতে পারছে না।
রোববার রিফাতের বাবা সোহাগ হাওলাদার বলেন, রিফাত শেরেবাংলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র। বাসা মিরপুর-১৩ নম্বরে। ১৯ জুলাই শুক্রবার সন্ধ্যার পর ছেলে পিয়াজু খাবার বায়না ধরে, মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে তিনশ গজ দূরে একটি দোকানে পিয়াজু কিনতে বেড় হয়, দোকান বন্ধ দেখে, রিফাত বাসার দিকে ফিরছিল। পথে অনেক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দেখে সে দ্রুত হাঁটতে শুরু করে, হঠাৎ তার বাম হাতে লেগে বাম পায় ভেদ করে বেরিয়ে যায় একটি গুলি। সঙ্গে সঙ্গে সড়কে পড়ে যায় রিফাত। রাতেই তাকে আনা হয় হাসপাতালে। সেই থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে রিফাত।
চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পঙ্গু হাসপাতালের শুধু ক্যাজুয়ালিটি-২ ওয়ার্ডে ৩৬ জন রোগী ভর্তি করা হয়েছে। তাদের ৬ জনের বাম বা ডান পা কেটে ফেলতে হয়েছে। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় পা হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন আরও অনেকে। হাতে গুলি লেগেও কেউ কেউ গুরুতর আহত হয়েছেন, আরও অনেকের হাত-পা কেটে ফেলতে হতে পারে। চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন হাত-পা যাতে কেটে ফেলতে না হয়। তবে শেষ রক্ষা হবে কি না, নিশ্চিত নন। তাদের কারও লেগেছে একটি গুলি, কারও একাধিক; ছররা গুলি শরীরে নিয়ে বিছানায় কাতরাচ্ছেন অনেকে।
পঙ্গু হাসপাতালের তথ্যকেন্দ্র থেকে জানা গেছে, এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ২৭২ জন। এর মধ্যে ২৩১ জনই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। বর্তমানে ভর্তি আছেন ৭৫ জন। এর মধ্যে ২৬ জনের অবস্থা গুরুতর।
রোগীদের স্বজনদের অভিযোগ, অস্ত্রোপচারের সিরিয়াল পাচ্ছি না। চিকিৎসক ও নার্সদের কাছে বারবার ধরনা দিয়েও কাজ হচ্ছে না। রোগীর অবস্থা খারাপ হচ্ছে, সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ভয় তো আছেই।
পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী শামীম উজ্জামান বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন ২০ থেকে ২১টা রুটিন অস্ত্রোপচার করতে থাকি। জরুরি পরিস্থিতিতে ৪০ থেকে ৫০টা করা সম্ভব হয়। এক সপ্তাহ ধরে অস্ত্রোপচারের চাপ বেড়েছে। যাদের অবস্থা বেশি খারাপ, তাদের আগে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।
গত ১৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় সহিংসতার শিকার হয়ে জাতীয় নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সুমন (৩৮)। তিনি চাষাঢ়ার গলাচিপা মহল্লায় পরিবারের সঙ্গে বাস করছেন। শনিবার হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, নিউরো ট্রমা বিভাগের ওয়ার্ডের বিছানায় শুয়ে আছেন সুমন। এক সপ্তাহ ধরে স্যালাইনের ওপর রাখা হয়েছে। এক মাস পর দ্বিতীয় দফায় ভাঙা হাড় জোড়া লাগানো হবে। কবে নাগাদ পূর্ণ সুস্থ হবেন সে নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না চিকিৎসকরা। হাসপাতালের ট্রমা রেড ইউনিটের প্রধান (চিফ নিউরো) সহযোগী অধ্যাপক ডা. মোয়াজ্জেম হোসাইন তালুকদার বলেন, সুমনের হাড় দেড় ইঞ্চি পরিমাণ ভেতরে দেবে গেছে। সার্জারি করে জোড়া লাগানো হবে। এজন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।’
সুমনের স্ত্রী আমেনা আক্তার ইভা বলেন, ঘটনার দিন (গত বৃহস্পতিবার) সকাল থেকেই গলাচিপার কাছে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ চলছিল। বাসা থেকে ঘটনাস্থলের দূরত্ব পাঁচ মিনিটের। সংঘর্ষের সময় রাস্তার পাশের টং দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন ভয় জাগে মনে। ঝুঁকি নিয়েই দোকান ঠিক আছে কিনা দেখতে যান। আচমকা একের পর এক ইটের আঘাতে মাথা রক্তাক্ত হয়ে যায় সুমনের। মুহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে কতজন চিকিৎসা নিয়েছেন জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির যুগ্ম পরিচালক অধ্যাপক ডা. বদরুল আলম সহকারী পরিচালক ডা. আসগার কামালের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। আসগর কামাল প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মাদ আলী জিন্নাকে তথ্য দিতে বলেন। পরে জিন্নাহ জানান, চিকিৎসা দেওয়া রোগীর তথ্য জানাতে নিষেধাজ্ঞা আছে। সব তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়