সংবাদ আন্তর্জাতিক

আসাদের মানুষ হত্যার কসাইখানা

Untitled 1 11bb98faa7eb399cbd06b445bdd24e4e
print news

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্কআসাদ সরকারের পতনে রেনাদ সোদার মতো হাজারো সিরীয় শরণার্থীর চোখে যখন ঘরে ফেরার স্বপ্ন, তখন আলেপ্পোতে জীর্ণ শীর্ণ লোকটি চোখে মুখে একরাশ বিহ্বলতা নিয়ে কোনও রকম দাঁড়িয়ে আছেন। আসাদের কুখ্যাত কারাগার থেকে কেবল মুক্তি পেয়েছেন তিনি। দেহে দীর্ঘদিনের অনাহার আর অত্যাচারের চিহ্ন। সোমবার বিদ্রোহীদের একটি গাড়ি যখন তাকে নিজ বাড়ির কাছে নামিয়ে দিয়ে যায়, স্বজনরা খুশিতে উৎসব শুরু করেন। মুহূর্তেই তাকে ঘিরে ধরেন আরও অনেকে। সবার হাতেই একটা করে মোবাইল ফোন। সবাই কারও না কারও ছবি দেখিয়ে তার খোঁজ জানতে চাইছেন।

বাশার আল-আসাদের পতনের মধ্যে দিয়ে সিরিয়াতে পাঁচ দশকের আসাদ পরিবারের শাসনের অবসান হয়েছে। বিদ্রোহীরা রবিবার কুখ্যাত সেদনায়া কারাগারে প্রবেশ করে হাজার হাজার বন্দিকে মুক্ত করেন। কিন্তু বিদ্রোহীদের দেখে বন্দিরা প্রথমে ভয়ে কুঁকড়ে যান। তারা ছোটাছুটি শুরু করে দেয়ালের দিকে মুখ দিয়ে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়েন।

কারাগারে প্রবেশ করে বন্দিদের মুক্তকারী বিদ্রোহীদের মধ্যে ছিলেন ৩৯ বছর বয়সী ওসামা শালোম। দ্য ওয়াশিংটন পোস্টকে তিনি বলেন, ‘তারা আমাদের দেখে ভয়ে তটস্থ হয়ে পড়েন। অনেকক্ষণ চিৎকার করার পর তারা বুঝতে পারেন, তারা আসলেই মুক্তি পেয়েছেন।’

গৃহযুদ্ধের সময় প্রায় ১ লাখ ৪৫ হাজার সিরীয়কে আটক করা হয়, যাদের মধ্যে প্রায় ৮০ হাজারের আর কোনও হদিস পাওয়া যায়নি। এই নৃশংসতায় সবার ওপরে আছে এই সেদনায়া কারাগার।

২০০৭ সালের আগে সেদনায়াতে বন্দির সংখ্যা আনুমানিক এক হাজার ৫০০ জন ছিল বলে ধারণা করা হয়। তবে ২০১৭ সাল নাগাদ এই সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে যায় বলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

দামেস্কের ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই কারাগারের কাছেই বেড়ে উঠেছেন শালোম। শৈশবের দিনগুলোর কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘এর কাছাকাছি দিয়ে যেতেও আতঙ্কিত হয়ে পড়তাম। কখনও বুঝে উঠতে পারিনি, কারাগারটা এত বিশাল কেন!’

মানুষ হত্যার কসাইখানা

সিরিয়ার বেসামরিক প্রতিরক্ষা সংস্থার পরিচালক রায়েদ আল-সালেহ আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘সাধারণ কারাগারের সঙ্গে সেদনায়ার কোনও মিল নেই। এটি আসলে একটা মানুষ হত্যার কসাইখানা। এখানে মানুষের ওপর পশুর মতো নির্যাতন চালিয়ে তাদের নৃশংসভাবে জবাই করা হতো।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিদ্রোহীরা ওভেনের মধ্যেও মৃতদেহ খুঁজে পেয়েছে।’ তার ভাষ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০ জন বন্দিকে হত্যা করতো কারাগার কর্তৃপক্ষ।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেদনায়া কারাগারে প্রথম দফায় বন্দিদের আনা শুরু ১৯৮৭ সালে। বাশার আল-আসাদের বাবা হাফিজ আল-আসাদ প্রতিপক্ষকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একটি অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্ব দেন অ্যালোইস ব্রুনার ওরফে জর্জ ফিশারকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিজের কর্মস্থল ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ফিশার সিরিয়ার কারা ব্যবস্থায় গেস্টাপো স্টাইলে নির্যাতন পদ্ধতির প্রবর্তন করেন, যা পরবর্তীতে সেদনায়া, পালমিরা ও আদরাতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে থাকে।

গৃহযুদ্ধ শুরুর আগে সেদনায়ার বেশিরভাগ বন্দিই ছিলেন চরমপন্থি হিসেবে অভিযুক্ত। ইরাকে আল-কায়েদার একটি শাখার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আসাদ তাদেরকে সাময়িকভাবে মুক্তি দেন। তাদের মধ্যে যারাই জীবিত ফিরে আসে, সবাইকে আসাদ আবার পুরে দেন অন্ধকার প্রকোষ্ঠে।

তবে আরব বসন্তের বাতাস সিরিয়াতে লাগলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। জিহাদিদের ছেড়ে দিয়ে সরকার আন্দোলনরত মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীদের দিয়ে সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে থাকে।

নিত্যদিনের নির্যাতন

অ্যামনেস্টি ও জাতিসংঘের প্রতিবেদনের তথ্য মতে, বন্দিদের ওপর পাশবিক নির্যাতনের যেন কোনও শেষ ছিল না। বেদম প্রহার, গোপনাঙ্গে সিগারেটের ছ্যাঁকা, অর্ধাহারে-অনাহারে রাখা, যৌননির্যাতন ও ধর্ষণ ছিল সাধারণ চিত্র। তাদের নিয়মিত খাবার দেওয়া হত কেবল কয়েক চামচ পরিমাণ–যাও অনেক সময় থাকতো পচে যাওয়া বা বাসি। টয়লেট ব্যবহারে কাউকে পুরো একমিনিট সময় পর্যন্ত দেওয়া হতো না। দেখা যেত, অনেক সময় চাপ সহ্য করতে না পেরে কারা কক্ষ মলমূত্রে ভাসিয়ে ফেলতেন বন্দিরা।

তাদের কোনও আওয়াজ করার অধিকার ছিল না, কথা বলা তো অনেক দূরের বিষয়! হাড় ভাঙা মার খেলেও থাকতে হতো মুখ বুঝে, নইলে বেড়ে যেতে পারতো নির্যাতনের মাত্রা। আর ভুলেও কোনও গার্ডের দিকে চোখ তুলে তাকালে তো রেহাই ছিল না।

মৃত্যুর উৎসব

প্রতি সপ্তাহে কারাগারের রক্ষীরা এক থেকে দুবার ‘পার্টি’ করত বলে অ্যামনেস্টির ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের এই পার্টির জন্য কারা কক্ষ থেকে ধরে নিয়ে আসা হতো প্রায় অর্ধশত বন্দিকে। তারপর চোখ বেঁধে বেজমেন্টে নিয়ে করা হতো বেদম প্রহার। কারারক্ষীদের পার্টি শেষ হতো বন্দিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে। আর কারা কক্ষ থেকে বের করার সময় তাদের শোনানো হতো অন্য কারাগারে স্থানান্তর করার গল্প।

স্বীকারোক্তি দেওয়ার জন্য বন্দিদের ওপর রুটিন মাফিক চলতো নির্যাতন। কয়েক দফা নির্যাতনের পর তাদের সামরিক আদালতে তুলে রায় দিতে সময় লাগতো মিনিট দুই!

অপেক্ষার অবসান?

রবিবার প্রায় দুহাজার বন্দি সেদনায়া কারাগার থেকে মুক্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটসের পরিচালক ফাদেল আব্দুল ঘানি। তবে সরকারের হাতে আটককৃত আরও প্রায় ১১ হাজার মানুষের কোনও হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।

নিউ ইয়র্ক টাইমসকে ঘানি তিনি বলেন, ‘বাকিদের হত্যা করা হয়েছে।’

আসাদের পতনের পর অনেকেই ছুটে যান সেদনায়ার দিকে, নিজের স্বজনদের খোঁজে। তাদেরই একজন ৫০ বছর বয়সী ওউথেইমা ইসমাইল হাসান। নিজের পাঁচ ভাইয়ের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরছেন তিনি।

নিউ ইয়র্ক টাইমসকে হাসান বলেন, ‘আমি আশা ছাড়ছি না। তারা নিশ্চয়ই বেঁচে আছেন। হয়ত নির্যাতনে তাদের মাথা বিগড়ে গেছে, স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে গেছে। হয়ত তারা বাড়ির পথ চিনতে পারছেন না।’

কিন্তু সবাই তার মতো আশাবাদী হতে পারছেন না। নিজের চার ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন ৬০ বছর বয়সী হুসনি কারমো। অশ্রুসজল চোখে তিনি বলছিলেন, ‘যারা ফিরে আসেনি, তাদের কেউ আর বেঁচে নেই। আমি আর আশায় বুক বাধতে পারছি না।

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায় ।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *