ফিচার

উদ্যমী যুবক মামুন মিয়ার সব স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দিয়েছে পুলিশের নির্বিচার গুলি

image 187487 1742963243
print news

ইত্তেহাদ নিউজ :  চব্বিশের ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর মিরপুর এলাকায় বিজয় মিছিলে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ৩৪ বছর বয়সী কর্মঠ তরুণ মামুন মিয়া। ভেঙে যায় এক উদ্যমী ও স্বাপ্নিক যুবকের সব স্বপ্ন ও আশা-আকাঙ্ক্ষা।শৈশব থেকে দারিদ্র্েযর সঙ্গে লড়াই করেছেন মামুন মিয়া। কিন্তু কখনও লক্ষ্য অর্জনের সাহস হারাননি, বরং সবসময় অধ্যবসায় ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করেছেন নিরন্তর।রংপুরের পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নের আদম বড়াইপাড়া গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করা মামুনকে স্থানীয় স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করতেই অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে।

১৮ বছর আগে মামুন ভাগ্য পরিবর্তন এবং পরিবারকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে রাজধানী ঢাকা চলে যান। এখানে-সেখানে ঘুরে বিভিন্ন কাজ করার পর শেষে এক গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ শুরু করেন মামুন।কিন্তু অচিরেই তিনি বুঝতে পারেন যে তার অল্প আয়ে পরিবারকে দারিদ্র্যমুক্ত করা এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণের স্বপ্ন পূরণ সম্ভব হবে না।

বছরের পর বছর প্রচেষ্টা করে মামুন কয়েক বছর আগে ঢাকা শহরে তার বন্ধু মাসুদুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে মিরপুর-১ এলাকায় ‘বিসমিল্লাহ ফ্যাশন’ নামে একটি ছোট আকারের কাপড়ের কারখানা শুরু করেন।সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছিল। ২০২৩ সালের ১২ জানুয়ারি বিয়ে করেন। স্ত্রীর নাম শারমিন আখতার লতা, ৩০। লতা ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ইডেন কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্য বিষয়ে মাস্টার্স করেছেন।

লতা বর্তমানে দীন মোহাম্মদ চক্ষু হাসপাতাল ও রিসার্চ সেন্টারে কল সেন্টার এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ করছেন এবং তার মা’র সঙ্গে ধানমণ্ডি এলাকায় একটি ভাড়াবাড়িতে বসবাস করছেন।লতার বাবা লুৎফর রহমান, টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার থানার পাহাড়পুর গ্রামের একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি দুই বছর আগে মারা গেছেন। তার মা সুশীলা আখতার, ৫০, একজন গৃহিণী।

মামুন ছিলেন চার ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড়। তার এক ভাই ও দুই বোন। মামুনের বোন নাসরিন আখতার, ৩৩, ও আঁখি বেগম, ২৬, দুজনেরই বিয়ে হয়েছে। তারা রংপুর জেলায় স্বামীদের সঙ্গে বসবাস করেন।

ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম সবুজ, ২৪, পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। মামুন কয়েক বছর আগে ছোট ভাই সবুজকে ঢাকা নিয়ে যান। তিনিও বিয়ে করেছেন এবং গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করেন।মামুন মিয়ার বাবা আজগর আলী, ৬০, রাজধানীর একটি পাইপ তৈরির ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন। গত ১০ বছর ধরে তিনি পুরান ঢাকার একটি মেসে বসবাস করছিলেন। মামুনের মা তসলিমা বেগম, ৫৫, গৃহিণী। আদম বড়াইপাড়া গ্রামে মাত্র আট শতাংশ জমিতে একটি বাড়িতে বসবাস করেন।

মামুনের বাবা আজগর আলী বলেন, তিনি মামুনের লাশ নিয়ে আদম বড়াইপাড়া গ্রামে আসার পর থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।আজগর আলী কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমি আমার প্রিয় ছেলে মামুনকে হারিয়ে শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। আমি ঢাকা শহরে আমার কর্মস্থলে ফিরে যেতে পারছি না। আমি এখন শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েছি।’

মামুনের মা তসলিমা বেগম বলেন, ‘আমি আমার ছেলে মামুনকে হারিয়েছি। আমার স্বামী মানসিকভাবে অক্ষম হয়ে গেছেন এবং কাজ করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। আমি জানি না, মামুন ছাড়া আমরা কিভাবে বেঁচে থাকব।’

 মামুনের ছোট ভাই সবুজ জানান, মামুন ‘বিসমিল্লাহ ফ্যাশন’-এ ক্রেতাদের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে শার্ট, জার্সি, প্যান্ট, ট্রাউজার, শিশুদের পোশাক তৈরি করতেন এবং সেগুলো বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করতেন।বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই মামুন নিয়মিত ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ও মিটিং-মিছিলে অংশগ্রহণ করতেন। ৫ আগস্ট মামুন সকালে তার ‘বিসমিল্লাহ ফ্যাশন’ কারখানায় গিয়ে কাজ শুরু করেন।

দুপুর নাগাদ ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার পতনের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর মামুন ‘বিসমিল্লাহ ফ্যাশন’ কারখানা থেকে বের হয়ে ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিলে যোগ দেন।

‘মামুনের সঙ্গে আমিও মিছিলে যোগ দিই এবং আগারগাঁও এলাকায় যাই,’ সবুজ বলেন।কিন্তু সবুজ আগারগাঁও থেকে আর সামনে যাননি। তবে, মামুন বিশাল বিজয় মিছিলের সঙ্গে এগিয়ে যান। সে সময় মিরপুর-১ গোলচত্বরে ছাত্র-জনতা ও পুলিশের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। মিরপুর থানার সামনে পুলিশ নির্বিচারে কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ও ধাতব গুলি চালায়।

সবুজ জানান, ‘আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগীরা বিজয় মিছিলে হামলা চালায় এবং পুলিশ মামুনকে গুলি করে।’তিনি আরও বলেন, ‘আড়াইটার দিকে মামুনের বাম পিঠে একটি গুলি প্রবেশ করে এবং বাম বুক দিয়ে বেরিয়ে যায়। এরপর বিকেল সাড়ে তিনটায় ছাত্ররা তাকে মিরপুর-১০-এর অলোক হাসপাতালে নিয়ে যায়।’

কেউ একজন মামুনের মোবাইল ফোন থেকে কল দিয়ে এ খবর জানালে সবুজ ও মামুনের বন্ধু রাসেল সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে চলে যান।অলোক হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের পরামর্শে সবুজ মামুনকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।‘কিন্তু, পথে পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণের কারণে আমরা কোনো রকমে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে পৌঁছতে পারি। সেখানে বিকেল সাড়ে চারটায় ডাক্তার মামুনকে মৃত ঘোষণা করেন,’ সবুজ বলেন।

পরে ৬ আগস্ট মামুনের লাশ তার মাতৃভূমি আদম বড়াইপাড়া গ্রামে নিয়ে আসা হয় এবং সকাল ১০টায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।মামুনের স্ত্রী লতা জানান, স্বামী মামুন তাকে মে মাসে তার গ্রামের আদম বড়াইপাড়া নিয়ে যান, যাতে তিনি রংপুরের একটি ভালো হাসপাতালে সন্তান জন্ম দিতে পারেন।‘কিন্তু, জুলাই মাস থেকে আমি নিরীহ ছাত্রদের ওপর নির্যাতন, বিশেষ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ড দেখে অসুস্থ হয়ে পড়ি। এতে আমার গর্ভের সন্তান ক্ষতিগ্রস্ত হয়,’ তিনি বলেন।

পরে লতাকে আধুনিক মাল্টিকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনি সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে একটি মৃত কন্যা শিশুর জন্ম দেন।‘আমার সন্তান জন্মের আগেই হারিয়ে গেছে। আর স্বামী মামুনকে হারানোর পর আমি সবকিছু হারিয়েছি। আমি আমার স্বামীর হত্যার বিচার চাই,’ তিনি বলেন।এখন পর্যন্ত ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ মামুনের বাবা ও তার স্ত্রীর জন্য আড়াই লাখ টাকা করে দিয়েছে এবং জামায়াতে ইসলামী মামুনের বাবা ও লতাকে ১ লাখ টাকা করে দিয়েছে।এছাড়া, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন মামুনের পিতামাতাকে ১ লাখ টাকা এবং পীরগাছা উপজেলার ইউএনও ১০ হাজার টাকা দিয়েছেন।

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায় ।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.