ইত্তেহাদ স্পেশাল

পটুয়াখালীর শহীদ হৃদয় বিসিএস অফিসার হয়ে মা-বাবার দুঃখ ঘোচানোর স্বপ্ন দেখতেন

image 194252 1745729865
print news

বাসস : ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের সাহসী যোদ্ধা হৃদয় চন্দ্র তারুয়ার কণ্ঠনালী শুধু ছিন্নভিন্ন করেই ক্ষান্ত হয়নি ঘাতক বুলেট; একই সঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে তার দরিদ্র বাবা-মায়ের বহুদিনের লালিত সব স্বপ্ন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সম্মান তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র তারুয়া পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার আন্দুয়া গ্রামের দরিদ্র কাঠমিস্ত্রি রতন চন্দ্র তারুয়া ও মা অর্চনা রানীর একমাত্র সন্তান। ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই তরুয়া শতাধিক সহযোদ্ধার সঙ্গে বিক্ষোভে যোগ দেন।

সেদিন দুপুর থেকে সন্ধ্যা অব্দি ষোলশহর থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত চলমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে বিকেল ৪টায় পুলিশের সঙ্গে তখনকার ক্ষমতাসীন দলের সশস্ত্র ক্যাডারদের উপর্যুপরি হামলার একপর্যায়ে হৃদয়ের গলায় গুলি বিদ্ধ হয়। চট্টগ্রাম ও ঢাকায় পাঁচদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ২৩ জুলাই ঢাকা মেডিকেলে মারা যান তিনি।

একমাত্র সন্তান হৃদয়কে ঘিরেই আবর্তিত হতো বাবা রতন তারুয়া ও মা অর্চনা রানীর ভবিষ্যতের সব স্বপ্ন ও আশা। তারা আশা করেছিলেন, তাদের মেধাবী ছেলেটি একদিন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে তাদের অভাবের সংসারে স্বচ্ছলতা আনবে, তাদের দুঃখ ঘুচাবে।

শহীদ হৃদয় তারুয়ার পটুয়াখালীর ভাড়া বাসায় কথা হয় তার বাবা-মায়ের সাথে। সেখানে উঠে আসে একমাত্র পুত্র সন্তানের শহীদ হওয়ার বর্ণনাসহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ অর্জন নিয়ে বাবা-মায়ের কষ্টকর সংগ্রামের গল্প।

হৃদয়ের বাবা রতন তারুয়া (৫২) বলেন, ‘১৮ জুলাই বিকেলে হঠাৎ ফোনে আসে। ওর বন্ধু জিমি বলে, আংকেল আমি হৃদয়ের বন্ধু। ঘাবড়াবেন না। হৃদয়ের একটা এক্সিডেন্ট হইছে। ওর গায়ে রাবার বুলেট লাগছে।’

‘এই কথা শুনে আমি জায়গায় বসে পড়ি। চট্টগ্রামে যাওয়ার মতো কোনো পরিবহন পাচ্ছিলাম না। দেশের অবস্থা তো ভালো ছিল না। লঞ্চও চলে না, গাড়িও চলে না। কঠিন বিপদে পড়ে যাই।’

পরে জানতে পারি, তৎক্ষণাৎ তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা পাঠানে হয়। সেখানে তাকে মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হয়। ২১ জুলাই ওখানকার ডাক্তারদের বোর্ড বসে। তারা বলেন, হৃদয়ের চিকিৎসা সেখানে সম্ভব হবে না। তাকে ঢাকা মেডিকেলে রেফার করা হয়।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও অনেক চেষ্টা-তদবিরের পর ঢামেকে আইসিইউ ম্যানেজ হয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ২৩ জুলাই ভোরে হৃদয় দুনিয়া ত্যাগ করে বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন রতন তারুয়া। হৃদয়কে পটুয়াখালী এনে দাহ করা হয় বলে জানান তিনি।

হৃদয় চন্দ্র তারুয়ার বাবা রতন তারুয়া নিজের চায়ের দোকানে দেখে বলেন, আমরা ভালো নেই। কী আর বলবো আপনাদের। আমাদের পরিবারের কেউ কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।

পরে তাদের মুনসেফপাড়ায় ভাড়া বাসায় গেলে রতন তারুয়া বলেন, আমার আদরের ধন হৃদয় এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছিল, অনেক কষ্ট করেছে। অতি অল্প আয়ে তার খরচাদি আমার পক্ষে বহন করা সম্ভব হতো না। টিউশনি করে নিজের লেখাপড়ার খরচ যোগাত। অনেক স্বপ্ন দেখেছি তাকে নিয়ে।

হৃদয়ের বাবা বলেন, স্বৈরাচারী সরকারের পুলিশসহ যারা মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত তাদের যেন বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হয়। এটাই সরকারের কাছে আমার দাবি। হৃদয়সহ যারা রক্ত দিয়ে নতুন স্বাধীনতা দিয়েছে জাতিকে তারা যেন তাদের এই আত্মদানকে সম্মান করেন।

তিনি বলেন, সরকারের কাছে চাওয়া। আমাদের একমাত্র পুত্র সন্তান হারিয়ে বৃদ্ধ বয়সে যেন কারো দ্বারস্থ হতে না হয়। সেজন্য আমাদের স্থায়ী একটা কিছু করে দিক। বাকি দিনগুলো যেন অর্থের চিন্তা করতে না হয়।

হৃদয়ের বাবা বলেন, সর্বপ্রথম জামায়াতে ইসলামী আমাদের দুই লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়েছে। আর জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন আমাদের দিয়েছে ৫ লাখ টাকা। জামায়াতের টাকাটা পেয়েই কাঠমিস্ত্রি পেশা ছেড়ে চায়ের দোকান দিয়েছি। তারা আমাদের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন।

শহীদ হৃদয় তারুয়ার বাবা রতন তারুয়া (৫২) জানান, জামায়াতসহ বিভিন্ন সংস্থার লোকজন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার মেয়েকে মাস্টাররোলে চাকরির ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন। ‘তারা চাইছিল ছেলে যেহেতু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে সেহেতু ওখানে মেয়েকে চাকরি দিতে, কিন্তু আমি তাদেরকে নিজ জেলায় দিতে অনুরোধ করেছি ।

বাসায় ঢোকার পরে কান্নারত অবস্থায় শহীদ হৃদয় তারুয়ার মা অর্চনা রানী তারুয়া (৪৫) বলেন, আমি আমার হৃদয়ের বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না। একথা বলেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি।

পরে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘সবশেষ যেদিন ভার্সিটির বন্ধে বাড়িতে আসলো তখন হৃদয় বলেছিল, ‘মা আমাকে প্রাইমারিতে ভর্তি করানোর পর থেকে এখনও তুমি মাইনষের বাসায় কাজ করো। আমার খুব খারাপ লাগে।’

আমি ছেলেকে বলি, ‘বাবা ওই সময় আমি মাইনষের বাসায় মাসে দুইশ টাকা বেতনে কাজ করছি। আর এখন অনেক টাকা পাই। আজকাল চাকরি লইতেও তো টাকা লাগে। তাই কিছু জমানোর চিন্তা থেকে মাইনষের বাসায় কাজ করি।’

হৃদয় রাগ করে বলে, ‘মা ওসব আর বলবা না। আমি তো ভালো লেখাপড়া করি। আমার চাকরি পেতে টাকা পয়সা লাগবে না। আমি বিসিএসের বই পড়ি। মাস্টার্স করবো আর ঢাকায় গিয়ে চাকরি করবো। তোমাকে আর কাজ করতে হবে না, মা।’

হৃদয়ের মা বলেন, ‘আমার ছেলের প্রতিটা পরীক্ষায় রোল এক হত। শিক্ষা জীবনে কখনও দুই হয়নি। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পর থেকে আমার ছেলে সবসময় ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে পাস করেছে। আমার হাতের নখও কেটে দিত আমার ছেলে। আজ আমার ছেলে নেই!’ বলেই কেঁদে ফেলেন অর্চনা রানী।

‘হৃদয় যখন ক্লাস এইটে উঠছে। তখন আমাকে বলে মা একটা গাইড কেনা লাগবে। পরে এক মাস মানষের বাসায় কাজ করে ৭০০ টাকা পাই। ওই টাকা ওর হাতে দেয়ার পর হৃদয় গাইড কিনে বাসায় নিয়ে আনে।’ বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন শহীদ হৃদয়ের মা অর্চনা রানী।

তিনি কেঁদে কেঁদে বলেন, ‘আমার ছেলের কথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না। প্রতি মুহূর্তে মনে পড়ে। ওরে ফোন দিলেই বলত, ‘মা তুমি ওষুধ খাইছ? টাইমে টাইমে ঘুমাইও।’ এরকম কথা দুনিয়ার আর কেউ কইবে না আমারে!

হৃদয়ের মা বলেন, ‘আমাদের গ্রামে জায়গা আছে কিন্তু বাড়ি নাই। সরকার যদি একটা বাড়ি করে দিত তাহলে বাকি জীবনটা নিজের ঘরে থাকতে পারতাম। মানুষের বাড়িতে আর ভাড়া থাকতে মন চায় না। এখন আমি চারদিকে অন্ধকার দেখছি।’

তিনি বলেন, ‘হৃদয়কে হারিয়ে আমার জগতের কিছু ভালো লাগে না। ওর স্মৃতিগুলো আমাকে কাঁদায়। আমি আমার ছেলের মুখটা কিছুতেই ভুলতে পারছি না। আর কেউ আমাকে মা বলে ডাকে না। এই কষ্ট কীভাবে আমি সহ্য করব?’

আজও ছেলের শার্ট-প্যান্ট বুকে জড়িয়ে ধরে অনবরত কেঁদে বুক ভাসান হৃদয়ের মা। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলের খুনিদের ফাঁসি চাই। আমার বুক যারা খালি করেছে তাদের বিচার চাই।

 

সর্বশেষ  গুরুত্বপূর্ণ  সব  সংবাদ, ছবি ,অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও লেখা পেতে আমাদের  ফেসবুক পেইজে  লাইক  দিয়ে  অ্যাকটিভ  থাকুন।  ভিজিট করুন : http://www.etihad.news

* অনলাইন  নিউজ পোর্টাল  ইত্তেহাদ নিউজে  লিখতে  পারেন  আপনিও। লেখার বিষয়  ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন  [email protected] ঠিকানায় ।

সংবাদটি শেয়ার করুন....
ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

ইত্তেহাদ নিউজ ডেস্ক :

About Author

etihad news is one of the famous Bangla news portals published from Abudhabi-UAE. It has begun with a commitment to fearless, investigative, informative, and independent journalism. This online portal has started to provide real-time news updates with maximum use of Smart Technology.