বরিশাল বিভাগে ভূয়া ৪ সাব রেজিস্ট্রার লোপাট করেছে ৫০০ কোটি টাকা,নামে বেনামে গড়েছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়


সজীব আকবর, সিনিয়র প্রতিবেদক:
বরিশাল বিভাগে ভূয়া ৪ সাব রেজিস্ট্রার এখনো দুর্দান্ত দাপটে তাদের ঘুষ দুর্নীতি আর দলিল বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন বহাল তবিয়তে। এদের সকলের জন্মসনদ অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বয়স ছিলো ৩ থেকে ৬ বছর। তথাপিও এরা টাকার জোরে মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী পরিচয়ে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষা সনদ দিয়ে বাগিয়ে নিয়েছেন সাব রেজিস্ট্রারের লোভনীয় চাকরি। নামে বেনামে গড়েছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। করেছেন মানি লন্ডারিংয়। এদের প্রায় প্রত্যেকেই এসব অবৈধ পথে উপার্জিত কালো টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করেছেন, কোলকাতা, দুবাই ও অস্ট্রেলিয়ার টরেন্টোর বেগম পাড়াতে।
এই ভূয়া সাব রেজিস্ট্রার এর মধ্যে বরিশাল বিভাগ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ৪ জন। এরমধ্যে আছেন পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায় কাজী নজরুল ইসলাম, বরিশাল সদরে অসীম কল্লোল, ভোলার লালমোহনে মঞ্জুরুল ইসলাম ও পটুয়াখালী সদরে মোহাম্মদ ফারুক।
এই ৪ জন ভূয়া সাব রেজিস্ট্রার সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব বঞ্চিত করে ঘুষ দুর্নীতি আর জাল দলিল বাণিজ্য সম্পাদন করে লুটে নিয়েছেন প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। ইতোমধ্য এরা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা। আর দেশের মধ্যে প্লট, ফ্লাট, কৃষি জমি, একাধিক গাড়ি, মাঠাল সম্পত্তি ও গ্রামের বাড়িতে উঠিয়েছেন বিলাসবহুল আলিশান বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মাছের ঘের প্রভৃতি।
তবে দেশের অভ্যন্তরের এসব সম্পদ তারা ক্রয় করেছেন স্ত্রী সন্তান শ্যালক শ্যালিকা শ্বশুর শ্বাশুড়ি ভাই বোন ও বাবা-মায়ের নামে। সরকারকে ধোকা দিতে এরা নিজ নিজ নামে খুলেছেন আইকর ফাইল।
এই ৪ ভূয়া সাব রেজিস্ট্রারের সংক্ষিপ্ত উপাখ্যান
খেপুপাড়ার কাজী নজরুল ইসলাম
খেপুপাড়া পটুয়াখালীর ভূয়া সাব রেজিস্ট্রার কাজী নজরুল ইসলাম এখনো বহাল তবিয়তে রামরাজত্ব চালিয়ে যাচ্ছেন। তার কাছে আছে নামে বেনামে শতকোটি টাকার অবৈধ সম্পদের পাহাড়।
১৯শে ফেব্রুয়ারি ২০২৫ আইজিআর মোঃ নূর ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বদলি আদেশে দিনাজপুরের চিরিরবন্দর থেকে তাকে এই পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায় বদলি করা হয়। খেপুপাড়ার সাব-রেজিস্ট্রার কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১৯৬৭ সালের ২রা এপ্রিল হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় মাত্র ৩ বছর ১০মাস বয়স ছিল তার। তারপরও তিনি অবৈধ টাকা ঘুষ দিয়ে বাগিয়ে নেন মুজিবনগর সরকারের কর্মচারীর পদ পদবী। আর রাতারাতি বনে যান ভূয়া শিশু মুক্তিযোদ্ধা। এখানেই শেষ নয়। এরপর ভূয়া শিক্ষা সনদ আর ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদের বদৌলতে মোটা অংকের টাকা লগ্নী করে তিনি বাগিয়ে নেন ভূয়া সাব রেজিস্ট্রারের লোভনীয় পদ।
শুধু কাজী নজরুল ইসলামই নন, এখনো ৩৬ ভূয়া সাব রেজিস্ট্রার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দুর্দান্ত দাপটে প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন আর সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। ভূয়া সাব রেজিস্ট্রার কাজী নজরুল ইসলামসহ এদের অনেকের বিরুদ্ধেই রয়েছে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ।। তবে এদের অধিকাংশই এই বছরে অবসরে চলে যাবেন।
পতিত আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত মুজিবনগর সরকারের কথিত কর্মচারীদের মধ্যে আছেন পটুয়াখালী সদরের মোহাম্মদ ফারুক, বরিশাল সদরের অসীম কল্লোল,ভোলা লালমোহনের সাব-রেজিষ্ট্রার মোঃ মঞ্জুরুল ইসলাম, রাজধানীর ধানমন্ডির মো: আবুল হোসেন, কিশোরগঞ্জ সদরের মিনতী দাস, মিনতী দাসের স্বামী সদ্য রিটায়ার্ডপ্রাপ্ত সাব রেজিস্ট্রার পরিতোষ দাস, গাজীপুর টঙ্গীর আবু হেনা মোস্তফা কামাল, বাগেরহাট মোংলার স্বপন কুমার দে, গাজীপুর সদর থেকে সদ্য এলপিআরে যাওয়া সাব রেজিস্ট্রার জাহাঙ্গীর আলম ও গাজীপুর কালিয়াকৈর থেকে এলপিআরে যাওয়া সাব রেজিস্ট্রার নুরুল আমিন তালুকদার, রাজধানীর উত্তরা থেকে সদ্য বদলিকৃত সাব রেজিস্ট্রার লুৎফর রহমান মোল্লা, নরসিংদী সদরের সোহরাব হোসেন,
নারায়ণগঞ্জ রূপগঞ্জের সাবেক সাব রেজিস্ট্রার রাউজানের আবু তাহের মো. মোস্তফা,নোয়াখালীর চাটখিলের মো. আবুল বাশার,ফেনী সদরের বোরহান উদ্দিন সরকার,নওগাঁ মহাদেবপুরের রফিক উদ্দিন,নওগাঁর নিয়ামতপুরের মুক্তিয়ারা খাতুন,রংপুর সদর থেকে সদ্য বোদা পঞ্চগড়ে বদলি হয়ে বর্তমানে রংপুর পীরগাছার সাব রেজিস্ট্রার রাম জীবন কুন্ডু, ভোলার লালমোহন থেকে সদ্য বদলি হওয়া সাব-রেজিস্ট্রার রফিকুল ইসলাম,২০২৪ সালে মেহেরপুরের জেলা রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত মো. আকবর আলী,কিশোরগঞ্জ জেলা রেজিস্ট্রার শফিকুল ইসলাম ।এঁরা সকলে খোশমেজাজে বহালতরিয়াতে রয়ে গেছেন সকল ধরা ছোঁয়ার বাহিরে।
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ, ভুয়া শিক্ষার সনদ ও বয়স জালিয়াতি করে সাব-রেজিষ্ট্রার পদে চাকুরী হাতিয়ে নেন উল্লিখিত মহা দুর্নীতিবাজ ৩৬ সাব রেজিস্ট্রার। এই ৩৬ জনের মধ্যে পদোন্নতি পেয়ে আকবর আলী ও শফিকুল ইসলাম হয়েছেন জেলা রেজিস্ট্রার।
চাকুরীতে যোগদানের পরে ঘুষ দুর্নীতি আর দলিল বাণিজ্যে লিপ্ত হয়ে এরা সকলেই এখন কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। দূর্নীতি দমন কমিশন দুদকে অনেকেই হাজিরা দিচ্ছেন আবার অনেকেই পতিত সরকারের আমলে দুদকের অসৎ কর্মকর্তাদেরকে কালো টাকায় ম্যানেজ করে তাদের অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়ে গেছেন মর্মে জানা গেছে গোপন সূত্রে।
ভূয়া সাব রেজিস্ট্রার কাজী নজরুল ইসলাম তার চাকরিজীবনের শুরু থেকেই তাঁর কর্মস্থলগুলোতে নিজেকে মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী, মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা পরিচয় দিয়ে নিজস্ব ক্ষমতার বলয় সৃষ্টি করে কর্মস্থলগুলোতে গড়ে তুলেছেন শক্তিশালি সিন্ডিকেট। এছাড়া জুলাই-আগস্ট ২০২৪ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমন করতে কতিপয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাদের সাথে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকতেন মধ্যরাত পর্যন্ত। এছাড়া ছাত্র আন্দোলন দমন করতে কতিপয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাদের মাঝে মোটা অংকের টাকা লগ্নী করেন ভূয়া সাব রেজিস্ট্রার কাজী নজরুল ইসলাম।
প্রভাবশালী এসব কর্মকর্তা পদায়ন বাগিয়েছেন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে।
সূত্রে জানা যায়, স্বৈরাচার আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিষ্টার শফিকুর রহমান ও প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম কয়েক কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ও ভূয়া শিক্ষা সনদে চাকুরী পাইয়ে দেন এই সকল সাব-রেজিষ্ট্রারদেরকে। এদের নিয়োগের তালিকা অনুযায়ী ১৯৬৭, ১৯৬৬, ১৯৬৫ সালে জন্মতারিখ আছে এমন সংখ্যা ছিল অনেক। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধকালে তাদের বয়স ছিল ৪ থেকে ৬ বছর। জালিয়াতির মাধ্যমে এ নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া নিয়ে তৎকালীন নিবন্ধন অধিদপ্তরসহ আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যেও তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ তৈরি হয়েছিলো বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইজিআর অফিসে একাধিক কর্মকর্তা সংবাদ মাধ্যমকে নিশ্চিত করেন।
সর্বশেষ ২০২০ সালের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া ব্যক্তির সংখ্যা ৬৭০ জন। এই মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিপ্রাপ্তদের বেশিরভাগই ভুয়া বলে অভিযোগ ছিল শুরু থেকেই। নিয়োগের কিছুদিন পরই নিয়োগপ্রাপ্তরা ভুয়া, তাদের অনেকেই মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী নন এবং মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে তারা যে সার্টিফিকেট প্রদান করেছেন, তাও ভুয়া এমন অভিযোগ ওঠে।
এই অভিযোগ তদন্তে আইন মন্ত্রণালয় থেকে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এরপর ২০১১ সালের জুন মাসে মুজিবনগর সরকারের কর্মচারীর ভুয়া পরিচয়ে চাকরি নেওয়া ১৬ জন সাব-রেজিস্ট্রারকে বরখাস্ত করে নিবন্ধন অধিদপ্তর। পরে তারা ফের হাইকোর্টে রিট করে আইনের ফাঁক গলে চাকরিতে ফিরে আসেন বলে সূত্র জানায়।
লালমোহন সাব রেজিষ্ট্রার মঞ্জুরুল ইসলাম
০৭-১২-২০০৯ সালে মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী নামধারী মঞ্জুরুল সাব রেজিষ্ট্রার হিসাবে চাকরী পেয়ে যান ভুয়া শিক্ষা ও মুক্তিযোদ্ধা সনদে। চাকুরী শুরু হতে তজিমুদ্দিন ভোলা, আমতলী বরগুনা, মটবাড়ীয়া, পিরোজপুর, লক্ষীপাশা, নড়াইল, সোনাইমুড়ি, নোয়াখালী, বগুড়া সদর, গাইবান্ধা সহ পরবর্তীতে ঢাকা জেলা কালামপুর সাব-রেজিষ্ট্রি অফিস ঘুরে এখন আবার লালমোহন ভোলার সাব রেজিস্ট্রার হিসেবে লুটপাট আর দলিল বাণিজ্য অব্যহত রেখেছেন।
চাকুরী জীবনে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বনে গেছেন শত কোটি টাকার মালিক। লীগ সরকারের আমলে দাপিয়ে বেড়ানো সাব-রেজিষ্ট্রার মঞ্জুরুল ইসলাম এখন ভোল পাল্টে হয়ে গেছেন বিএনপি পন্থী নেতা। চলতি বছরের ১৫-০৬-২০২৫ সালে অবসরে যাবেন তিনি, যে কারণে ঢাকার ধামরাই কালামপুরের স্ট্যাইলে বেপরোয়া হয়ে ঘুষ দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছেন লালমোহন সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসকে।
কালামপুর সাব-রেজিষ্ট্রি অফিসে চাকরিকালীন সময়ে মঞ্জুরুল ইসলাম ও নকলনবিশ পারুল সিন্ডিকেট একচ্ছত্র আধিপত্য ও দূর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। সাব-রেজিষ্ট্রার ও নকল নবিশ পারুল গং ২০২৪ সালে ১৩৪৬, ৭৫২, ১০৮৬, ১১৫৬, ২১৩৭ নং দলিলগুলো থেকে ব্যাপক ঘুষ দুর্নীতির মাধ্যমে মোটা অংকের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে নিজেদের পকেট ভারী করেছেন সাব-রেজিষ্ট্রার মোঃ মঞ্জুরুল ইসলাম ও নকল নবিশ পারুল আক্তার। অল্প কিছুদিনের ভিতরে অবসরে যাবেন বলে বেপরোয়া হয়ে ঘুষ, বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। ধামরাই কালামপুরের দলিল লেখক সমিতির দুজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নারী কেলেঙ্কারীতেও পিছিয়ে নেই সাব-রেজিষ্ট্রি মোঃ মঞ্জুরুল ইসলাম।
সূত্র মতে চাকুরী প্রাপ্ত সময় ভুয়া শিক্ষা সনদ (বিএ পাস) এর সার্টিফিকেট দিয়ে সাব-রেজিষ্ট্রার পদ বাগিয়ে নেন তিনি। সাব-রেজিষ্ট্রার মোঃ মঞ্জুরুল ইসলাম এর জন্ম ১৯৬৬ সালের ১৬ জুন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স ছিল মাত্র ৪ বছর ৯ মাস। মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত অধিকাংশ সাব রেজিস্ট্রার ৪ থেকে ৬ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন?? ওই বয়সের দুধের শিশুরা কিভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন এবং কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছিলেন তার কোন সদুত্তর অভিযুক্ত সাব রেজিস্ট্রারদের কেউই দিতে পারেননি।
পটুয়ায়াখালী সদরের মোহাম্মদ ফারুক
পটুয়াখালী সদরের মো. ফারুক, জন্ম ১৯৬৮ সালের ২৫শে মে। ভোটার আইডি কার্ড ও তার জন্ম নিবন্ধন অনুযায়ী মোহাম্মদ ফারুক একজন আড়াই বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকা ফারুক বিতাড়িত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে অর্থের বিনিময়ে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ ম্যানেজ করে বনে যান মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী। এরপর এই ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদের বদৌলতে বাগিয়ে নেন সাব রেজিস্ট্রার পদে লোভনীয় চাকরি। সাব রেজিস্ট্রার হিসেবে যোগদান করে হাতে পেয়ে যান আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ। এরপর থেকে দ্রুত বদলে যেতে থাকে ভাগ্যের চাকা। নামে বেনামে গড়ে তুলেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়।
জুলাই আগস্ট ২০২৪ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমাতে সাব রেজিস্ট্রার ফারুক ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাদের সাথে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকতেন এবং ছাত্র আন্দোলন দমন করতে মোটা অংকের টাকা লগ্নী করেন বলেও পটুয়াখালী সদরে জনশ্রুতি রয়েছে।
বরিশাল সদরের অসীম কল্লোল
বরিশাল সদরের সাব রেজিস্ট্রার অসীম কল্লোল ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও ভূয়া শিক্ষা সনদে চাকরী করে বেশুমার লুটপাট আর জাল দলিল সম্পাদন করে এখন শত শতকোটি টাকার মালিক।।
বরিশাল সদর সাব-রেজিস্ট্রার অসীমের অবৈধ সম্পদের পাহাড়, দেখার কেউ নেই
বরিশাল সদর উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার অসীম কল্লোল। সর্বশেষ সরকারি বেতন স্কেলে নবম গ্রেডের কর্মকর্তা তিনি। ৩৪ বছর ধরে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন পদে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে সাব-রেজিস্ট্রার পদে বরিশাল সদর উপজেলায় কর্মরত। নবম গ্রেডের সর্বোচ্চ বেতনের হিসাব ধরলে ৩৪ বছর চাকরি জীবনে তার আয় আড়াই কোটি টাকার বেশি নয়। কিন্তু অসীম কল্লোলের বরিশাল ও ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় নামে-বেনামে রয়েছে শতকোটি টাকার বেশি সম্পদ। এমনকি তার স্ত্রী সন্তানদের রয়েছে বাড়ি গাড়ি। সাব-রেজিস্ট্রার পদে চাকরি করে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়ার উৎস খতিয়ে দেখার দাবি জানিয়েছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
এদিকে বরিশাল সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে যোগদানের পর থেকে অসীম কল্লোলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম এবং ঘুষ গ্রহণসহ নানা অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে আগেও কয়েকবার বিভিন্ন গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন তিনি।
এর মধ্যে রয়েছে বরিশাল সদর উপজেলায় ১ একর ২৫ শতাংশ জমির ওপর সোনার বাংলা মৎস্য খামার ও অ্যাগ্রো ফার্ম নামে একটি প্রতিষ্ঠান। সদর উপজেলার কাগাসুরা মুকুন্দপট্টি রাস্তার দুই পাশে ৮০ শতাংশ জমির ওপরে সুগন্ধা অ্যাগ্রো অ্যান্ড ফিশারিজ নামে মাছের ঘের। কাগাসুরা বাজারসংলগ্ন এক একর জমির ওপরে মালটা বাগান, নগরীর ৪নং ওয়ার্ড ১২ শতাংশের একটি প্লট। লাকুটিয়া এলাকায় ২০ শতাংশ জমির ওপরে সুগন্ধা পোলট্রি খামার নামে মুরগির ফার্ম, নগরীর পোর্ট রোডে ৫ তলার ভবন। নগরীর হাসপাতাল রোডে অগ্রণী হাউজিং লিমিটেডের ‘ড্রিম প্যালেসে’ কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট (ফ্ল্যাট নং-৩/এ)।
এ ছাড়া পরিবারের সদস্যদের চলাচলের জন্য রয়েছে ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৩-৬৪৮১ নম্বরের টয়োটা ব্র্যান্ডের গাড়ি। স্ত্রীর নামে সদর উপজেলার তালতলী বাজারে ইট, বালু ও রড-সিমেন্টের ব্যবসা। তার ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন অসীম কল্লোল এলাকায় চাকরি করেছেন সেসব এলাকায় কিনেছেন জমি ও ফ্ল্যাট। তার এসব সম্পত্তির বর্তমান বাজার মূল্য রয়েছে শতকোটি টাকার ওপরে।
সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সাবেক সভাপতি প্রফেসর শাহ সাজেদা বলেন, ‘সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন স্কেল অনুযায়ী একজন সাব-রেজিস্ট্রার ৯ম গ্রেডের বেতন প্রাপ্ত হন। ২২ হাজার থেকে শুরু করে চাকরির শেষ সময়ে এসে মাসে সর্বোচ্চ বেতন দাঁড়ায় ৫৩ হাজার ৬০ টাকায়। সর্বশেষ বেতন অনুযায়ী ৩৪ বছর চাকরি জীবন হিসাব করলে ২ কোটি ১৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকা আয় করেছেন তিনি।’
সেই আয় দিয়ে সংসার পরিচালনা, ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনাসহ আনুষঙ্গিক খরচ মিটিয়ে লাখ দশেক টাকার বেশি সম্পদ গড়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তবে সাব-রেজিস্ট্রার অসীম কল্লোল এবং তার পরিবারের যে সম্পদের কথা শোনা যায় তার মূল্য রয়েছে শতকোটি টাকার বেশি, যা আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
একজন সাব-রেজিস্ট্রারের এত সম্পত্তির উৎস সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের খতিয়ে দেখা দরকার।
কাগাসুরা এলাকার বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘কাগাসুরার মুকুন্দপট্টি সুগন্ধা অ্যাগ্রো অ্যান্ড ফিশারিজ, বাজারসংলগ্ন মালটা বাগান, লাকুটিয়া এলাকায় সুগন্ধা পোলট্রি খামার নামে মুরগির ফার্ম, সদর উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রারের বলে আমরা জানি। ওই বাগান দেখাশোনার জন্য একজন লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’
সুগন্ধা অ্যাগ্রো অ্যান্ড ফিশারিজ ও মালটা বাগান দেখভালের দায়িত্বে থাকা আসমত আলী খান বলেন, ‘আমি যতদূর জানি মালটা বাগান ও মাছের ঘের ও তার জমির মালিক সাব-রেজিস্ট্রার। তিনি মাঝেমধ্যে এখানে এসে ঘুরে যান। এ ছাড়া এই এলাকায় তার আরও কয়েকটি জমি রয়েছে বলে শুনেছি।’
তালতলী এলাকার বাসিন্দা আবদুল মান্নান বলেন, ‘এই বাজারে ইট, সিমেন্ট ও বালু বিক্রির প্রতিষ্ঠানের মূল মালিক সাব-রেজিস্ট্রার কল্লোল। তবে কাগজে-কলমে এই প্রতিষ্ঠানের মালিক তার স্ত্রী।’
এ বিষয়ে অসীম কল্লোল বলেন, ‘বরিশাল সদর উপজেলার কাগাসুরায় আমার কোনো জমি নেই। সেখানে সম্বন্ধি (স্ত্রীর বড় ভাই) গোলাম রাব্বানীর নামে ৬০ শতক জমি আছে। তিনি ময়মনসিংহ জেলায় থাকেন। তার অসুস্থতার কারণে ওই সম্পত্তি আমি দেখাশোনা করি। নগরীর উত্তর মল্লিক রোড এলাকায় ড্রিম প্যালেস নামে ৯১০ ফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। পোর্ট রোড এলাকায় সরকারি খাস জমিতে ৫তলা ভবন নির্মাণের অভিযোগ সত্য নয়। ওই এলাকায় আমার বাবার নামে একটি বাড়ি আছে। যেখানে আমরা ৪ ভাই একসঙ্গে থাকি।’
তবে ঢাকায় দুটি ফ্ল্যাট থাকার সত্যতা স্বীকার করে অসীম কল্লোল বলেন, ‘ডিবিএইচ থেকে ৮৫ লাখ টাকার লোন নিয়ে দুটি ফ্ল্যাট কিনেছি। এ ছাড়া সদর উপজেলার শায়েস্তাবাদে ১ একর ২৫ শতাংশ জমি স্ত্রীর নামে রয়েছে, যা হেবা দলিল মূলে কেনা হয়েছে। এর বাইরে আমার এবং আমার পরিবারের কোনো সম্পদ নেই। ইনকাম ট্যাক্স ফাইলে হিসাব দেওয়া আছে।’
তিনি আরও বলেন, বরিশাল সদর উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে যোগদানের পর এখানকার কিছু অসাধু দলিল লেখক এবং অফিসের কিছু কর্মচারী আমার কাছ থেকে অবৈধ সুযোগ নিতে চেয়েছে। আমি তাদের কথামতো কাজ না করায় ওই চক্রটি বিভিন্নভাবে আমাকে হয়রানি ও হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।