বাংলাদেশ ঢাকা

মানিকগঞ্জে বিচারকের স্বাক্ষর জাল করে সাড়ে ৩২ কোটি টাকা আত্মসাৎ তদন্তে দুদক

image 29705 1696852120
print news

ইত্তেহাদ নিউজ,ঢাকা : বিচারকদের স্বাক্ষর জাল ও ভুয়া পেমেন্ট অর্ডারের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারের ৩২ কোটি ৬০ লাখ টাকার উপরে আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে মানিকগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের হিসাব সহকারীর বিরুদ্ধে। জালিয়াতির ঘটনা ফাঁস হওয়ার পরই দেশ ছেড়ে দুবাই পাড়ি জমিয়েছেন ইমরান নাজির। সরকারি কোষাগার থেকে বিশাল অঙ্কের টাকা জালিয়াতির ঘটনায় মানিকগঞ্জের আদালত পাড়ায় ব্যাপক তোলপাড় চলছে। এ ঘটনায় দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সুজন শিকদার বাদী হয়ে জালিয়াতি চক্রের অন্যতম হোতা জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের ডিএএফও (ডিস্ট্রিক অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফিন্যান্স অফিসার) মো. নজরুল ইসলাম, সুপার দেওয়ান ফেরদৌস ওয়াহিদ, মানিকগঞ্জ আইনজীবী সমিতির ৬ জন সদস্য ও ইমরান নাজিরের নিকটতম আত্মীয়স্বজনসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে মামলা হয়েছে। এ ঘটনা কর্তৃপক্ষের নজরে আসার পর পরবর্তীতে হিসাব সহকারী ইমরানকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

ইমরান কুষ্টিয়া জেলার খোকসা উপজেলার ধোকরাকোল গ্রামের মৃত নাজমুস সাহাদতের ছেলে। ২০১৮ সালে মানিকগঞ্জ জজ কোর্টের মাধ্যমে চাকরি জীবন শুরু করেন। এদিকে মামলার বাদী সুজন শিকদার জানান, মামলাটি তদন্তের জন্য স্পেশাল জজ আদালত থেকে দুদকে পাঠানো হয়েছে। টানা ৫ বছরের বেশি সময় ধরে নজিরবিহীন জালিয়াতির ঘটনা চললেও ধরা পড়ে চলতি বছরের নভেম্বরে। এতে যোগসাজশের অভিযোগ স্বয়ং জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের জেলা কর্মকর্তা ও সুপারের বিরুদ্ধে। তবে জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের ডিএএফও নজরুল ইসলামের কাছে কীভাবে জালিয়াতি হলো জানতে চাইলে ‘নো কমেন্টস’ বলে জানান। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৮ই জুলাই ২০১৯ সাল থেকে ২২শে আগস্ট ২০২৪ সাল পর্যন্ত বরখাস্তকৃত ইমরান নাজির মানিকগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে কর্মরত বিচারকদের স্বাক্ষর জাল করে প্রিয়েমশনসহ চলমান ও নিষ্পত্তিকৃত বিভিন্ন মামলার ভুয়া পেমেন্ট অর্ডার তৈরি করে শতাধিক মানুষের নাম সৃজন করে ৩২ কোটি ৬০ লাখ ৩২ হাজার ৭৬৭ টাকা আত্মসাৎ করেন।
ইমরানের স্ত্রীর বড় ভাই রুবেল হোসেন, বোন জামাই আবুল হোসেন, চাচাতো ভাই হাবিবুর রহমান, বন্ধু শরীফুল ইসলাম, বান্ধবী (প্রেমিকা) নিলুফা আক্তার, গাড়ির চালক মো. জামাল ও ফুপা ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী মুনসুর আলম, মানিকগঞ্জ আইনজীবী সমিতির ৬ জন আইনজীবীসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মামলার নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, শুধু ৬ আইনজীবীর অ্যাকাউন্টে সরকারি কোষাগারের ১০ কোটি ৫৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা পাচার হয়েছে। গত ৫ বছর ৫ মাস ধরে বিভিন্ন পারিবারিক মামলা, এনআইঅ্যাক্ট (চেক ডিজঅনার) মামলার গচ্ছিত মামলার টাকা সরকারি কোষাগার থেকে পর্যায়ক্রমে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে জজ কোর্টের হিসাব সহকারী একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে ২১ জনের নামে অ্যাকাউন্ট খুলে তাদের কারও নামের হিসাবে ২১ লাখ থেকে শুরু করে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত ভুয়া পেমেন্ট অর্ডার বানিয়ে তুলে নিয়ে গেছে। এ কাজে সহায়তা করার অভিযোগ রয়েছে জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের ডিএএফও নজরুল ইসলাম, একই অফিসের সুপার দেওয়ান ফেরদৌস ওয়াহিদের বিরুদ্ধে।

প্রশাসনে তোলপাড়: এ ঘটনায় চলতি বছরের পহেলা সেপ্টেম্বর ইমরান নাজিরকে শোকজ করা হয়। কর্তৃপক্ষের কাছে ইমরান স্বাক্ষর জালিয়াতির বিষয়টি স্বীকার করেন। পরবর্তীতে হিসাব শাখার ভারপ্রাপ্ত বিচারক অভিযুক্ত ইমরান নাজিরের কারণ দর্শানোর জবাবের ব্যাখ্যা সন্তোষজনক নয় জানিয়ে গত ৯ই সেপ্টেম্বর জেলা জজ তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা পত্র প্রেরণ করা হয়। এরপরই জেলা ও দায়রা জজ তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করেন। আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর বিবেচনা হওয়ায় গত ১৮ই সেপ্টেম্বর তাকে সাময়িক বরখাস্তের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি জেলা ও দায়রা জজ আদালত আসামির মাধ্যমে স্বাক্ষর জালিয়াতির মাধ্যমে কোনো আর্থিক অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে কিনা তা অনুসন্ধানের নির্দেশ দেয়া হয়।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, আসামি ইমরান সরকারি অর্থ আত্মসাতের টার্গেট ছিল পুরাতন রেজিস্ট্রার বই। সেখান থেকে যে সকল মামলার অর্থ ইতিমধ্যে উত্তোলন হয়েছে এবং কোনো পক্ষ বা আইনজীবী আসার কারণ নেই সেসব মামলার বিপরীতে প্রদর্শিত অর্থের পরিমাণ ঘষামাজা করে ইচ্ছামাফিক টাকার অঙ্ক বসিয়ে স্বাক্ষর জালিয়াতি করে টাকা উত্তোলন করেন। চলমান মামলা থেকেও বিপুল পরিমাণ অর্থ অন্য আসামিদের সঙ্গে যোগসাজশে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আদালতের বিচারক, সেরেস্তাদার, বেঞ্চ সহকারী, ভারপ্রাপ্ত বিচারক (নেজারত বিভাগ) কিংবা ভারপ্রাপ্ত বিচারক (হিসাব বিভাগ)-এর বিচারকদের স্বাক্ষর জাল করে চালান, পেমেন্ট অর্ডার ও অন্যান্য কাগজপত্র প্রস্তুত করেন। এরপর ইমরান অবৈধভাবে সরকারি অর্থ আত্মসাতের জন্য জেলা বারের অসাধু ৬ জন আইনজীবী, নিকট আত্মীয়স্বজন, নিজের গাড়ির ড্রাইভারকে পক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করেন।

কার অ্যাকাউন্টে কতো টাকা?: এডভোকেট হুমায়ুন কবিরের মাধ্যমে ৩ কোটি ৪৭ লাখ ৮৬ হাজার টাকা, আইনজীবী মো. মাহফুজুর রহমানের মাধ্যমে মিটুল ১ কোটি ৭৬ লাখ ৮৬ হাজার ৯৭০ টাকা, নিলুফা আক্তারের মাধ্যমে ১ কোটি ৪১ লাখ ৮০ হাজার ৬০৪ টাকা, রেহেনা খানমের মাধ্যমে ১ কোটি ৮১ লাখ ৪৫ হাজার ২৫০ টাকা গ্রহণ করেন। এ ছাড়া, আসামি আতিকুর রহমান বার কাউন্সিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সনদপ্রাপ্ত না হয়েও তিনি নিজেকে আইনজীবী হিসেবে উপস্থাপন করে আসামি ইমরান নাজিরকে সহায়তায় বিভিন্ন মেয়াদে ১ কোটি ৬১ লাখ ৭৯ হাজার ৭৫৭ টাকা নিজ অ্যাকাউন্টে গ্রহণ করেন। পাশাপাশি তার বোন এডভোকেট জেসমিন রহমান বীথি ৪৮ লাখ ৯১ হাজার ১১০ টাকা গ্রহণ করেন। আসামি আবুল হোসেনের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ২ কোটি ১৯ লাখ ৪০ হাজার ৮০ টাকা, গাড়ির ড্রাইভার মো. জামালের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ১ কোটি ৫৯ লাখ ৬৭ হাজার ৮৪১ টাকা, মো. হাফিজুর রহমানের নামে ৬৮ লাখ ১৪ হাজার ৩০০ টাকা, মো. রুস্তুম আলীর নামে ১ কোটি ৬১ লাখ ২৭ হাজার ৮৯ টাকা, মো. রুবেল হোসেনের নামে ১ কোটি ২৫ লাখ ১৮ হাজার ৫১ টাকা, মো. ফরিদ রায়হানের নামে ৩১ লাখ ৪৭ হাজার টাকা, এডভোকেট আফরিন আক্তার মিমের নামে ৫১ লাখ ৯ হাজার ৪৪৩ টাকা, মো. শরীফুল ইসলামের হিসাবে ৩ কোটি ৭৫ লাখ ১১ হাজার ৬৮৩ টাকা, মো. মুনসুর আলমের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৩০ লাখ ৫১ হাজার ৭৯০ টাকা, কানন আক্তারের নামে ৯৮ লাখ ২১ হাজার ৮০০ টাকা অবৈধভাবে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছে।

ইমরানের স্ত্রীর স্বীকারোক্তি: এ ধরনের কেলেঙ্কারির বিষয়টি ফাঁস হওয়ার পরপরই ইমরান দুবাইতে চলে যান বলে জানান তার স্ত্রী আফিফা। বর্তমানে দুবাইয়ে দোকান খুলে ব্যবসা করছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। তিনি বলেন, অতিরিক্ত টাকা কামানোর বিষয়ে আমি জিজ্ঞেস করলে জবাবে ইমরান বলতো চাকরির বাইরে তার জমিজমা এবং গাড়ির ব্যবসা আছে। এগুলো সব ব্যবসার টাকা। কিন্তু এ বিষয়গুলো আমি জানি না। ইমরানের টাকায় আমার কোনো উন্নয়ন হয়নি। আমার ভাইয়ের মাধ্যমে যত টাকা তোলা হয়েছে সব তাকে দিয়ে দিয়েছি। আমি ইমরানের অপকর্মের দায় কেন নেবো? তাছাড়া হাবিবুর রহমান এবং শরীফুল ইসলাম ছাড়া তার অপকর্মের কথা কেউ জানতো না।

দুর্নীতি দমন কমিশনের মানিকগঞ্জের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. আজিজ উল্লাহ বলেন, আমার প্রায় ৫০ বছর আইন পেশার বয়স। এই ৫০ বছরের মধ্যে কখনো শুনিনি কোর্টের টাকা আত্মসাৎ করা যায়। ঘটনাটি পুরো বিচার বিভাগকে ভাবিয়ে তুলেছে। এ বিষয়ে জেলা জজ কোর্টের প্রাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নূরতাজ আলম বাহার বলেন, এটা তো সরকারি টাকা এবং বিভিন্ন মামলার টাকা। এ ঘটনার নেপথ্যে যে সকল আইনজীবীর নাম উঠে এসেছে তাদের বিরুদ্ধে বারের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান তিনি। মামলার বাদী জেলা দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সুজন শিকদার বলেন, তার অফিসের বরখাস্তকৃত হিসাব সহকারী, ৬ আইনজীবী, ডিস্ট্রিক অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফিন্যান্স অফিসের দু’জন শীর্ষ কর্মকর্তাসহ ২১ জন এবং অজ্ঞাত সংখ্যক আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার আইনজীবী সামিউল মাহমুদ রাকিব জানান, দুর্নীতি দমন আইন, মানিলন্ডারিং ও দণ্ডবিধির বেশ কয়েকটি ধারায় মামলাটি দায়ের করা হয়। এই মামলা তদন্ত করবে দুর্নীতি দমন কমিশন।

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায় ।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *