ফিচার

স্বপ্ন পূরণ হলো না শহীদ বিপ্লবের

image 186974 1742785397
print news

ইত্তেহাদ অনলাইন নিউজ ডেস্ক :  স্বপ্ন ছিল চাকরি করে পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনবে, বাবাকে আর দিনমজুরের কাজ করতে দেবে না। অভাব-অনটনের সংসারে নিজে পড়াশোনা করতে পারেনি, তাই ছোট ভাইকে মানুষ করার ইচ্ছা ছিল তার। মাকে এসব কথা প্রায়ই ফোনে বলত বিপ্লব। কিন্তু সে স্বপ্ন আর পূরণ করা হলো না। বড় অসময়েই চলে যেতে হলো না ফেরার দেশে।

গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের চূড়ান্ত ছাত্র আন্দোলনের দিনে বিজয় মিছিলে অংশ নিতে গিয়ে আর বাড়ি ফেরা হয়নি বিপ্লবের। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে মারা যায় সে। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই শেষ হয়ে যায় তার জীবন।

একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে যেন পুরো পরিবারে নেমে এসেছে অন্ধকার। বিপ্লবের স্মৃতিকে স্মরণীয় রাখতে তার বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়া কদমতলী রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছে ‘শহীদ বিপ্লব সড়ক’।

যেভাবে প্রাণ হারাল বিপ্লব

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ৫ আগস্ট ছিল গণঅভ্যুত্থানের চূড়ান্ত দিন। সকাল থেকেই ছাত্র-জনতার দখলে ছিল গাজীপুরের মাওনা চৌরাস্তা। হাজারো জনতা পল্লী বিদ্যুৎ মোড়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন।

দুপুরের দিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পালানোর খবরে আনন্দ মিছিল বের হয়। সেদিন কারখানা বন্ধ থাকায় সহকর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেয় বিপ্লবও।

বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে বিজয় মিছিল যখন পল্লী বিদ্যুৎ মোড় এলাকা অতিক্রম করছিল, তখন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের লোকজনের উসকানিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এলোপাতাড়ি গুলি চালায়।

একটি গুলি বিপ্লবের চোখের সামনে ঢুকে মাথার খুলি ভেদ করে বের হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। বন্ধুরা গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে মাওনা আল-হেরা মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
পরের দিন ৬ আগস্ট সকালে জানাজা শেষে নিজ বাড়ি কদমতলীতে দাফন করা হয় বিপ্লবকে।

সুনসান নীরবতা বিপ্লবের বাড়িতে

সম্প্রতি সরেজমিনে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি উপজেলার বীরতারা ইউনিয়নের কদমতলী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে। বাড়ির সামনেই কবর করা হয়েছে বিপ্লবকে। কয়েকজন লোক তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে এসে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

কাঁচা টিনের ঘরে বসবাস করেন বিপ্লবের বাবা-মা ও পাঁচ বছরের ছোট ভাই। আব্দুল খালেক ও বিলকিস বেগম দম্পতির দুই ছেলের মধ্যে বিপ্লব ছিল বড়। বড় ছেলেকে হারিয়ে শোকে পাথর তারা।

মায়ের সঙ্গে শেষ কথা

বিপ্লবের মা বিলকিস বেগম বলেন, ‘সেদিন সকালে ছেলের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল। বিপ্লব বলল, ‘মা, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যাচ্ছি, আমার জন্য দোয়া করো।’ আমি বলেছিলাম, ‘আমরা গরিব মানুষ, এসবের দরকার নেই।’ তখন সে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, মা, আমি সাবধানে থাকব।’

এটাই ছিল আমাদের শেষ কথা। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে তার মোবাইল থেকে ফোন করে জানানো হয়, বিপ্লব গুলিতে মারা গেছে। সেদিন যানবাহন বন্ধ থাকায় আমরা তার লাশ আনতে যেতে পারিনি। রাত দুইটার দিকে বন্ধুরা অ্যাম্বুলেন্সে মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসে।’

স্বপ্নভঙ্গের বেদনা

বিলকিস বেগম বলেন, ‘বিপ্লব সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। অভাবের কারণে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেনি। বাবার কষ্ট দেখে এক বছর আগে গাজীপুরের শ্রীপুরে কাজ নিতে গিয়েছিল। সেখানে অল্প বেতনের চাকরি করত।

নিজের খরচ চালিয়ে প্রতি মাসে কিছু টাকা পাঠাত।এতে আমাদের সংসার মোটামুটি ভালোই চলছিল। কিন্তু এখন সব এলোমেলো হয়ে গেছে। কে চালাবে সংসার? কে থাকবে আমাদের পাশে?’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার ছেলেকে যারা গুলি করেছে, তাদের কঠিন শাস্তি চাই। সরকার যেন বিপ্লবকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয় এবং আমাদের পাশে থাকে।’

বাবা আব্দুল খালেকের আকুতি

বিপ্লবের বাবা আব্দুল খালেক বলেন, ‘সংসারের হাল ধরা ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে গেছি। সে সবসময় আমাদের খবর নিত। ছেলের শোকে ওর মা কাতর।

আমি সরকারের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি, আমাদের সহযোগিতা করা হোক। ছেলের হত্যার বিচার চাই। সবাই আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন ওকে শহীদের মর্যাদা দেন।’

সরকার ও রাজনীতিকদের প্রতিক্রিয়া

বিপ্লবের মৃত্যুর পর স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতারা তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কেন্দ্রীয় বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ফকির মাহবুব আনাম স্বপন (স্বপন ফকির) ৫০ হাজার টাকা এবং স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘সরকারি ও মানবিক সহায়তা ছাড়া সামনে চলা অসম্ভব। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ, যেন আমাদের সহায়তা দেওয়া হয়।’

প্রতিবেশীদের কথা

বিপ্লবের প্রতিবেশী ইকবাল হোসেন বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, অনিয়ম-অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিজয় মিছিলে গুলিতে শহীদ হয়েছে সে।

তার পরিবার মামলা করার চেষ্টা করলেও পারেনি। এই পরিবার খুবই নিরীহ ও দরিদ্র। বিপ্লবের বাবা এখন কাজ করতে পারেন না। আমরা আশা করি, সরকার তাদের পাশে দাঁড়াবে।’

প্রশাসনের বক্তব্য

ধনবাড়ী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ধনবাড়ি উপজেলার দুইজন নিহত ও সাতজন আহত হয়েছে। আমরা প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছি।

সরকার ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, নিহতদের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা করে দেওয়া হবে। অনুমোদন হলে বিপ্লবের পরিবারও তা পাবে।

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায় ।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.