মতামত

কোটা সংস্কার থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের পথে বাংলাদেশ

udllk du jj
print news

ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব : ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাস বদলে যাওয়ার একটি দিন। ছাত্রসমাজের দুঃসাহসী সংগ্রামী চরিত্রকে বিশ্বব্যাপী পরিচিত করার দিন। ঘাতকের বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়ে, শহীদী রক্তে রঞ্জিত হয়ে বিজয় আনার দিন। দুঃশাসনের এক কালো অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটাতে আমাদের ছাত্রসমাজ যে দুঃসাহস ও আত্মত্যাগের নজরানা পেশ করল, তা সারা বিশ্বে এক গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহাসিক ঘটনা হয়ে থাকবে। সামান্য সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা একটি আন্দোলন কীভাবে জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে রূপ লাভ করল, তা বিশেষ কোনো পর্যালোচনার দাবি রাখে না। কেননা বিগত ১৫ বছর ধরে এদেশের আর্থিক খাত, শিক্ষা খাতসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে যে দুর্নীতির মচ্ছব লাগাতারভাবে চলমান ছিল, তা জনগণকে ভীষণ অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। প্রশাসন সরকারি পেটুয়া বাহিনীতে পরিণত হওয়ায় বিচার পাওয়ার স্বাভাবিক অধিকার মানুষ হারিয়েছিল। প্রশাসনিকভাবে গুম, খুন, নির্যাতন ছিল নিত্যকার ঘটনা। ভিন্নমতাবলম্বী দমনের জন্য আয়নাঘর নামক জীবন্ত কবরে নির্মমভাবে অত্যাচার করা হতো নিরীহ মানুষকে। এতসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার পর্যন্ত অধিকার ছিল না। সর্বদিক থেকে অবরুদ্ধ অবস্থায় জনগণ যখন একপ্রকার হাল ছেড়ে দিয়েছিল, তখনই ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয় এদেশের নতুন প্রজন্মের তরুণ ও ছাত্রসমাজ। তারা রাজপথে নামলে ছাত্রসমাজের সাথে মিলে-মিশে একাকার হয়ে যায় গণমানুষের দাবি দাওয়া। এভাবেই কোটা সংস্কার আন্দোলন পরিণত হয় রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনে।

ছাত্র আন্দোলনের এই বিজয় আমাদের সামনে যেন বহু দরজা খুলে দিয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে পঞ্চাশ বছর ধরে অধরা স্বপ্নগুলো এখন যেন বাস্তব হয়ে ওড়াওড়ি করছে। মানুষ যেন বুক ভরে প্রশান্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছে। জাতীয় জীবনে নিঃসন্দেহে এ এক বিরাট অর্জন। যদিও গন্তব্য এখনও বহুদূর, যাত্রাপথ বড় বন্ধুর, তবুও আমাদের আশাবাদী অন্তর হাজারো প্রত্যাশার ডালি নিয়ে বসে আছে। হয়তো অচিরেই এবার আমাদের চিরকাক্সিক্ষত স্বপ্নগুলো ডানা মেলে উড়বে। আল্লাহর অশেষ রহমত ও নেয়ামতে নতুন এক বাংলাদেশ দেখবে। যেখানে থাকবে না দুর্নীতি, অপশাসন ও বৈষম্য। যেখানে মানুষ নিজের স্বপ্নগুলো নিয়ে বাঁচতে পারবে। যেখানে মানুষ নিরাপত্তা পাবে, পাবে ইজ্জতের গ্যারান্টি। যেখানে মানুষ তার বৈধ অধিকার ফিরে পাবে। যেখানে মানুষ দেশ গড়ার কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবে। যেখানে মানুষ জান্নাতের পথে চলার পূর্ণ সুযোগ লাভ করবে।

রাষ্ট্র সংস্কারের এই বিপুল প্রত্যাশাই আমাদের চোখে-মুখে ঘুরে ফিরছে। তবে এ পথে আমাদের পাড়ি দিতে হবে সংস্কারের এক লম্বা পথ। বিশেষ করে, আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হলো দুর্নীতি। দেশের কোনো সরকারি অফিস ঘুষ-বাণিজ্য থেকে মুক্ত নয়, এ কথা নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়। সুতরাং নতুন বাংলাদেশে কোনো সরকারি অফিসে ঘুষ দিতে হবে না, দুর্নীতি ও হয়রানির শিকার হতে হবে না, কোনো রাজনৈতিক চাঁদাবাজির মুখোমুখি হতে হবে নাÑ এটাই আমাদের প্রথম প্রত্যাশা। এছাড়া কোনো উন্নয়ন ও সেবামূলক প্রকল্পে কর্মকর্তাদের বখরা ও কমিশন বাণিজ্য যেন বন্ধ হয়, ভুয়া বিলের কারসাজি যেন না থাকে সেটা কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে।

আমাদের আরো প্রত্যাশা, নতুন বাংলাদেশ হবে বৈষম্যহীন, যেখানে কোনো ধনী-গরিব কোন বাছ-বিচার করা হবে না। মামা-খালুর দৌরাত্ম্য থাকবে না। রাষ্ট্রে সবার সমান নাগরিক অধিকার রক্ষা করা হবে। সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু নয়, সবাইকে মানুষ হিসেবে গণ্য করা হবে। সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে মেধাবী ও দক্ষরা দল-মত নির্বিশেষে অগ্রাধিকার পাবে। মানুষ বিদেশে নয়, বরং নিজের দেশেই ভবিষ্যৎ গড়তে আগ্রহী হবে।

নতুন বাংলাদেশের নেতৃত্ব হবে সৎ, দক্ষ, প্রতিহিংসামুক্ত, জনদরদী এবং কল্যাণমুখী। নেতৃত্ব নির্বাচন ব্যবস্থা এমন হবে যেখানে কোনো ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের জায়গা থাকবে না। জনসেবাই হবে নেতৃত্বের একমাত্র মূলমন্ত্র। নেতৃত্ব নিয়ে হানাহানিমুক্ত থাকতে নির্বাচনে কোনো দল ও প্রার্থী থাকবে না, বরং সবার অংশগ্রহণমূলক নির্দলীয় নিরপেক্ষ নেতৃত্ব নির্বাচন ব্যবস্থা থাকবে। ইসলামী খেলাফতের আদলে ও আল্লাহর বিধানের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। দক্ষতা ও মেধাসম্পন্নদেরকেই দেশ গড়ার দায়িত্ব দেয়া হবে। রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষমতার হানাহানি আর অবৈধ অর্থ-সম্পদ গড়ার প্রতিযোগিতা থেকে দেশের মানুষ মুক্তি পাবে। এই গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা, এই পাওয়ার পলিটিক্সের জাঁতাকল থেকে জনগণ চিরতরে মুক্তি পাবে।

নতুন বাংলাদেশে পুলিশ প্রশাসন হবে জনতার বন্ধু। বিগত সময়গুলোতে পুলিশ কখনও জনতার সেবক হতে পারেনি। আর কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় পুলিশ পুরোপুরি গণশত্রুতে পরিণত হয়। যার ফলস্বরূপ বাংলাদেশের সাড়ে ছয় শত থানার মধ্যে সাড়ে পাঁচ শত থানাই আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। গণপিটুনিতে নিহত হয় প্রায় অর্ধশত পুলিশ। জনরোষের ভয়ে তারা নিরাপদ আশ্রয়ে এমনভাবে লুকিয়ে থাকে এক সপ্তাহ যাবৎ। এই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার পর পুলিশ প্রশাসনে সংস্কার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এই সংস্কারের পথে পুলিশকে অবশ্যই ভক্ষক নয়, বরং রক্ষক হতে হবে। যে নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা নিয়ে তারা জনগণের উপর ছড়ি ঘুরিয়েছে, তার অবসান হতে হবে। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংখ্যক মামলা দিতে হবে, এমন শয়তানি ও পাশবিক নীতির বিলোপ সাধন করতে হবে। মানুষের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে মিথ্যা মামলা দেয়া বন্ধ করতে হবে। ঘুষ বাণিজ্য এবং মানবাধিকার লংঘনকারী যে কোনো তৎপরতা থেকে মুক্ত থাকতে হবে। যেন পুলিশ হয় জনতার, সম্পর্ক হয় পূর্ণ আস্থার। মানুষ যেন নিজের হাতে আইন না তুলে নেয়। মান্ধাতার আমলের পুলিশ আইনের আমূল সংস্কার করতে হবে। জেলকোড সংশোধন করতে হবে। একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে একদিনের জন্যও যেন হাজত না খাটতে হয়, অন্যায়ের শিকার হতে না হয়। সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।

নতুন বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থার সংস্কার হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্যোগ। বর্তমানে প্রচলিত বৃটিশ আমলের বিচার ব্যবস্থার কোনভাবে যুগের সাথে সামঞ্জস্যশীল নয়। এই ব্যবস্থার আশু পরিবর্তন আবশ্যক। এখানে আসামি, বিচারপ্রার্থী কারোরই প্রত্যাশা পূরণ হয় না। বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা এতই বেশি যে, বাদী ও আসামি উভয়েরই জীবনাবসান হয়, কিন্তু বিচার আর শেষ হয় না। যে-ই বিচারপ্রার্থী হোক না কেন, সে যেন দ্রুততম সময়ে বিচার পায় এবং সঠিক বিচার পায় সেটা কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে।

নতুন বাংলাদেশের মিডিয়া যেন মিথ্যাচার না করে, কর্তব্য পালনে কোনো রক্তচক্ষুর ভয় না পায়। কারো লেজুড়বৃত্তি না করে। তারা যেন সত্যটা যথাযথভাবে প্রকাশ করতে পারে।

নতুন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা যেন জিপিএ আর সার্টিফিকেটনির্ভর না হয়, বরং তা যেন হয় মেধা ও দক্ষতার বিকাশে সর্বোচ্চ সহায়ক। তা যেন হয় আদর্শ মানুষ গড়ার উত্তম ব্যবস্থা। এখানে যেন যোগ্যরাই কেবল শিক্ষক হয়। ইসলামী শিক্ষা তথা নৈতিকতার শিক্ষা যেন শিক্ষার সকল স্তরে বাধ্যতামূলক করা হয়। নতুন বাংলাদেশের ব্যবসা যেন হয় সিন্ডিকেটমুক্ত। সবাই যেন স্বাধীন ও সৎভাবে ব্যবসা করতে পারে, সে সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। বাজার ব্যবস্থা এমনভাবে মনিটরিং করতে হবে, যেন খাদ্যে মানুষ ভেজাল দিতে না পারে, কোনো অসৎ ব্যক্তি যেন অন্যায় কোনো সুযোগ না নিতে পারে।

নতুন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যেন দায়িত্বহীনতা ও অব্যবস্থাপনা থেকে মুক্ত হয়। মানুষ যেন সঠিক জায়গায় সঠিক চিকিৎসা পায়। ঔষধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি আর ক্লিনিকের সেবা বাণিজ্যে মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয়।

নতুন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এমন শক্তিশালী এবং দায়িত্বপূর্ণ হতে হবে, যাতে ন্যায়কে ন্যায় এবং অন্যায়কে অন্যায় বলার সৎসাহস থাকে। মেরুদন্ড সোজা রেখে বহির্দেশগুলোর সাথে নিজেদের সম্পর্ক রক্ষা করা যায়, কারো আধিপত্যের অধীনে নিজেকে বিসর্জন দিতে না হয়।

সর্বোপরি আমরা আজ যে বাংলাদেশ পেয়েছি, তা এক স্বপ্ন পূরণের বাংলাদেশ। জালিমরা যেখানে বিজিত, আর মজলুমরা বিজয়ী। এমন মুহূর্তে যে এক স্বপ্নভরা আদর্শ বাংলাদেশের কাল্পনিক দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে ঘুরপাক খাচ্ছে, তা বাস্তবে রূপদানের জন্য আদর্শ সময় এখনই। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে যে স্বাধীনতার স্বাদ আমরা পেয়েছি, তাকে কোনো অবস্থাতেই বৃথা যেতে দেয়া যাবে না। আমরা ইতিহাস থেকে শিখতে চাই। শেখ হাসিনার জুলুমশাহীর অকস্মাৎ পতন আমাদের বহু শিক্ষা দিয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো সর্বাবস্থায় জুলুম থেকে বিরত হওয়া। কেননা, অন্যায় ও দাম্ভিকতা মানুষকে সাময়িক তৃপ্ত ও নিরাপদ রাখলেও কোনো না কোনো সময় তাকে অবশ্যই ধরাশায়ী করবে। কল্পনাতীতভাবেই করবে। যখন সে সময় আসবে, তখন তা আর এক মুহূর্ত সময়ও পাওয়া যাবে না। সুতরাং জুলুম-নির্যাতন থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে, যদি সে প্রতিপক্ষ হয় তবুও। সর্বদা আল্লাহকে ভয় করতে হবে। তার দেয়া অফুরন্ত নেয়ামতকে স্মরণ করে তাঁর প্রদত্ত আমানতকে যথাযথভাবে রক্ষা করতে হবে।

স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। কেবল শাসকের পরিবর্তনেই এই স্বাধীনতা রক্ষা করা যাবে না, তার প্রমাণ আমরা ৭১-এ পেয়েছি। বরং সংস্কার প্রয়োজন রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরে, একদম ভেতর থেকে। রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোর পরিবর্তন ছাড়া রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তনে বিশেষ কোনো লাভ হবে না। বরং তাতে এক স্বৈরশাসকের পরিবর্তে আরেক স্বৈরশাসকের আগমন ঘটবে। এক দখলদারিত্বের জায়গায় অপর দখলদারিত্বের বিস্তার ঘটবে। ফলে জনগণের কাক্সিক্ষত মুক্তি অর্জিত হবে না। প্রকৃত স্বাধীনতাও আসবে না। সুতরাং নেতা নয়, নীতির পরিবর্তনই হোক আমাদের লক্ষ্য। চেয়ারে বসা নয়, বরং সিস্টেম চেঞ্জই হোক আমাদের পরিকল্পনা।

লেখক: চেয়ারম্যান, হাদীছ ফাউন্ডেশন শিক্ষা বোর্ড।

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *