অনিশ্চিত অবস্থায় পতিত আওয়ামী লীগ


আলম রায়হান: নির্বাচন নিয়ে নানান বয়ান চালাচালি চলমান। অনেকটা আজম খানের পপ গানের মতো, ‘আলাল যদি ডাইনে যায়, দুলাল যায় বাঁয়ে/ তাদের বাবা সারাদিন খুঁজে খুঁজে মরে।’ যেমন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্রমাগত বলে যাচ্ছেন, ‘যদি রাজনৈতিক দলগুলো স্বল্প সংস্কার প্রক্রিয়ায় একমত হয়, তবে ডিসেম্বরেই নির্বাচন হতে পারে। যদি বৃহত্তর সংস্কার পথ বেছে নেওয়া হয়, তাহলে নির্বাচন জুনে অনুষ্ঠিত হতে পারে।’ ড. ইউনূস একই কথা ঘটা করে বলেছেন ১৬ এপ্রিল দেখা করতে যাওয়া বিএনপির নেতাদের। বৈঠক থেকে বের হয়ে প্রতিক্রিয়ায় মির্জা ফখরুল হতাশার কথা প্রকাশ করেছেন। সরকারপ্রধানের সঙ্গে প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টার বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সুনির্দিষ্ট ডেটলাইন না পাওয়ায় সন্তুষ্ট নয় বিএনপি।’ ভাবখানা এই— রাজনীতিকদের সন্তুষ্ট করতেই যেন সরকারে বসে আছেন কতিপয় রাজনীতিবিমুখ ব্যক্তিত্ব! প্রসঙ্গত, ৯ এপ্রিল নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেছেন, ‘আগামী ডিসেম্বরকে টাইমলাইন ধরেই নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ভোটার তালিকা তৈরির কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে।’ লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যেও ‘প্রায়’ শব্দটি দাপটের সঙ্গে বিরাজমান। এদিকে ১০ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘ওই রাস্তা থেকে আমারে বলতেছিল, আপনারা আরও পাঁচ বছর থাকেন।’ সাধারণভাবে বোধগম্য নয়, নির্বাচন প্রশ্নে লম্বা সময়ের ধোঁয়াশার মধ্যে থেকেও প্রধান উপদেষ্টা কেন ‘হতে পারে’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেন। আর রাস্তার লোক কী বলে না বলে তা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কর্ণকুহরে মধুর বচন হয়ে মুখে কেন আসে! হতে পারে, তিনি কিশোরকালে কায়কোবাদের সেই অমর কবিতাটি বেশি পড়েছেন।
“কে ওই শোনাল মোরে আযানের ধ্বনি।/
মর্মে মর্মে সেই সুর, বাজিল কি সুমধুর/
আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী।/
কি মধুর আযানের ধ্বনি!”
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন, কবির গভীর বয়ান আর রাস্তার লোকের চৈতালী বচনের মধ্যে ফারাক আসমান জমিন। আর তিনি শুধু ক্ষমতাবিষয়ক কথা শোনেন কেন? রাস্তার লোক তো আরও অনেক কিছুই বলে! তা কি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা শুনতে পান না? না পেলে জনপ্রিয় গায়ক মানোর গাওয়া সিনেমার সেই গানটি তার জন্য, ‘ও বন্ধু তুমি শুনতে কি পাও…।’ পাবলিকের মূল গান হচ্ছে, নির্বাচন এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কি শুনতে পান না, দেশে চরম মাত্রায় চাঁদাবাজি ও মব সন্ত্রাস চলছে? এ অবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে দায়িত্বশীলদের নানান ধরনের বচন সংশয় ও জনবিরক্তি সৃষ্টি করে। এর সঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঁচ বছরের জন্য রেখে দেওয়ার বায়বীয় বয়ান আসলে স্বস্তির কোনো বার্তা দেয় না। বরং অনিশ্চয়তার পালে দেয় জোর হাওয়া। মনে রাখতে হবে, আজম খানের পপ গানের আলাল ও দুলালের বাবা হাজি চান, ভোটের বাবা কিন্তু জনগণ। তারা নির্বাচন খোঁজে। অবশ্য এ নির্বাচন অনুষ্ঠান সহজ কোনো কাজ নয়। এর নানান কারণও আছে। প্রধান হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রশ্নে দেশের রাজনীতির চরম বিভক্তি। নির্বাচনী রাজনীতির ইকোয়েশনে এরই মধ্যে পতিত আওয়ামী লীগের কালো ছায়া স্পষ্ট। আর ৫ আগস্টের মূল বেনিফিশিয়ারি বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টি ত্রিভূজের তিন কোণে গাঁট হয়ে আছে। তবে রাজনীতির প্রধান দুই টাইকুন বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে রংধনু দেয়াল সম্প্রতি অপসারিত হয়েছে বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে করা হচ্ছে। আবার কারও মতে, এ পরিবর্তন আসলে অপসারিত দানবীয় শক্তির আগমনী বার্তা জানান দেয়, যা নির্বাচন প্রশ্নে অনেক প্যারামিটার বেশ জটিল করে তুলেছে!
এরপরও সাধারণভাবে বলা হয়, পরিবেশ-পরিস্থিতি যাই হোক, বিএনপি সংসদ নির্বাচনের জন্য উতালা, কিশোর প্রেমিকের মতো। সাবেক শাসক দলটি ক্ষমতায় আসার জন্য অধির অপেক্ষায় আছে। এ ক্ষেত্রে সংসদ নির্বাচন শুধু আনুষ্ঠানিকতা বলে বিবেচনা করছেন সাবেক শাসক দলটি। কারও কারও বিবেচনায় ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগের মতো বিএনপি এখন নিশ্চিত, নির্বাচন মানে ক্ষমতায় যাওয়ার লাইসেন্স পেয়ে যাওয়া। কিন্তু ইতিহাস বলে, ৯১ সালে আশাহত হয়েছিল আওয়ামী লীগ। আগামী নির্বাচনে বিএনপির জন্য আসলে কোন প্রাপ্তি অপেক্ষা করছে সেটি সময়ই বলে দেবে। তবে এখন এটুকু বলা চলে, তৃণমূলে ছ্যাচড়া তথা ছোটখাটো দখলবাণিজ্যে বিএনপি এরই মধ্যে যে অবস্থায় পৌঁছেছে, তাতে এই দলটির অবস্থা মাঠে বেশ নড়বড়ে হয়ে গেছে। অভ্যন্তরীণ হানাহানিতে রক্ত ও প্রাণ ঝরছে। দখলবাণিজ্যের অপরাধে অনেককে দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও কাজের কাজ তেমন কিছু হচ্ছে বলে মনে হয় না। তবে অনেকেই মনে করেন, তারেক রহমান দেশে ফিরলে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু ততদিনের বিএনপির ইমেজ আরও কতদূর নামবে তা বলা কঠিন। এখনই কিন্তু মানুষ আওয়ামী লীগ আর বিএনপিকে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ ভাবতে শুরু করেছে। এ কথা বলেও চুপেচাপে। এমনও কেউ কেউ বলেন, মাঠের চাঁদাবাজিতে পতিত আওয়ামী লীগকে ছাড়িয়েছে বিএনপি।
এদিকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দৃঢ়ভিত্তির বড় ফ্যাক্টর জামায়াতের লক্ষ সাধারণ দৃষ্টিতে দোদুল্যমান। এই দলটির অবস্থা অনেকটা ভানু বন্দ্যোপাধ্যয়ের কৌতুক নকশার ট্যারা স্ট্রাইকারের মতো। জামায়াত কোন দিকে তাকায় আর কোন দিকে গোল দেয় তা আঁচ করা মুশকিল। অনেকেই বলেন, গভীরের কোনো বিষয়ে আর জামায়াতের গতিপথ বিষয়ে ধারণা করা কঠিন। যেমন আস্তিনের আড়ালে লুকানো কোনো কিছুর বিষয়ে আঁচ করা সহজ নয়। কারও কারও মতে, জামায়াতের নানান মৌলিক উদ্দেশ্যের একটি হচ্ছে, দীর্ঘ সময়ে রাজনীতির অথৈ পাথারে খড়কুটো অথবা কলাগাছের ভেলা বিএনপিকে হীনবল করা। আর এজন্য জামায়াতকে বিশেষ কিছু করতে হবে না। নির্বাচনের আগের সময়সীমা দীর্ঘ হলেই চলবে। সাধারণভাবে বলা হচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে জামায়াতের আসলে কোনো মাথাব্যথা নেই। কারণ, জামায়াতের বাস্তবতা আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির চেয়ে অনেক ভিন্ন। এই দলটির জন্য জরুরি হচ্ছে, রাজনীতির মাঠ। তা হোক উর্বর অথবা ঊষর। যে মাঠ এখন খুবই উর্বর। বরিশালে একটি কথা প্রচলিত, ‘খালে পানি আছে, কাম সাইরা ল; ভাত খাইস পরে!’ এটি স্পষ্ট, নির্বাচনের আগে যত সময় যাবে শক্তিশালী জামায়াত ততই আরও শক্তিশালী হবে। একেবারে ইনক্রিডিবল হাল্ক। আর ইসরায়েলকে যে পরাশক্তি দানব বানাতে পারে সেই আমেরিকা বাংলাদেশের কোনো দলকে পালোয়ান বানাতে পারবে না, তা তো নয়! প্রসঙ্গত, জামায়াত আমেরিকার দ্বারা ‘মডারেট মুসলিম শক্তি’ খেতাবপ্রাপ্ত। এরপরও কথা আছে, এই দলের নিবন্ধন ও প্রতীক এখনো ঝুলে আছে। আর চাঁদের কলঙ্ক হয়ে আছে দলটির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহার এখনো মৃত্যুদণ্ডের পরোয়ানা কারাগারে থাকার বিষয়টি।
এদিকে শেখ হাসিনা-পরবর্তী দেশে বিএনপি ও জামায়াত সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে হঠাৎ করেই কাছাকাছি আসছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। লন্ডন বৈঠকের পর নির্বাচন নিয়ে বিপরীতমুখী অবস্থান থেকে প্রধান দল দুটি এখন প্রায় একই সুরের ধারায় আছে। নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় প্রশ্নে সম্প্রতি জামায়াত-বিএনপির কাছাকাছি বক্তব্যকে ‘অনেক বৃষ্টি ঝরে তুমি এলে,/যেন একমুঠো রোদ্দুর আমার দুচোখ ভরে,/ তুমি এলে’—রুনা লায়লার গাওয়া অনবদ্য এ গানটি যেমন মনে করিয়ে দেয় তেমনই স্মরণ করায়, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। তবে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, একই বৃন্তের দুটি ফুল জামায়াত-বিএনপির অবস্থান ৫ আগস্টের পর ছিল এক ধরনের ইলিউশনের ছদ্মাবরণে। কারও কারও মতে, ড. ইউনূসকে পরিমাপে বিএনপির বেশ বিলম্ব হলেও জামায়াত চিনেছে শুরুতেই। তবুও বিষ হজম করে আছে। যেমন সর্প দংশনের পরও স্থির ছিল মহাভারতের কর্ণ।
আর কিংস পার্টির আদলে ছাত্রদের দল হিসেবে ট্যাগ লাগানো জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নির্বাচন প্রশ্নে আছে উল্টো রথে। শুরুতে বলা হতো, ঘর গোছানোর জন্য তাদের সময় প্রয়োজন। কিন্তু সময় পেলে এনসিপি ঘর গুছিয়ে কতটা শক্তিশালী হতে পারবে তা নিয়ে নানান সংশয় ছিল আগেই। রাষ্ট্রের তরফ থেকে যথেষ্ট গুরুত্ব পেলেও এই দলটি খুব একটা এগোতে পারেনি। বরং অনেকেই মনে করেন, জয়নুল আবেদিনের শিল্পকর্ম ‘কাদায় আটকে পড়া গরুর গাড়ির’ দশায় আছে জাতীয় নাগরিক পাটি। শিল্পাচার্যের উল্লিখিত ছবি দেয়ালের শোভাবর্ধন করলেও অন্যরকম বাস্তবতারও জানান দেয়। ১৬ এপ্রিল মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মৌলিক সংস্কার ছাড়া নির্বাচনের আয়োজন করা হলে তাতে অংশ নেবে কি না সে বিষয়টি বিবেচনাধীন। এ বিষয়ে অভিজ্ঞ মহল মনে করে, বিলম্বে হলেও নতুন দলটির অতি নবীন নেতারা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন, গ্যাস বেলুনে ভর করে চূড়ার ওঠা গেলেও পাহাড় টলানো যায় না। আর বলাই তো হয়, ‘পাহাড় ডিঙানো ল্যাংড়ার কম্ম নয়!’
অনেকের বিবেচনায় সবচেয়ে অনিশ্চিত অবস্থায় আছে পতিত আওয়ামী লীগ। জনরোষে ৫ আগস্ট পতিত এই দলটি দেশের রাজনীতির বলয়ের বাইরে চলে গেছে। এরপরও রবিঠাকুরের ছোটগল্পের সূত্রের আদলে আছে, ‘হইয়াও হইলো না শেষ।’ আবার শেখ হাসিনার অবস্থা অদ্ভুতভাবে মিলে যায় ছুটি গল্পের কিশোর ফটিকের জীবন সায়াহ্নের সংলাপের সঙ্গে, ‘এক বাও মেলে না। দো বাও মেলে-এ-এ না।’ ছুটি গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘কলিকাতায় আসিবার সময় কতকটা রাস্তা স্টীমারে আসিতে হইয়াছিল, খালাসিরা কাছি ফেলিয়া সুর করিয়া জল মাপিত; ফটিক প্রলাপে তাহাদেরই অনুকরণে করুণস্বরে জল মাপিতেছে এবং যে অকুল সমুদ্রে যাত্রা করিতেছে, বালক রশি ফেলিয়া কোথাও তাহার তল পাইতেছে না।’ গল্পের ফটিক রশি ফেলে অকুল সমুদ্রে কোথাও তল পায়নি, একইভাবে শেখ হাসিনা রাজনীতির তল পাচ্ছেন না। কী অদ্ভুত মিল! মনে করা হয়, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ অথবা কথিত রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ দেশের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান করে নেওয়ার সম্ভাবনা হিমাঙ্কে স্থির হয়ে আছে। এরপরও আওয়ামী লীগকে ভোটের বাইরে রাখতে চাইলে তা সামগ্রিক রাজনীতিতে কতটা সুফল বয়ে আনবে তা গভীর বিবেচনার দাবি রাখে। কেননা, দীর্ঘ সময়ের সাবেক শাসক এই দলটির কর্মী-সমর্থকরা মনে করেন, তাদের নেত্রী এই তো এলো বলে! প্রসঙ্গত, ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পরাজয়ের কিনারে দাঁড়িয়েও আমেরিকার সপ্তম নৌবহরের ভরসায় সাধারণ পাকিস্তানি সেনারা বলত, ‘আতা হ্যায়…।’
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ সব সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। ভিজিট করুন : http://www.etihad.news
* অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইত্তেহাদ নিউজে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায় ।