১১ বছর ধরে কিছুই কেনেননি ভারতের এক নারী


ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :৭৫ বছর বয়সী জনক পালতার মাস ফুরোলে বিদ্যুৎ বিল দেওয়ার চিন্তা নেই। তাঁকে গুনতে হয় না গ্যাস, পানি ও ময়লার বিল। এমনকি কিছু কিনেও খেতে হয় না। শুধু খাওয়া কেন, ১১ বছর ধরে কিছুই কেনেন না এই নারী ভারতের মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরের প্রত্যন্ত গ্রামের একটা বাড়ি বড়ই অদ্ভুত। বাড়িটির চারপাশে বড় বড় জানালা। বাড়ির ছাদে, সামনের উঠানে সোলার প্যানেল আর উইন্ডমিল। আশপাশে মাঠ আর বাগান। সেখানেই ফলে নানা ধরনের শস্য, মসলা আর ফল। বাড়িটির মালিক ৭৫ বছর বয়সী জনক পালতা, যাঁকে বলা হচ্ছে ভারতের টেকসই জীবনযাপনের ‘অ্যাম্বাসেডর’।
১১ বছরে শুধু ওষুধ ছাড়া আর কিছুই কেনেননি জনক পালতা
১১ বছরে শুধু ওষুধ ছাড়া আর কিছুই কেনেননি জনক পালতাছবি: সংগৃহীত
১১ বছর ধরে কিছুই কেনেন না জনক। যা কিছু প্রয়োজন, সব উৎপাদন করেন, নয়তো নিজে বানিয়ে ফেলেন। সোলার কুকারে হয় রান্না। তাঁর সোলার কিচেনে আছে ১৩টি সোলার কুকার। সেখানেই হয় এই বাড়ির ১১ জনের তিন বেলার রান্না। চাল, গম, ডাল, তেল, মসলা, ফল থেকে শুরু করে লেবু, গ্রিন–টি, পুদিনা, ধনিয়া, শর্ষে, রাই, মেথি, তুলসী, প্রয়োজনীয় ভেষজ ওষুধ—সবই উৎপাদন করেন। এমনকি কফি, চকলেট, মুড়ি, বিস্কুট, পাউরুটিও বানান তাঁরা। লেবুর খোসা আর রিঠার গুঁড়া দিয়ে পরিষ্কার করেন থালাবাসন। রিঠা পাউডার দিয়েই চলে জামাকাপড় কাচা। ব্যবহার করেন নিজেদের বানানো প্রাকৃতিক সাবান। দাঁত মাজেন নিমের ডাল দিয়ে। শরীরে মাখেন নিম ও শর্ষের তেল। মুখে মাখেন অ্যালোভেরার জেল। ফসল উৎপাদনে ব্যবহার করেন গোবর ও খাবারের খোসা থেকে তৈরি জৈব সার। এসব কাজে সহায়তার জন্য জনকের সঙ্গে আছেন আরও ১০ নারী। সংসার থেকে বিতাড়িত এই নারীদের বিভিন্ন সময়ে উদ্ধার করে কাজ শিখিয়েছেন জনক। এখন তাঁরা ১১ জন, কয়েকটি গরু, কুকুর, বিড়াল সবাই মিলেই থাকেন বাড়িটিতে।জনকের বাড়ির রাত আলোকিত হয় সোলার প্যানেল ও উইন্ডমিল থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎ দিয়ে। এমনকি জনকের উৎপাদিত বিদ্যুৎ থেকে যে উদ্বৃত্ত থাকে, তা ব্যবহার করছে ওই গ্রামের ৫০টি আদিবাসী পরিবার।
ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না জনক। তবে সকালবেলা এক কাপ চায়ের সঙ্গে কয়েকটি পত্রিকায় চোখ না বোলালে ভালো লাগে না তাঁর। পুরোনো পত্রিকাও বিদ্যুৎ তৈরিতে কাজে লাগান, বানান আসবাবও!
যেভাবে শুরু
১৯৬৭ সালের কথা। মাত্র ১৭ বছর বয়সে একবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল জনক পালতার। ওপেন হার্ট সার্জারি করতে হয়েছিল। সেবার জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে ফিরে জনক ঠিক করেছিলেন, যে কটা দিন বাঁচবেন, পৃথিবীর কোনো ক্ষতি করবেন না। সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে বিলিয়ে দেবেন।
জনক পালতার জন্ম ভারতের পাঞ্জাবে, ১৯৪৮ সালে
জনক পালতার জন্ম ভারতের পাঞ্জাবে, ১৯৪৮ সালেছবি: সংগৃহীত
ইউটিউব চ্যানেল ‘জিন্দেগি উইথ রিচা’–কে নিজের ঘরবাড়ি, খেতখামার দেখাতে দেখাতে জনক বলেন, ‘খুব ছোটবেলা থেকে গ্রামের নারীদের সোলার প্যানেল ব্যবহার করে রান্না করা শেখাই। এভাবে কয়েক দশকে প্রায় ৫০০ গ্রামের নারী সোলার প্যানেল ব্যবহার করে রান্নায় অভ্যস্ত হয়। এতে ধর্ষণের পরিমাণও অনেকটা কমে আসে। কেননা নারীরা বনের গভীর থেকে কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়েই সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের শিকার হতেন। গর্ভাবস্থায় লম্বা সময় ধরে ভারী কাঠ বহন করার ফলে অনেকের পথিমধ্যে গর্ভস্রাব হতো। সেটিও কমে আসে উল্লেখযোগ্য হারে। রান্নার ধোঁয়ায় নারীর স্বাস্থ্যঝুঁকিও কমে আসে। নারীরা তখন শিশুদের পানি ফুটিয়ে খাওয়ানো শুরু করে। ফলে পানিবাহিত রোগ থেকেও রক্ষা পায় শিশুরা।’
২০১১ সালে জীবনসঙ্গী জিমি ম্যাকগিলিয়ানের মৃত্যুর পর জনক তাঁর গ্রামে ফিরে যান আর টেকসই জীবনযাপন শুরু করেন। মূলত স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই তিনি আর কোনো পোশাক বা ব্যবহার্য জিনিস কেনা বন্ধ করে দেন। শেষ ১১ বছরে শুধু ওষুধ ছাড়া আর কিছুই কেনেননি। ছোটবেলা থেকেই প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ে মানুষকে সচেতন করে আসছেন।
স্কুলের শিক্ষার্থীরা জনক পালতার বাড়িতে আসে হাতেকলমে টেকসই জীবনযাপনের শিক্ষা নিতে
স্কুলের শিক্ষার্থীরা জনক পালতার বাড়িতে আসে হাতেকলমে টেকসই জীবনযাপনের শিক্ষা নিতেছবি: সংগৃহীত
‘জিমি ম্যাকগিলিয়ান সেন্টার ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থার প্রধান হিসেবেও কাজ করছেন জনক। সংস্থাটি পরিবেশ রক্ষা ও টেকসই জীবনযাপনের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এলাকায় সবাই তাঁকে এক নামে ‘জনক দিদি’ বলে চেনে। আশপাশের বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তাঁর বাড়িতে আসে হাতেকলমে টেকসই জীবনযাপনের শিক্ষা নিতে। দেড় লাখ তরুণ, ৬ হাজার আদিবাসী নারী ও গ্রামের ১ হাজার নারী তাঁর কাছ থেকে সোলার এনার্জি ব্যবহার করে রান্না করার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
২০১৫ সালে ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির হাত ‘পদ্মশ্রী’ পদক নিচ্ছেন জনক পালতা
২০১৫ সালে ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির হাত ‘পদ্মশ্রী’ পদক নিচ্ছেন জনক পালতাছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
জনক পালতা ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত প্রথম আর্থ সামিটে অংশ নেন। সেখানে তাঁকে ‘টেকসই জীবনের রানি’ বলে সম্মান জানানো হয়। জনক জাতিসংঘের ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’র ভারতীয় অ্যাম্বাসেডর। ২০১৫ সালে ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম থেকে ‘গ্রিন হিরো’ উপাধি পেয়েছেন তিনি। পরিবেশ রক্ষা ও টেকসই জীবনযাপনের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখায় একই বছর ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ পদকেও ভূষিত করে।
* সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়