ফিচার

চোখের আলোয় নতুন দেশ দেখার অপেক্ষা

image 840688 1724187404
print news

ইত্তেহাদ নিউজ,ঢাকা : আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের ছররা গুলি, নির্যাতন, নিপীড়ন ও আঘাতে হাজারখানেক মানুষ দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। তাদের কেউ এক চোখ, কেউ দুই চোখেই দেখতে পাচ্ছেন না। এ বাস্তবতায় জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থী রিয়াজ মোর্শেদ অপু, রাকিবুল ইসলাম এবং রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নির্মাণ শ্রমিক মাহাবুল চোখের আলো ফেরার অপেক্ষায় আছেন। এক্ষেত্রে তাদের পরিবার উন্নত চিকিৎসার জন্য দ্রুত সরকারি সহায়তার দাবি করেছেন।

মঙ্গলবার চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ৪১৬নং ওয়ার্ডের পি-২৩ নম্বর বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখা যায় কলেজ শিক্ষার্থী রিয়াজ মোর্শেদকে (২৩)। পাশে বসা বোন নাসরিন জাহান তুলি ভাইকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। জানতে চাইলে তুলি যুগান্তরকে বলেন, পরিবারের বাধা সত্ত্বেও ছোট ভাই রিয়াজ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যেত।

১৭ জুলাই রিয়াজের ঊরু, পিঠ, মুখে পুলিশের ছোড়া ছররা গুলি লাগলে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি নিয়ে আসি। পরদিন ১৮ জুলাই কাওকে না জানিয়ে ফের আন্দোলনে যায়। ওইদিন সন্ধ্যায় যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় তুমুল সংঘর্ষের মাঝে পড়ে পুলিশের ছোড়া গুলি লেগে ডান চোখে মারাত্মকভাবে আঘাত পায়। খবর পেয়ে প্রথমে আমরা একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তৃপক্ষ ভয়ে ভর্তি নেয়নি। পরে যাত্রাবাড়ী চক্ষু হাসপাতালে যাই। চোখ দিয়ে অনবরত রক্ত ঝরায় চিকিৎসক দ্রুত জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে নেওয়ার পারমর্শ দেন। হাসপাতালে আসার সময় পথে দফায় দফায় পুলিশ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বাধার সম্মুখীন হই। ওদের হাত-পা ধরে কান্নাকাটি করে অবশেষে ভাইকে নিয়ে হাসপাতালে আনতে পারি। এসে দেখি রোগীর ভিড়ে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। পরদিন ১৯ জুলাই সকালে চোখে অস্ত্রোপচার হয়। চিকিৎসক ব্যান্ডেজ খুলে দুই সপ্তাহ পর আসতে বলেন। পরে ফলোআপ চিকিৎসা নিতে এলে চিকিৎসকরা জানান চোখে ছানি পড়েছে। সিরিয়াল অনুযায়ী অপারেশন করা হবে। মাঝে পরিস্থিতি বেশি খারাপ হওয়ায় ৫ আগস্ট নিয়ে আসি। এবারও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা লিখে ছেড়ে দেয়। এরপর ১৪ আগস্ট নিয়ে এলে ভর্তি নেয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, চোখের ভেতর গুলি রয়ে গেছে। গুলির কারণে রক্ত জমাট বেঁধেছে। সেখান থেকে ইনফেকশন হয়েছে। সোমবার জানতে পেরেছি কর্নিয়া নষ্ট হয়ে গেছে। দেশের বাইরে নিলেও ভালো হবে না। তুলি আরও বলেন, আমরা ভাইকে প্রতিনিয়ত মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছে যে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। ভাইও চোখের আলো ফেরার অপেক্ষায় দিন গুনছে।

একই ঘটনায় আহত হয়ে পাশের বিছানায় চিকিৎসাধীন রাকিবুল ইসলাম (২৪)। মঙ্গলবার হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষার্থী জানান, উত্তরা বিএনএস ওভারব্রিজ এলাকায় তার চোখে অন্তত চারটি গুলি লাগে। এরপর থেকে দুই চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। দুটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েও দুই চোখে আলো না ফেরায় বর্তমানে এখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

রাকিবুলের মা রেশমা আক্তার বলেন, ছেলের বাম চোখে অপারেশন করার পর বর্তমানে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ দেখতে পাচ্ছে। আজ ডান চোখে অপারেশন করা হবে। চিকিৎসকরা আল্লাহর ওপর ভরসা রাখতে বলেছেন। তিনি বলেন, ছেলেদের আন্দোলনের কারণে মানুষ মুক্তি পেয়েছে। দেশের পরিবেশ স্বাভাবিক হয়েছে। এখন আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া-আল্লাহ আমার ছেলের চোখের আলো ফিরায়ে দেন।

চল্লিশ বছর বয়সি মাহাবুল একজন নির্মাণ শ্রমিক। ১৮ জুলাই কর্মস্থল থেকে ঘরে ফেরার পথে গাজীপুরের জয়দেবপুর এলাকায় পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের মাঝে পড়ে যান। এ সময় তার শরীরে ৫০টির মতো ছররা গুলি লাগে। চোখে গুলি লাগে ৬টি। আহত মাহাবুল বেশ কিছুদিন রাজধানীর চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গুলি লেগে তার বাম চোখ এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে আর কখনো এই চোখে আলো ফিরে পাবেন না! স্বজনরা জানিয়েছেন, পুলিশের আঘাত শুধু দৃষ্টিশক্তিই নয়, মাহাবুলের মস্তিষ্কেও সমস্যা তৈরি করছে। বর্তমানে তাকে রংপুর মেডিকেলের নিউরো সার্জারি বিভাগে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। মঙ্গলবার মাহাবুলের স্ত্রী মাসুদা বেগম মোবাইল ফোনে যুগান্তরকে বলেন, গুলি লাগার পর স্থানীয়রা স্বামীকে জয়দেবপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে তিনদিন ভর্তি থাকলেও উন্নতি না হওয়ায় ঢাকা মেডিকেলে নিয়েছিলাম। সেখানকার চিকিৎসকরা জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে রেফার্ড করেন। অর্থ সংকটে গ্রামের বাড়ি নিয়ে রংপুর মেডিকেলে ভর্তি করি। চিকিৎসকরা জানান, গুলির আঘাতে চোখে পয়জন (ধুলা-ময়লা) জমে কর্নিয়া ও নার্ভ মারাত্মক জখম হয়েছে। যত চেষ্টাই করা হোক বাম চোখে আলো ফিরবে না। তারপরও ২৫ জুলাই রংপুর থেকে ঢাকায় নিয়ে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালে ভর্তি করি। কয়েকদিন রেখে ছুটি দিলে বাড়ি চলে আসি। এখন চোখের পাশাপাশি ব্রেনে সমস্যা দেখা দেওয়ায় ১৭ আগস্ট চারদিন হলো রংপুর মেডিকেল নিউরো সার্জারির ১৫নং ওয়ার্ডের ৩৫ নম্বর ভর্তি আছি। চোখ ও মাথার ব্যথায় উঠে দাঁড়াতে পারছে না।

মাহাবুলের স্ত্রী আরও বলেন, স্বামী বাম চোখে কিছুই দেখতে পারছেন না। চোখ জ্বালাপোড়া, টাটানো ও চুলকায়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মাথার ভেতর এখনো গুলি রয়েছে। এ কারণে মাথাব্যথা, জ্বালা-যন্ত্রণা হচ্ছে, ঘুমাতে পারছে না, কথাও বলতে কষ্ট হয়। মাসুদা বেগম আরও বলেন, স্বামীর চিকিৎসা বাবদ প্রায় এক লাখ টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ১০ হাজার টাকা দিয়েছিল। এর বাইরে সরকার বা কারও কাছ থেকে কোনো সহায়তা পাইনি। এদিকে স্বামী চোখের আলো হারিয়ে অন্ধ হয়ে গেছে। এরই মধ্যে মাথার সমস্যায় হাসপাতালে ভর্তি করেছি। চিকিৎসা খরচ জোগাতে পারছি না। স্বামী সুস্থ হলে ফের পরিবারের হাল ধরবে। সেই আশায় চোখের আলো ফেরা ও সুস্থতার জন্য দিন গুনছি।

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায়

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *